শতধা বিভক্ত সমাজে ঐক্যের ইশতেহার

‘সবার’ বদলে ‘আমি’, ‘আমার’ শব্দগুলোই আমাদের আলোচনায় স্থান করে নিচ্ছে। সামষ্টিকভাবে পুরো সমস্যাকে আমরা আমলে নিতে পারছি না।

দেশে অনলাইন, অফলাইনে মানুষ একটা অস্থির সময় পার করছে। কে সঠিক, কে সঠিক নয়—প্রত্যেকেই তার ভিন্ন মতের, দলের, ধর্মের; ভালো মানুষ কিংবা যারা নিজ নিজ দলে পূজনীয়, তাদেরকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা ভিলেন বানানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। একই সঙ্গে নিজেকে, নিজের দলকে, স্ব-গোত্রের সবাইকে নির্ভুল প্রমাণ করতেও তৎপর।

'সবার' বদলে 'আমি', 'আমার' শব্দগুলোই আমাদের আলোচনায় স্থান করে নিচ্ছে। সামষ্টিকভাবে পুরো সমস্যাকে আমরা আমলে নিতে পারছি না। আমাদের পরিবার, পরিবেশ, ধর্ম, শিক্ষাব্যবস্থার ভিন্নতায় একে অপরকে সমাজের, দেশের, ধর্মের দুশমন হিসেবে দেখছি। একই প্ল্যাটফর্মেও আমাদের দেখা হয় না। এতে করে একজনের চিন্তার সঙ্গে অপরের চিন্তার অমিলের কারণ, ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত, জানার সীমাবদ্ধতা ও উপলব্ধির সময়, সুযোগ ও সক্ষমতা তৈরি হয় না। বরং বিপরীত মতের সৌন্দর্যকে আমরা মূলোৎপাটন করতে চাই।

ছেলেবেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বশেষ কর্মস্থলে থাকার মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্কুল, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন সময়ে এবং পরবর্তী জীবনে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিচার লেখন, সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগে দেশের বিভিন্ন দল, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীকে জানার চেষ্টা করেছি। দেখার চেষ্টা করেছি, একজনের সঙ্গে অপরের মিল ও অমিলের কারণগুলো। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটি মনে হয়েছে—বাংলাদেশের সব ধর্ম, বর্ণ, দল, গোষ্ঠীতে 'ভালো মানুষ' আছেন। তারা যে দলই করেন না কেন, যে ধর্মই পালন করেন না কেন, যে জাতি, গোষ্ঠী কিংবা যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই থাকেন না কেন, দিনশেষে তারা আসলে মানুষের মুক্তির সন্ধান করেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ খোঁজেন। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চান, বৈষম্যহীন সমাজ চান।

কিন্তু মুশকিল হলো, অপর দল, ধর্ম, বর্ণের মানুষের থেকে নিজেদের তারা অধিকাংশ সময়ে গুটিয়ে রাখেন। এতে একজন অপরজনকে জানতে পারেন না। বরং অধিকাংশ সময়ই ভুল বোঝাবোঝির ঘটনা ঘটে। অপরদিকে প্রত্যেক দলেই কিছু নীতিভ্রষ্ট, সুবিধাভোগী, অনৈতিক, লোভী মানুষ থাকেন। যারা সমাজের, অপরের ক্ষতি করে চলার মধ্য দিয়েই সমাজে দাপুটে অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। এই চেষ্টায় দল বা আদর্শের বিবেচনা না করে তারা বরং তাদের সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে তোলেন, সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন, যাদের মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, মানুষকে ভয়ভীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তাদের নিয়ে অপরাধ জগতের সকলেই একযোগে কাজ করতে ভালোবাসেন। পরস্পর পরস্পরের কাজে সহযোগিতা করেন। এ কারণে অপরাধ জগতে একবার কেউ যুক্ত হয়ে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল হয়ে যায়।

আর পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করার কারণে তারা অল্প সময়েই সুবিধাভোগী দল হিসেবে নিজেদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় এক হয়ে যান। বখে যাওয়া নেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের কোনো দল নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই। যারা অনৈতিক কাজ, তথা হত্যা, লুণ্ঠন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ভূমিদস্যু—এমন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের ক্ষেত্রেও কোনো ধর্ম কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিয়ে তাকে বোঝা যাবে না। এমন মানুষ যেকোনো সময়ে যে কারো দলে ভিড়ে শ্লোগান দেয়। দল বা ধর্ম তাদের কাছে মুখ্য ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হলো, তারা নিজেদের অবৈধ সুবিধা আদায়ে ঢাল হিসেবে দল, ধর্ম, জাতি, সংগঠনকে ব্যবহার করেন।

অপরদিকে ভালো চিন্তার, ভালো কর্মের মানুষ সমাজবিচ্ছিন্ন থাকে, কারণ তারা মনে করেন যে অন্য বিশ্বাস বা আদর্শের মানুষের সংস্পর্শ আসলে আদর্শচ্যুত হয়ে যাবেন। কখনো অন্যজন কি মনে করবে, সেই ভাবনা থেকেও তারা এমন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। দীর্ঘ সময় পরস্পরকে কাছ থেকে না দেখার কারণে, নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এমনকি, কখনো তা বিদ্বেষে রূপ নেয়। পরস্পরকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার কারণে একে অপরের মধ্যে কোনো ভালো গুণাবলি খুঁজে পান না। এমনকি যখন তাদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হোন, তারা বিষয়টিকে উপভোগ করেন। এটি বাংলাদেশের বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকট। প্রত্যেকে প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট লেন্স, সিলেবাসের গণ্ডির মধ্য থেকে দেখে। পরিপূর্ণরূপে দেখার ইচ্ছা না থাকার কারণে সর্বদাই আংশিক চিত্রকেই পরিপূর্ণ চিত্র ধরে নিয়ে নৈতিক মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে।

একজন নেশাগ্রস্থ সন্তান, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত সন্তান, চুরি ও অপরাধে জড়িত হয়ে যাওয়া সন্তান দিনশেষে নিজ পরিবারের জন্যও হুমকি। অন্য ধর্মের, দলের, সংগঠনের যে মানুষটি নৈতিক, মানবিক, দক্ষ—সে দিনশেষে সকলের জন্যই আশীর্বাদ। এই উপলব্ধি যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে আমরা শুধু প্রচলিত আদর্শের বিষবাষ্পে পরস্পরকে আহত করব। সে সুযোগে অনৈতিক চিন্তা ও কর্মের মানুষ নিজেদের মতাদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে।

আমাদের আরেকটি সংকট—শিক্ষা। বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষ, যারা একদা পড়াশোনা করলেও বর্তমানে আর পড়াশোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এমনকি তাদের কর্মস্থলে, বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ নেই। শতধা বিভক্ত শিক্ষা সিলেবাস, অন্য ধর্মের ধর্মীয় জ্ঞান ও মানুষ সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা আমাদেরকে পরস্পর শত্রু হিসেবে ভাবতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। আমাদের সমাজে খুব কম প্ল্যাটফর্মই আছে, যেখানে সমাজের সবপক্ষ একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আইডিয়া, বোঝাপড়া, সমাজের সংকট নিয়ে আলাপ করতে পারে। যে সংকটে সকলে ভুক্তভোগী, সে বিষয়েও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের শিক্ষকরাও জ্ঞানার্জন করার পেছনে মেহনত ছেড়ে দিয়েছেন। যারা আবার একটু পড়াশোনা করেন, তারা শুধু নির্দিষ্ট সিলেবাসের গণ্ডির মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেন। ফলে জ্ঞানার্জনে আমাদের অবস্থা অন্ধের হাতি দেখার মতো।

পশ্চিমা বিশ্ব সবকিছুর পরও জ্ঞান, দান ও সেবার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারায় আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক, ধর্মীয় মানুষ দিনশেষে আবাসযোগ্য ভূমি হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকাকে পছন্দের তালিকায় রাখেন। শাসক ও শোষিতরা দিনশেষে পশ্চিমা দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকেন। সোনার বাংলাদেশকে নিজের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল মনে করার সংখ্যা নেহায়েত কম। দেশটা দিন দিন মাদকের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। অপরাধ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ঘুষ ও সুদের যাতাকলে একদল অতি মুনাফালোভীদের সিন্ডিকেটে সব ধর্মের, বর্ণের মানুষের জীবন এখন নাভিশ্বাস।

বিভিন্ন দল, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীতে থাকা ভালো মানুষের এক টেবিলে আসা, পরস্পরের আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার মাধ্যমে সংকট নিরসনে একযোগে কাজ করা, একে অপরের জন্য সুস্থ পরিবেশ, নির্ভয়ে মত-দ্বিমতের সংস্কৃতি তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, স্নেহ, সেবা, জ্ঞান ও দানসহ সকল ইতিবাচক বিষয়ে সহযোগিতাপূর্ণ প্রতিযোগিতা আমাদেরকে একটি সুস্থ, সুন্দর জাতি গঠনে এগিয়ে নিতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনে এমন ইশতেহার নিয়ে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যাবে, এমন একটি দেশ গড়তে আমাদের যার যার অবস্থান থেকে কাজ করা দরকার।

মুতাসিম বিল্লাহ, শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

mutasim.b@cou.ac.bd

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

12h ago