সিটিতে বিএনপির ‘স্বতন্ত্র’ কৌশল?

এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না—এমন রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা বিএনপির জন্য আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটা অনানুষ্ঠানিক অগ্নিপরীক্ষা।

এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি কাউকে মনোনয়ন বা সমর্থন না দিলেও কাউন্সিলর পদে দলের অনেক নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বলা হয়, এ ক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ডের মৌন সমর্থন ছিল অথবা কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান খুব কঠোর ছিল না। কিন্তু এবার ৫ সিটির নির্বাচনে কাউন্সিলর পদেও বিএনপির কোনো নেতা যাতে অংশ না নেন, সে বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বরাতে গত ২৭ এপ্রিল ডেইলি স্টার অনলাইনের খবরে বলা হয়, সিটি নির্বাচনে দলের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ বিএনপি আন্দোলনে আছে। বিএনপির এই নেতার প্রশ্ন, 'যখন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন আমরা কীভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারি?'

অস্বীকার করা যাবে না, যেকোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আগ্রহী। কারণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতার জানান দিতে চান এবং এই সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় না—সেই বার্তাটিও দিতে চান। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ডের তরফে বরাবরই বলা হয়, তারা তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

এমতাবস্থায় এবার বিভিন্ন সিটিতে স্বতন্ত্র কৌশল নিয়েছেন প্রার্থীরা। অর্থাৎ বিএনপির নেতা এবং সরাসরি দলের কোনো পদে না থাকলেও বিএনপিমনা অনেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। শোনা যাচ্ছে, এটি বিএনপির স্বতন্ত্র কৌশল। অর্থাৎ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মোড়কে তাদের প্রার্থীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হলে বিএনপির বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী, এমনকি কোথাও কোথাও মেয়র পদে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীও হেরে যেতে পারেন বলে তাদের বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে বিএনপির দুটি লাভ।

১. তারা বলতে পারবে যে সরকারের জনপ্রিয়তা নেই।

২. মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সাধারণ ভোটারদের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীনদের ভোট দেননি, তাদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে।

কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। সেটি হলো, বিএনপি বলছে যে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে আছে এবং যেহেতু এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে তাদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত রয়েছে, ফলে তারা এমন কোনো কাজ করতে চায় না যাতে সরকারি দলের নেতারা টিপ্পনি কাটার সুযোগ পান। ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার ইস্যুতে কেন্দ্রের সঙ্গে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যে একটা টানাপড়েন রয়েছে—সেটি আন্দাজ করা যাচ্ছে।

যেমন: সিলেটের বিদায়ী মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী লন্ডনে গিয়েছিলেন দলের দ্বিতীয় প্রধান তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করতে। যদিও তিনি এই নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না—সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। শোনা যাচ্ছে, আগামী ২০ মে এ বিষয়ে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত জানাবেন। এর ফাঁকে তিনি হয়তো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লাভ-ক্ষতির হিসাব করবেন।

বিএনপির কয়েকটি সূত্রের বরাতে গত ৯ মে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থানসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেই প্রার্থিতা ঘোষণার বিষয়ে আরিফুল হক কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কার হবেন কি না এবং হলে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকিতে পড়বে কি না? যদি তিনি নির্বাচনে হেরে যান, তখন আম ও ছালা দুইই যাবে কি না? তাছাড়া যেহেতু বিএনপির দলীয় অবস্থান হচ্ছে সিটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, ফলে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র প্রার্থী হলেও তার পক্ষে স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেবেন কি না? যদি না নেন তাহলে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও জনপ্রিয়তা দিয়ে তিনি ভোটের বৈতরণী পার হতে পারবে কি না?

শোনা যাচ্ছে, লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল পাননি। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনায় শেষমেষ তিনি ভোটে অংশ না নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করার মিশনে নিজেকে নিয়োজিত করবেন বলেই মনে হচ্ছে। কেননা, বিএনপি বলছে, সরকার পতনে তারা শিগগির বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলবে। সিলেট অঞ্চলে সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে আরিফুল হকের মতো নেতাকে বিএনপির প্রয়োজন হবে। ফলে তাকে এই নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে দলের হাইকমান্ড হয়তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বা করছে।

তবে বরিশালের চিত্র ভিন্ন। সেখানে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ। আরেক প্রার্থী কামরুল আহসান ওরফে রূপণ। তিনি বিএনপির দলীয় কোনো পদে না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। তিনি বরিশালের বিএনপি দলীয় প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে। সেই হিসেবে বরিশাল মহানগরীতে তাদের একটা ভোটব্যাংক আছে বলে মনে করা হয়।

উপরন্তু বরিশালে একসময় বিএনপির বেশ শক্ত অবস্থান ছিল। অনেকের ধারণা, যদি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে সমর্থন নাও দেয়, রূপণ বিএনপির ভোট পাবেন। আবার যেহেতু তিনি বিএনপির কোনো পদে নেই এবং স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন, ফলে বিএনপির মৌন সমর্থনও হয়তো তিনি পাবেন।

তবে শুধু মেয়র পদে নয়, গণমাধ্যমের খবর বলছে, বরিশালের অন্তত ২৫টি ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যে নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক থেকে শুরু করে সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ পদধারীরাও আছেন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেয়র পদে মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাহিদ হাসান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, দলের ভেতরে তিনি কোণঠাসা। ফলে সেই বঞ্চনার ক্ষোভ থেকেই তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, তিনি ভোটে দাঁড়ালেও রাজশাহীর বিএনপি নেতাকর্মীরা তার পাশে থাকবেন কি না? আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেও তিনি বিএনপি সমর্থক এবং সরকারবিরোধী অংশের ভোট পাবেন।

অন্যান্য সিটির মতো রাজশাহীতেও কাউন্সিলর পদে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। এর সুবিধা নিতে বিএনপির অনেক নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হচ্ছেন। তারাও ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো উত্তেজনাপূর্ণ হয় কাউন্সিলরদের কারণে। এখানে যেহেতু দলীয় প্রতীক থাকে না, ফলে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ক্ষমতা ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করে। আবার কে কোন দলের, সেটাও মানুষ জানে। ফলে সরাসরি দলীয় প্রতীকে কাউন্সিলর পদে ভোট না হলেও মানুষ ঠিকই প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় আমলে নেয়। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে গেলে বিএনপিমনা বা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কাউন্সিলর প্রার্থীরা এর সুফল পেতে পারেন। এভাবে যদি বিএনপি নেতা এবং বিএনপিমনা অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী জয়ী হন, সেটি স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির রাজনীতি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

গাজীপুরেও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দলটির অন্তত ২৪ জন নেতাকর্মী কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেয়র পদে বিএনপির কোনো নেতা প্রার্থী হলে তাকে বহিষ্কার করা হবে কি না, সেটি এখনই বলা কঠিন।

স্মরণ করা যেতে পারে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকার এবং কুমিল্লায় মনিরুল হক সাক্কু নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শেষ পর্যন্ত আরিফুল হক চৌধুরী বা বিএনপির অন্য কোনো নেতা প্রার্থী হলে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কারের শঙ্কা রয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনটি যেহেতু হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের মাস কয়েক আগে, ফলে এখানে কিছুটা 'যদি-কিন্তু' আছে। অর্থাৎ সিটি নির্বাচনের ইস্যুতে বিএনপি স্থানীয় পর্যায়ে তার দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বহিষ্কার করে আন্দোলনের মাঠে নিজেদের শক্তি কমানোর ঝুঁকি নেবে কি না—সেটিও বিরাট প্রশ্ন। সে কারণেই এবারের সিটি নির্বাচন বিএনপির জন্য একটি বড় পরীক্ষা—যে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে সরকারবিরোধী আন্দোলন।

প্রসঙ্গত, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ৮ মে। মেয়র পদে এখন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আছেন ৮ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ৭৭ জন এবং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রতিদ্বন্দ্বী ২৩৯ জন। খুলনা ও বরিশাল সিটিতে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৬ মে এবং রাজশাহী ও সিলেটে ২৩ মে। গাজীপুরে ভোট হবে ২৫ মে, খুলনা ও বরিশালে ১২ জুন এবং রাজশাহী ও সিলেটে ২১ জুন।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Domestic tourism heats up this winter

The local tourism industry was suffering from apprehension over the loss of business amid a long recession stemming from mass unrest, which began in July

1h ago