অসুস্থ পথে স্বাস্থ্যখাত
এই লেখাটি কেন লিখতে বসেছি সেই ব্যাখ্যা শেষে দিচ্ছি। তার আগে জানতে চাই, দেশের স্বাস্থ্যখাতের ওপর আপনার কি বিশ্বাস আছে? এটা নিয়ে গণভোট করেন; উচ্চ-মধ্য-নিম্ন যেকোনো অবস্থানের মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন; দেখবেন বেশিরভাগ মানুষই আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না কিংবা রাখছেন না।
আমাদের দেশে ভালো ভালো চিকিৎসক আছেন। তারপরও স্বাস্থ্যখাতের ওপর দেশের মানুষের আস্থা কম। এমনকি অনেকে ধার করেও দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান। কেন?
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২০ সালে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশই বাংলাদেশি, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
চিকিৎসার জন্য কেন মানুষ দেশের বাইরে যায়? তার বড় কারণ, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া। শহর তো বটেই, প্রান্তিকের যেকোনো সরকারি হাসপাতালে গেলে দেখবেন, টাকা ছাড়া কেউ কোনো সেবাই পাচ্ছেন না।
২০১৭ সালে টিআইবির খানা জরিপে স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন (ডয়চে ভেলে, ১৯ জুন ২০২০)। এই বাড়তি টাকা না দিলে যে কারো প্রাণ যেতে পারে, সেই দৃষ্টান্তও আমাদের দেশে আছে।
২০২১ সালের ৯ নভেম্বরের একটি ঘটনা। গাইবান্ধার একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বিকাশ চন্দ্র কর্মকার পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করত। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় সে। প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, তারপর সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়ায় নেওয়া হয় বিকাশকে। রাত ১০টার দিকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মো. আসাদুল ইসলাম মীর ওরফে ধলু দালালি বাবদ বিকাশের বাবা বিশু কর্মকারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা দাবি করেন। পরে ২০০ টাকায় রাজি হন। বিকাশকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক বিকাশকে জরুরি সেবা দিয়ে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেন। ধলু রোগীকে সার্জারি ওয়ার্ডে নিয়ে যান। শয্যা ফাঁকা না থাকায় তাকে মেঝেতে শয্যা দেন। পরে বিকাশের অভিভাবকের কাছে টাকা চান ধলু। তাদের কাছে ১৫০ টাকা ছিল। তাই তিনি ধলুকে ১৫০ টাকা দেন। তখন ধলু আরও টাকা দাবি করেন। বিশু বলেন, তার কাছে আর টাকা নেই। তখন ধলু উত্তেজিত হয়ে বিকাশের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেন, গালাগালি করেন। এরপরই শ্বাসকষ্টে বিকাশ মারা যায়। (প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর ২০২১)
বিশু অভিযোগ করেন, 'মাত্র ৫০ টাকা বকশিশ কম দেওয়ায় হাসপাতালের কর্মচারী অক্সিজেন মাস্ক খুলে আমার ছেলেকে হত্যা করেছেন। তবু থানায় মামলা করব না। গরিব মানুষ। মামলা চালানোর সামর্থ্য আমার নেই।'
এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দিতেই পারেন। আসলেই কি এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এমন ধলু কি শুধু বগুড়া হাসপাতালেই আছে? দেশের যত সরকারি হাসপাতাল আছে, সব জায়গায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। শুধু আমরা জানছি না বা গণমাধ্যমে আসছে না।
টাকা, ক্ষমতা, কিংবা পরিচয়ের জোরে সরকারি হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায়। আমার শ্বশুরের সঙ্গে কাজ করতেন প্রকৌশলী শিউলি। তিনি আশুলিয়া থেকে আসার পথে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তাকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল নেওয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে যান আমার শ্বশুরই। যাওয়ার পর বিভিন্নভাবে কালক্ষেপণ করছিলেন কর্মচারীরা। তিনি যে গুরুতর অসুস্থ সেদিকে তাদের খেয়ালই নেই। বিষয়টি জানার পর পরিচিত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে কল করে ঘটনা জানাই এবং তিনি তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ফোন দেন। এরপর থেকে সব কাজ ঝড়ের গতিতে চলতে থাকে। অথচ তার আগ পর্যন্ত প্রাথমিক সেবা ছাড়া তেমন কিছুই দেওয়া হয়নি।
হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা দিতে কেন টাকা, ক্ষমতা বা পরিচিত খুঁজে বের করতে হবে? কেন সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা পেতে এত বেগ পেতে হবে?
এসব কারণে আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য মানুষ বাইরে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব প্রাইভেট হসপিটালস সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে ৫ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। এতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া, রোগী ও তার সঙ্গীর ভ্রমণ, থাকা, খাওয়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয় রয়েছে।
শুধু সেবা নেওয়ার জন্য আমাদের দেশ থেকে বিদেশে রোগী বা অর্থ যাচ্ছে, তা নয়। গোটা চিকিৎসা খাত একটি সুতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা হয়তো বিষয়টা বিশ্বাসই করবেন না। তারা বলবেন, করোনার সময় চিকিৎসকরাই গোটা দেশের আশা ছিল। সবাই এই বিষয়ে একমত। কিন্তু, তার পাশাপাশি এটাও জানতে হবে, করোনার সময় চিকিৎসাখাতে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে।
'করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা: কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক গবেষণা বলছে, করোনা সংক্রমণের এক বছর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি চিকিৎসা সুবিধার সম্প্রসারণ করতে না পারা, বাজেট ও যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও সব জেলায় ১০টি করে আইসিইউ শয্যা প্রস্তুতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করা, অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে ফেলে রাখা এবং ১৩ লাখের বেশি টিকাগ্রহীতাকে দ্বিতীয় ডোজ সরবরাহ করতে না পারা, ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও কেনার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল। (প্রথম আলো, ১৭ জুন ২০২১)
মাস্ক কেলেঙ্কারি, কোভিড টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি, জেকেজি আর রিজেন্ট হাসপাতালের মতো বড় আর আলোচিত ঘটনার পরেও গত তিন মাসেই স্বাস্থ্যখাতে ১ হাজার ৮০০ জনবল নিয়োগে কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব, শত শত কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর আবার বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। (বিবিসি, ১৯ মে ২০২১)
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় রোজিনা ইসলামকে যেভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে, সেই দৃষ্টান্তও ভুলবার নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য মতে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না ও সিনোভ্যাক টিকার ক্ষেত্রে প্রাপ্তির চেয়ে টিকা প্রদান হয়েছে বেশি। জেঅ্যান্ডজে টিকার হিসাবে প্রাপ্তির চেয়ে টিকা প্রদান কম দেখানো আছে। সেই অনুযায়ী এই টিকা উদ্বৃত্ত থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখন অনেক রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়ে গেছে। অর্থাৎ রোগীর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না। আরও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, চিকিৎসাপত্রে আমাদের চিকিৎসকরা যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক লেখেন, তার সবই কি প্রয়োজন?
অর্থ বা অন্য কোনো লোভ বা ফার্মাসিটিউক্যাল প্রতিষ্ঠানের চাপে পড়ে চিকিৎসক যখন অ্যান্টিবায়োটিক লেখেন, তখন রোগীর জীবন হুমকিতে পড়ে না? চিকিৎসক কি জানেন না, অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ফলে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে? তাহলে কেন একজন চিকিৎসক এই কাজ করেন?
পরিচিত যেকোনো রোগীর খোঁজ নেন, এসব ঘটনা তাদের ক্ষেত্রে অহরহ ঘটছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, চিকিৎসক রোগীর কাছে কেন সেই রোগ হলো তার ব্যাখ্যা দেন না। জানতে চাইলে বলেন, 'আপনি কী বুঝবেন? আপনি কি ডাক্তার?'
এর অর্থ এই না যে সব চিকিৎসকই এমন কাজ করেন। তবে, যারা করেন তাদের সংখ্যা এত বেশি যে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আমাদের অনাস্থা তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
এবার আসি মূল আলোচনায়। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনের চেয়ে এমনিতেই বরাদ্দ থাকে কম। তবু প্রতি বছর যে বরাদ্দ মিলছে তাও শেষ করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি অর্থবছর বরাদ্দের বড় একটি অংশ ফিরিয়ে দেওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, টাকার অংকে তা ৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ। সেই হিসাবে এখনো ৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। (সমকাল, ২১ মে ২০২৩)
১০ মাসে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার যে খরচের কথা বলা হলো, তার মধ্যে বেতন-ভাতা, পরিচালন ব্যয় থেকে শুরু করে সবই যুক্ত। সেই হিসাব করলে দেখা যাবে রোগীর পেছনে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় আসলে খুবই স্বল্প। অথচ প্রান্তিকের যেকোনো হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি হলে সেইসব হাসপাতালে আরও ভালো সেবা দেওয়া যায়। কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও তা ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল নেই।
বড় তিন হাসপাতালে ২৩৮ যন্ত্রপাতি নষ্ট (প্রথম আলো, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩); আছে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি, নেই ব্যবহার (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৫ জানুয়ারি ২০২০); সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনায় ধুম, ব্যবহারে অনীহা (ইত্তেফাক, ২৭ জুলাই ২০২২); ৩২ হাসপাতালের ৬৫ যন্ত্র অচল, অব্যবহৃত (প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট ২০২১); হাসপাতালের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বিকল, চিকিৎসাবঞ্চিত রোগীরা (বাংলা ট্রিবিউন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩); লোকবল নেই, অকেজো মেডিকেল যন্ত্রপাতি (যুগান্তর, ০৪ জুলাই ২০২১)। গোটা দেশের চিত্র এমনই। এমন অজস্র সংবাদ শিরোনাম দেখানো যাবে উদাহরণ হিসেবে। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে; কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই।
এসব চিত্র হতাশ আর কষ্টের জন্ম দেয়। কিন্তু এতে স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট কারো কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না। বরং উল্টো চিত্রের দেখা মেলে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যখন ১২ বছরের একটি সন্তান পৃথিবী ছাড়ে, তখন আমার কষ্ট তীব্র হয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যখন ফুলের মতো ৫/৬ বছরের কন্যাশিশু বিদায় নেয়, তখন বাবা হিসেবে আমারও অসহায় লাগে। আমিও নিজেকে দোষী ভাবি। আমার মনেও বারবার একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, অসুস্থ পথে স্বাস্থ্যখাতের ভিড়ে আমার বা আমাদের সন্তান এই পৃথিবীতে সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে তো?
বিনয় দত্ত; কথাসাহিতিক ও সাংবাদিক
benoydutta.writer@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments