এর চেয়ে ভালো বিবৃতি আশা করা উচিত নয়

বলা হয়, স্কুলে শিশুরা পড়ে, কলেজে পড়ানো হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে, পুরোনো জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটায়, জানা বিষয়গুলোকে নতুন করে বোঝার চেষ্টা করার মানসিকতা গড়ে তোলে। এই কাজগুলো করতে না পারলে স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তফাৎ থাকে না।

কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে? এখানে মুক্তচিন্তার বিকাশ কতটা হয়? মানবিক বোধ, দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিছক সনদ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে কি না; বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য দলীয় আনুগত্য শেখানো এবং অনুগত হতে না চাইলে কিংবা হতে না পারলে তার জন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎ নির্মাণের বাইরে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর কী করে—সেটি এখন বিরাট প্রশ্ন। যে প্রশ্নটি আরও ২৮ বছর আগেই তুলেছিলেন আহমদ ছফা।

'অতীতের গৌরব গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। সাম্প্রতিককালে নানা রোগ ব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কাবু করে ফেলেছে। মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুরিজারি, ধনুষ্টঙ্কার নানা রকমের হিস্টিরিয়া ইত্যাকার নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাধিগুলো শিক্ষকদের ঘায়েল করেছে সবচাইতে বেশি। এখন শিক্ষক সমাজ বলতে কিছু নেই। আছে হলুদ, ডোরাকাটা, বেগুনি এসব দল।' (আহমদ ছফা, গাভী বিত্তান্ত, সন্দেশ, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১২)।

কিন্তু গত ২৮ বছরে পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হয়েছে; শিক্ষকদের শরীরে, বিশেষ করে চিন্তায় ও মগজের রোগব্যাধি যে তাদের আরও বেশি ঘায়েল করেছে; লাল-নীল-সাদা রঙের বাইরে শিক্ষক বলতে যে একটি নিরাপদ আশ্রয়, একজন সম্মানিত মানুষের প্রতিকৃতি—সেই জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যে বহু দূর সরে গেছে, তার বড় উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাম্প্রতিক বিবৃতি। যে বিবৃতিতে তারা দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরকে 'রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতা' বলে মন্তব্য করেছে এবং এ ঘটনায় ওই সংবাদপত্রসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।

গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি ছবি নিয়ে শুরু হওয়া তোলপাড়ের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভুইয়া এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদার সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, 'করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সংকট মোকাবেলা করে যে মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে সরকারের বিরোধিতার নামে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার অপচেষ্টা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।' (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৩১ মার্চ ২০২৩)

প্রশ্ন হলো, যে সংবাদটি প্রথম আলো তাদের অনলাইন থেকে তুলে নিয়েছিল; যেখানে দিনমজুরের জায়গায় ভুলক্রমে অথবা সচেতনভাবেই একটি শিশুর ছবি ছাপা হয়েছিলো বলে প্রথম আলো পরে সেই ছবি ও শিরোনাম সংশোধন করেছিল, সেই সংবাদের প্রতিবেদককে ভোররাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিজেদের ক্ষমতা দেখালো এবং পরে ওই প্রতিবেদক ও তার পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলো—এরকম একটি ঘটনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কীভাবে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার অপচেষ্টা বলে অভিহিত করে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের বিবৃতির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিবৃতির মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে, তাহলে সেটিকে আর বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় কি না—সে প্রশ্নও উঠতে পারে।

যে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তচিন্তা ও সহনশীলতা চর্চার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা একটি সংবাদ বা ছবির ঘটনায় (যে সংবাদ ও ছবির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা ভুল স্বীকার করে সংশোধন করেছিল) বিচার দাবি করার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকেই একটি সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করলেন।

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এই সংগঠনকে 'চা চপ সমিতি' বলে উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি গর্ব ও অহংকারের প্রতীককে নিয়ে জনপরিসরে এই ধরনের রসিকতা খুব দুঃখজনক। মানুষ যে এই ধরনের রসিকতা করতে পারছে বা করছে, তার দায়টা কার? এই লজ্জা কার? সম্পূরকভাবে আরও যেসব প্রশ্ন সামনে আসবে বা আসছে তা হলো, কোন প্রক্রিয়ায়, কারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উপাচার্য বা এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন? দলীয় আনুগত্যের বাইরে এইসব পদে আসীন হওয়ার ন্যূনতম কোনো সুযোগ কি আর অবশিষ্ট আছে? কারা শিক্ষক হবেন, কোন প্রক্রিয়ায় হবেন, কীভাবে বেশি নম্বর পাবেন, যোগ্যতা থাকার পরেও শুধুমাত্র দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় কীভাবে তাদেরকে বাতিল করে দেওয়া হবে—এসব নিয়ে নতুন করে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী—২০১৯ সালে এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষার্থী। সুতরাং ২০২৩ সালে এসেও ওই একই প্রশ্ন করতে হয় যে আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ টাকায় চা-চপ-সিঙ্গাড়া-সমুচা পাওয়া যায়—এটিই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের বিষয় হয়, তখন এ প্রশ্নও উঠবে যে, ১০ টাকায় চা-চপ-সিঙ্গাড়া-সমুচা বিক্রির জন্য যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেই টাকাটা কার? ওই টাকা তো এই দেশের কৃষকের, এই দেশের সাধারণ মানুষের। বিশ্ববিদ্যালয় নিজে কত টাকা আয় করে?

এটা ঠিক যে, ঢাবি শিক্ষক সমিতির এই বিবৃতি নিশ্চয়ই সকল শিক্ষকের বিবৃতি নয়। কারণ এই ধরনের সমিতি গঠিত হয় দলীয় বিবেচনায়। আজ আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা এর নেতা। একসময় ছিলেন বিএনপিপন্থিরা। তবে এই বিবৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব না করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য হিসেবেই মানুষ গ্রহণ করবে যদি না এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে সাধারণ শিক্ষকরা আরেকটা বিবৃতি দেন এবং যদি স্বয়ং উপাচার্য এ বিষয়ে চুপ থাকেন। যদি তিনি চুপ থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এই বিবৃতির সঙ্গে তিনি একমত। আর এরকম একটি বিষয়ে তার মতামত না নিয়েই শিক্ষক সমিতি বিবৃতি দিয়েছে, এমনটি ভাবারও কোনো কারণ নেই।

অতএব এই বিবৃতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক একমত না হলেও এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক শিক্ষক এই বিবৃতির নিন্দা ও সমালোচনা করলেও এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক সমিতির নেতারা নিজেদের দলীয় আনুগত্যের (দেশের নয়) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। ভবিষ্যতে আরও অনেক বড় পদ ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিবৃতি হয়তো বিবেচনায় থাকবে।

তাছাড়া, যে দলীয় আনুগত্যের কারণে এরইমধ্যে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা শিক্ষক নেতারা পেয়েছেন, সেই নুন খাওয়ার প্রতিদান হিসেবে কিছু গুণ না গাইলেও চলে না। সেই হিসেবে ঢাবি শিক্ষক সমিতির এই বিবৃতি খুব অস্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে সুন্দর ভাষায় এমন কোনো বিবৃতি আসাটাই বরং অস্বাভাবিক, যেখানে তাদের শিক্ষকসুলভ উন্নত চিন্তা-বোধ ও রুচির প্রতিফলন থাকবে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Political clashes, mob attacks leave 25 dead in July 2025: MSF

The report, based on news from 18 media outlets and verified by rights activists, also noted an alarming rise in mob attacks, recording 51 incidents last month

38m ago