ক্ষমা আর ডাণ্ডার উৎকট সন্ধিক্ষণ

ঢাকা ঘেঁষা গাজীপুরে উৎসব-উল্লাশের ঘনঘটা। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের 'ক্ষমার অযোগ্য' অপরাধ 'ক্ষমা' করে তার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে আওয়ামী লীগ।

সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সই করা চিঠিতে এ বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সুসংবাদটি ঘোষণা হয়েছে আগেই, গত ১৭ ডিসেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভায়। অপেক্ষা ছিল চিঠি প্রাপ্তির। সেই অপেক্ষা শেষ হয়েছে।

জাহাঙ্গীরের 'ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ' ধরা পড়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে, গোপনে ধারণ করা তার কথোপকথনের একটি ভিডিওতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওটিতে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গাজীপুরের কয়েক নেতা সম্পর্কে সাংঘাতিক কিছু মন্তব্য।

এর বিহিত হিসেবে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করে। পরে বরখাস্ত করা হয় মেয়র পদ থেকেও। দলীয় সিদ্ধান্তে ওই অপরাধকে ক্ষমাযোগ্য করে চিঠি পাওয়া তার জন্য অবশ্যই যারপরনাই আনন্দের।

দিনটিতে উল্লাসের আরেক প্রকাশ রাজধানীতে। তবে, তা সাধারণ ক্ষমায় নয়, আইনের গতিতে। কারামুক্তির পর রাজধানীতে বর্ণাঢ্য শোডাউন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। সরকারি ছুটির দিনটিতে পুরনো ঢাকা থেকে মোটরসাইকেল, পিকআপ ও মাইক্রোবাসে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করেন তিনি। আজিমপুর, নিউমার্কেট, কলাবাগান হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। এরপর হাজি সেলিম আওয়ামী লীগের ডাকা সকল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহনের ঘোষণা দেন।

জ্ঞাত আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় গত ১৭ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান পুরনো ঢাকার আলোচিত এই সংসদ সদন্য। একপক্ষের এ ধরনের জয়ের বিপরীতে গত কয়েকদিন ধরে আরেকপক্ষের একের পর এক ডাণ্ডাবেড়িতে স্বজনের জানাযা পড়ার খবর। আজ এখানে তো কাল সেখানে হৃদয় কাঁপানো দৃশ্যপট।

গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজার হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরে মায়ের জানাযা পড়ার ছবি প্রকাশ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়, মূলধারার গণমাধ্যমে। ২০ ডিসেম্বর প্যারোলে মুক্তি দিয়ে জাহাঙ্গীরের গাজীপুরেই বিএনপি নেতা আলী আজমের ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় মায়ের জানাযায় শরীক হওয়া; কেবল জানাযা নয়, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়েই ওই জানাযায় ইমামতিতে করতে বাধ্য করা হয় তাকে।

একে 'অমানবিক' বলে বিবৃতি দিয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। আইনজীবীদের মতে, এই ঘটনা সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী। আসামি দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও এমন আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই বলে মত তাদের।

দুয়েকজন মন্ত্রীও এতে উষ্মা প্রকাশ করে পুলিশকে দূষেছেন। ভবিষ্যতে আর এমনটি হবে না বলে আশ্বস্তও করেছেন। কিন্তু, বাস্তবতা উল্টো। গাজীপুরে আলী আজমের পর শরীয়তপুরে সেলিম রেজারও ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়ার সৌন্দর্যে মায়ের জানাযা পড়ার ঘটনা।

এসবের মাধ্যমে কী বার্তা মিলছে? দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য, সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্তসহ নানা ফৌজদারি অপরাধে দল থেকে বহিস্কৃতদের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে আগেই। দলের এ সিদ্ধান্তটি প্রশ্নফাঁসের  মতো জানাজানি হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভায় বসার আগেই। সেই মোতাবেক এরইমধ্যে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়ে গেছে অনেকের। স্বাভাবিকভাবেই স্ব-স্ব আঙিনায় এখন ব্যাপক ধারে-ভারে শক্তিমান তারা।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের তথ্য মতে,  স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ নানা অপরাধে সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্তের সংখ্যা শতাধিক। সংখ্যাটি আরও বাড়বে, বাড়ছে। ফুরফুরে উচ্ছ্বাসে তাদের মিষ্টি বিলানো, শোভাযাত্রায় নতুন উদ্যমে মাঠ দাবড়ানো অনেকটাই স্বাভাবিক। সেই স্বীকৃতি ও নো অবজেকশন সার্টিফিকেট তারা হাসিল করেছেন। বিরোধীমতের প্রতি এমন নির্মমতার সমসময়ে ক্ষমতাসীন মহলে সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্তদের মোজ-মাস্তি, মিষ্টি বিতরণ। এমন বৈপরীত্য নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ ক্ষমা প্রাপ্তদের অনেকের অপরাধ দলীয় গণ্ডিতে বিচার্য। অনেকে হতাহতের ঘটনায় জড়িত। গত স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিহতের সংখ্যা কম-বেশি শ'খানেক। সেখানে নিজেরা নিজেদের মেরেছেন বলে হত্যা আইনত নিজস্ব হয় না, তা ফৌজদারি ঘটনা। দল তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, এর ভবিষ্যৎ কোথায় গড়াতে পারে তা বিবেকমান যে কারো জন্য এটি গভীর ভাবনার।

এখানে দেশে প্রচলিত আইন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কথাচ্ছলে বলা হয়, আইনের চোখে সবাই সমান। আপত্তি থাকলেও এর সঙ্গে দ্বিমত করা ভয়ের ও ঝুঁকিপূর্ণ। আইনের চোখে সবাই সমান হলেও হাজি সেলিমরা যে একটু 'বেশি সমান', তা বলার চেষ্টা হলেও আমল পায়নি। নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় চড়-থাপ্পড় মারা সেলিমপুত্রের ক্ষেত্রেও 'আইন বেশি সমান', সেই বাস্তবতা দেখা গেছে। এরা অসাধারণ বলেই?

গোপন করার কোনো উপায় নেই, আইনের 'সমতল' ভূমি ও 'লম্বা' বাহুর সুবিধাভোগীরা ক্ষমতাসীন নেতা বা আতিপাতি। অথবা ক্ষমতাসীন ঘরানার। এতে আর আপত্তি বা দ্বিমত করার দরকারও মনে করে না সরকারি মহল। সম্পূরক একটা প্রশ্ন এখানে দগদগে হয়ে উঠছে। এতো আয়োজন করে সেলিমপুত্র ইরফান, যুবলীগ নেতা সম্রাট বা মেয়র জাহাঙ্গীরদের কেন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী দেখানো জরুরি ছিল? এলিট ফোর্স র‍্যাবকে দিয়ে তাদের অনেকের আস্তানায় অভিযান, অস্ত্র, ইয়াবা, মদ, হরিণের চামড়াসহ নানান কিছু উদ্ধারকে কি অনর্থক করে ফেলা হলো না? তখন 'কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না', 'আইন সবার জন্য সমান', 'আইনের হাত অনেক লম্বা' ধরনের কথাগুলো শোনানো হয়েছিল কেন? একটার পর একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এনে আগেরটি ভুলিয়ে দিতে?

কেন এতো বায়োস্কোপ? কারাদণ্ড ঘোষণার পর হাজি সেলিমের বিদেশ চলে যাওয়া, বীরের বেশে ফিরে আসা, বোবা হয়ে যাওয়ায় মুখ দিয়ে কথা বের না হওয়া, কারাগারে গিয়ে হাসপাতালে অবস্থান, কারামুক্ত হয়ে শোডাউন। ছাড় দেওয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুকেও। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে তার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা, বিপুল উদ্যমে আবার নেমে পড়ার ঘোষণার স্ক্রিপ্ট আর কতো?

দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের মাঝে এতো থ্রিল-ফ্যান্টাসি না করলেই নয়? করোনার কারণে দেশের সঙ্গে সারা বিশ্বের উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের মাঝে এক্সিম ব্যাংকের ২ কর্মকর্তা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ২ ভাই সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদারের রোগী সেজে ব্যাংকক চলে যাওয়ার মতো হিন্দি ফিল্মি ঘটনাও বাদ যায়নি। তাদেরকে আবার মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে।

তাহলে কেন এই নির্দোষদের এভাবে ভিলেন বানানো হলো? আইনের 'লম্বা হাত' বা 'সবার জন্য সমান' বোঝানোর আর কোনো উপায় থাকতে নেই? এমন কাণ্ডকীর্তিতে আইনের বদনাম বা স্বাভাবিকতা বরবাদ করা মোটেই জরুরি নয়। সাধারণ-অসাধারণ ক্ষমা মিলিয়ে তা তো কতোভাবেই করা যায়। ছেড়ে দেওয়া যায়, ডাণ্ডাবেড়িতে আটকে রাখাও যায়। এ ক্ষেত্রে আইনের দোহাই না দিলেও চলে। তা আইনকে 'ছাড়' দিয়েও করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Taskforce report: 8 mega projects cost $7.5b more for graft, delay

The costs of eight mega projects soared by a staggering 68 percent, or $7.52 billion from the initial estimation, mainly due to poor and faulty feasibility studies, corruption, and delays in launch, according to the report of a government-formed task force.

5h ago