বিদ্যানন্দ: নামেই যার পরিচয়

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৩ সালে। ২০২০ সালে তারা সর্বোচ্চ আলোচনায় আসে। কারণ সেই সময় ছিল করোনাকাল। মানুষ ঘর থেকে বের হতো না, মৃত্যু ভয় তাড়া করতো। সেইসময় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা আর কেউই করতে পারেনি। সেই স্মৃতি এখন অতীত। কারো স্মরণেও নেই।

বিদ্যানন্দ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে না এটা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। বরং তীব্র সমালোচনা, ফতোয়া জারিসহ অসংখ্য কিছু হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।

এগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে বাঙালি জাতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে কী লিখেছেন তা দেখি—'আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল "আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি।" পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, "পরশ্রীকাতরতা"। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে "পরশ্রীকাতর" বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না।' (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪৭, ৪৮)

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৩ সালে। ২০২০ সালে তারা সর্বোচ্চ আলোচনায় আসে। কারণ সেই সময় ছিল করোনাকাল। মানুষ ঘর থেকে বের হতো না, মৃত্যু ভয় তাড়া করতো। সেইসময় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা আর কেউই করতে পারেনি। সেই স্মৃতি এখন অতীত। কারো স্মরণেও নেই।

সংকটে মানুষ চেনা যায়। করোনার সময় যমদূত যেভাবে প্রাণ কেড়েছে, সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময় আমরা চিনেছি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে, চিনেছি কিশোর কুমার দাসকে। শুধু করোনাকাল নয়, বিদ্যানন্দ সবসময় সময়ের চেয়ে এগিয়ে চিন্তা করেছে এবং সেই চিন্তা বাস্তবায়িত করেছে। তারা এমন সব আইডিয়া বা পরিকল্পনা আমাদের সামনে এনেছে, যার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাষায় পরশ্রীকাতর হলেও আপনি বিদ্যানন্দকে ভালোবাসতে বা পছন্দ করতে বাধ্য হবেন।

'এক টাকায় আহার'; করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো; করোনা রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা সেবা দেওয়া; নিজেদের গার্মেন্টস থেকে পিপিই তৈরি ও বিনামূল্যে সারা দেশে বিতরণ; কুড়িগ্রামে এক টাকায় ভাত-ডাল, মাছ-মাংসের রেস্তোরাঁ চালু; ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক কড়াইয়ে একসঙ্গে ৪ হাজার মানুষের রান্না করার মেগা কিচেন; অবহেলিত উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ভাসমান হাসপাতাল 'জীবন খেয়া' চালু; বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার পর পরিত্যক্ত পতাকা দিয়ে বাচ্চাদের স্কুলের পোশাক বানানো; ভোটের পর পোস্টার দিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাতা বানানো; এক টাকায় শারদ আনন্দ উৎসব; সিলেট-সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যায় মাসাধিক বন্যার্তদের খাবার সহযোগিতা দেওয়া; বঙ্গবাজারে আগুনে আংশিক পোড়া কাপড় কিনে গয়না তৈরি; ২০২৩ সালের বইমেলায় জরাজীর্ণ বইয়ের স্টল দিয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যে লাইব্রেরিগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—এইরকম অসংখ্য উদ্যোগের জন্য নজর কেড়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। তার পাশাপাশি শিশুদের শিক্ষার জন্য তো কাজ করে যাচ্ছেই।

এবার ফিরি শুরুর কথায়, বিদ্যানন্দের সমালোচনা কেন হচ্ছে বা হবে? কারণ, ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা একটি প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের সর্বোচ্চ আলোচনা এবং আস্থার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্মানিত হয়ে ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেয়েছে। এটা অনেকে মেনে নিলে, অনেকের মনে তা ভালোই ঘা দিয়েছে।

ঘা নিয়ে তারা নেমেছে মাঠে, বিদ্যানন্দ কেন এগিয়ে যাবে? নাম বিদ্যানন্দ, নিশ্চয় ভেতরে কিছু আছে, তাদের এগিয়ে যাওয়া থামাতে হবে—সুতরাং নেমে পড়ো। কেমন ছিল বিদ্যানন্দকে থামানোর প্রক্রিয়া? তার আগে আবারও ফিরতে চাই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তাটি এখনো প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন, 'আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ...এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, "আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।" সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না। দুই চারজন ছাড়া প্রায় সকল মওলানা, মৌলভী সাহেবরা এবং তাদের তালবেলেমরা নেমে পড়ল। একদিকে টাকা, অন্যদিকে পীর সাহেবরা, পীর সাহেবদের সমর্থকরা টাকার লোভে নেমে রাতের আরাম ও দিনের বিশ্রাম ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমাকে পরাজিত করার জন্য।' (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৫৬)

বিভাজনের জন্য ধর্ম হচ্ছে সবচেয়ে আদিম অস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়ে আপনি যত ইচ্ছে তত মানুষকে রক্তাক্ত করতে পারবেন। কারণ, এই উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে যতটা জ্ঞান থাকা দরকার ততটা জ্ঞান আদতে সবার নেই। নেই বলেই ব্রিটিশরা সাম্প্রদায়িকতার বীজ আমাদের মগজে-মননে রোপণ করতে পেরেছিল। পাকিস্তান আমলে সেই বীজ গাছে রূপ নিলেও এখন তার ফল ভোগ করছি আমরা।

'বিংশের প্রথমভাগে ১৯২০-এর দশকে এক পরিসংখ্যানে দ্যাখা গ্যালো—যথেষ্ট পরিমাণ মুসলমান ভূস্বামী শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় ততোদিনে এক ধরনের নতুন ইসলামী মূল্যবোধের সাথে পরিচিত হতে শুরু করেছে। এর নাম আলেম সমাজ। এঁরা বিশেষতঃ গ্রামান্তরে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ করতে শুরু করলেন। ইতিপূর্বে হিন্দু প্রতিবেশীর সাথে একই সামাজিক পরিমণ্ডলে যারা মিলেমিশে বাস করতো, এই ধর্মীয় চেতনা তাকে বুঝাতে সক্ষম হলো—সে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী এবং তার চালচলন, রীতিনীতি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নামধাম হবে বিশ্ব ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যা ধারণ করা যায়, তাই ধর্ম। কিন্তু এখন শুরু হলো জ্বেহাদের পথ, অমুসলিম সংস্কৃতি বর্জনের দ্বীনী পথ।

বিশ শতকের শুরু থেকেই হিন্দু-মুসলিম বিরোধগুলো লক্ষণীয় রকম প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে, তেমনিই উচ্চমহলে।' (যুদ্ধ, নীরা লাহিড়ী, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ২০৫)

এই বিভাজন রেখা একদিনে তৈরি হয়নি। ধাপে ধাপে হয়েছে। তার ফলাফল আমরা দেখেছি বিদ্যানন্দের ক্ষেত্রেও। একটা শ্রেণি শুরু থেকেই বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল। তাদের একটাই অস্ত্র—ধর্ম। কিছু হলেই তারা ধর্ম টেনে আনে। যেন সব ধরনের অংক ধর্ম নিয়ে গুণ করেছো।

কিশোর কুমার দাস তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'রোজার সময়টা আমি দেশে থাকি দেশের সবচেয়ে বড় ইফতার আয়োজনের অংশ হতে। লাখো মানুষের আহারের আয়োজন করে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি, সারা দেশে রোজাদারদের মাঝে ইফতার বিতরণ করে স্বেচ্ছাসেবীরা।

...তাদের কণ্ঠে ছিলো উৎকণ্ঠা। আমাকে একটা নিউজ লিংক দেখালো।

আমার ছবি দিয়ে অসত্য এক নিউজ প্রকাশ করেছে তাতে। ইফতারের সাথে গো-চনা মিশিয়ে রোজা নষ্ট করার মতো বাজে সব কথা।

হাস্যকর এই নিউজে আমি হাসি চাপাতে পারি না। এমন গুজব নতুন নয়। এর আগেও পথশিশুদের খাবারে চেতনানাশক মেশানো কিংবা ভবঘুরে মানুষের রক্ত বিক্রি করার গুজব উঠেছিলো।

...তবে কয়েক ঘণ্টায় হিসাব পাল্টে গেলো। আগুনের মতো শেয়ার হচ্ছে। ৯০ শতাংশ মানুষ নিউজটি বিশ্বাস করে গালিগালাজ করছে, কেউ চাপাতি দিয়ে গলা নামিয়ে ফেলতে বলছে। কেউ আমাকে খোঁজার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করছে।' (অদেখা, কিশোর কুমার দাস, বিদ্যানন্দ প্রকাশনী, প্রকাশ: বইমেলা ২০২৩, পৃষ্ঠা ১২৫)

এইসব গুজব সেইসময়ও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। প্রশ্ন হলো, কেন এত ক্ষোভ? কেন এত উগ্রতা? শুরু থেকে বিভিন্ন অভিযোগ বা গুজব সক্রিয় থাকলেও তা ধোপে টেকে না। কিছু অসঙ্গতি হয়তো আছে, কিন্তু তা সমাধান যোগ্য। হয়তো বিদ্যানন্দের সেই আন্তরিকতা আছে, কিন্তু ২০২০ সালে বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় ধর্ম। অভিযোগ করা হয়, 'বিদ্যানন্দ হিন্দু নাম', 'বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিন্দু'। সেই অভিযোগের বিপরীতে বিদ্যানন্দও ব্যাখ্যা দেয়। তারা যে ধরনের কাজ করে, সেই কাজের তুলনায় তাদের নিচে নেমে আসতে হয়। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, আপনি দুর্দান্ত ভালো কাজ করলেও আপনাকে ধর্ম দিয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে। এটা সভ্য দেশের কোনো রীতি হতে পারে না।

তারা জানায়, বিদ্যানন্দ নাম দিয়েছে একজন মুসলমান। আর কিশোর কুমার দাস তখন পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরে গিয়ে চেয়ারম্যানের পদে যান। এরপরও বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ থেমে থাকেনি। বঙ্গবাজারের পুড়ে যাওয়া কাপড়ে গয়নার সঙ্গে অন্যের গয়নার ছবি মিলে যাওয়া, 'মজিদ' নাম দিয়ে একাধিক পোস্ট দেওয়া, আগে থেকে লোকেশন কেন ঘোষণা করা হয় না, পাহাড়ে জমি কেনাসহ যাকাত নেওয়া নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। কিশোর কুমার দাস সব বিষয়ের ব্যাখ্যা দেন। বঙ্গবাজারের বিষয়টি স্বেচ্ছাসেবকদের ভুলের কারণে হয়েছে। 'মজিদ' প্রতীকী নাম হিসেবে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। আগে থেকে লোকেশন ঘোষণা দিলে চাঁদা দিতে হয়, তাই তারা জানায় না। বিদ্যানন্দ বেশিরভাগ জমির মালিক না, লিজ নেওয়া জমিতে অনাথালয়, এতিমখানা, হাসপাতালের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শর্ত অনুযায়ী লিজ নেওয়া হয়েছে জমিগুলো। লিজ দেওয়া জমির দাতা বা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম বন্ধ করলে জমি ফেরত দিতে হবে। আর অর্থনৈতিক অসঙ্গতির বিষয়ে বিদ্যানন্দের শক্ত অবস্থান পছন্দ হয়েছে। সরাসরি অডিট রিপোর্ট ওয়েবসাইটে সবার জন্য উন্মুক্ত করা আছে। যে কেউ তা দেখতে পারবেন।

অডিট রিপোর্ট বিষয়ে কয়েকটা বিষয় বলা দরকার। ২০১৬-২০২২ পর্যন্ত অডিট রিপোর্ট ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত। প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন অডিট প্রতিষ্ঠান রিপোর্টগুলো অডিট করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান অডিট করেছে, তারা বেশ নামীদামী প্রতিষ্ঠান। বিদ্যানন্দ তাদের অর্থের বড় অংশ ব্যয় করে 'এক টাকার আহার' প্রকল্পে। প্রতি বছর ১৭ লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার খাওয়াচ্ছে। ১ লাখ ২০ হাজার পরিবারকে শুকনা খাবার সহায়তা দিচ্ছে। ৭টি এতিমখানা, ৫টি শিখন কেন্দ্র, ২টি স্কুল, ১টি হাসপাতাল, ২টি লাইব্রেরি পরিচালনা করছে।

বিদ্যানন্দ বার্ষিক অনুদান পাচ্ছে ২২ কোটি টাকা। ফাউন্ডেশনের সহায়তার আওতায় নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৫০০। স্বেচ্ছাসেবক আছেন ২০০ জন এবং কর্মকর্তা আছেন ৬০ জন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাখা আছে ৮টি।

পিআর-পাবলিকেশন খাতে তাদের খরচ নেই বললেই চলে। ২০১৬-১৭ সালে পিআর-পাবলিকেশন ব্যয় ০.১ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে ০.২ শতাংশ, ২০১৯ সালে ০.৮ শতাংশ, ২০২০-২১ সালে ০.৪ শতাংশ, ২০২১-২২ সালে তা শূন্যে নেমে আসে। এতকিছুর পরও বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল যাকাত নিয়ে। বিদ্যানন্দে যাকাত দেওয়া যাবে কি? এর বিপরীতে সরাসরি কিছু ইসলামী সংগঠন ও ব্যক্তি বিদ্যানন্দের বিপরীতে অবস্থান নেয়। তাদের ব্যাখ্যা জানার আগে আবারও বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে ফিরতে চাই। তিনি লিখেছেন, 'অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি।' (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৪৮)

ইসলামী সংগঠন ও ব্যক্তিরা জানান, বিদ্যানন্দে যাকাত দিলে তা শরিয়াহভিত্তিক হবে না। এতে শুরু হয় সংকট। এই সংকটের বিপরীতে কিছু প্রভাবশালী, প্রগতিশীল ব্যক্তি বিদ্যানন্দে যাকাত দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। তখন সব ইসলামী সংগঠন জোটবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন কৌশলে ফেসবুকে বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমে পড়ে। কৌশল সেই পুরোনো। অস্ত্র ধর্ম। 'বিদ্যানন্দ হিন্দু প্রতিষ্ঠান', 'বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা হিন্দু'—তা জাতি খুব সাদরে গ্রহণ করে।

যাকাতের বিষয়ে কিশোর দাসের ব্যাখ্যা হলো, ২০২২ সালে বিদ্যানন্দ চেয়েছিল আর যাকাত নেবে না। তখন একজন হুজুর বলেছিলেন, কেউ যাকাত দিতে চাইলে কেন নেবেন না? সে কারণে সিদ্ধান্ত পাল্টানো হয়। এছাড়া যাকাত না নিলে আবার প্রশ্ন তুলবেন অনেকে বা অন্য ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হবে। দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া বিদ্যানন্দের মূল তহবিলের মাত্র ৫ শতাংশ আসে যাকাত থেকে। বিদ্যানন্দের যাকাত বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্য মুসলিম। যাকাত বোর্ডের প্রধান হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান।

এতকিছুর পরও বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে গুজব কি থেমে থাকবে? অবশ্যই না। বরং গুজব সৃষ্টিকারীরা সামনে নতুন উদ্যমে নামবে, নতুন পন্থা অবলম্বন করবে।

সাধারণ মানুষের ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এহসান গ্রুপ। গ্রুপের চেয়ারম্যান তার ৩ ভাই, বোন, তার শ্বশুর, বোন জামাইসহ নিকটাত্মীয়দের প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখেছিলেন। সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয় তারা। ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতিষ্ঠানের ভুক্তভোগীরা কেউ যে টাকা ফেরত পাবে, সেই আশা নেই। প্রশ্ন হলো, বিদ্যানন্দের মতো একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করলেও সমালোচনা বা গুজব তাদের ছাড়ছে না। তাহলে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি যখন এই অপকর্ম করছিল, তখন প্রশাসন থেকে সাধারণ জনগণ কেন নিশ্চুপ ছিল? টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর কেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানকে আটক করা হলো? কেন আগে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? কেন তাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেল না?

বিদ্যানন্দের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়া সহজ নয়। কিশোর কুমার দাস নিজের আয়ের ১ কোটি টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন এই প্রতিষ্ঠান। সেই থেকে বিদ্যানন্দ আজকে একটি ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ড গুড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়, সহজ হবেও না। বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি মানে, বিদ্যানন্দ মাঠে কাজ করছে। কাজ করলে ভুল হবেই। তার মধ্যে এরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। ভুল শুধরে নিচ্ছে কি না, সেটা দেখার বিষয়। ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে সমালোচনা হবেই। কিন্তু বারবার ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে, এই ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা জরুরি।

দেশের সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত হওয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, কঠোর শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কিন্তু বার বার ধর্ম নিয়ে তাদের কাজের মূল্যায়ন করা একধরনের অসভ্যতাও বটে। এইধরনের গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা বুঝতে পারি না। আজকে বিদ্যানন্দ এইধরনের গুজবে আক্রান্ত হলে, কাল অন্য আরও প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হবে। হতে বাধ্য। তাই এখনই গুজব সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করতে হবে।

বিনয় দত্ত, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

benoydutta.writer@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments