সাম্প্রদায়িক হামলা ও হামলাকারীর মানসিকতা

১০ টাকার জন্য সাম্প্রদায়িক হামলা! সেটাও সম্ভব হয়েছে এই দেশে। ঘটনাটি আবার ঘটেছে ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে। দিবসটি পালনে মাতোয়ারা দেশ, সন্ধ্যায় জানা যায়, বরিশালে সাম্প্রদায়িক হামলা।

ঘটনা কী?

২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি। সময় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা। বরিশালের ডিসি মার্কেটের (হাজী মুহম্মদ মহসিন হকার্স মার্কেট) ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

প্রতিদিনের মতো সকালের নাস্তা করে বরিশাল হাজী মোহাম্মদ মহসীন হকার্স মার্কেটের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সৌরভ ঢালী। নাস্তা করে তিনি ৩০ টাকা দিয়ে চলে যেতে চান। কিন্তু, ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্মচারী বলেন, দধি-চিড়ার দাম ৪০ টাকা।

এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ওই দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে সৌরভের হাতাহাতি হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌরভ দাবি করেছেন, 'কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ভবতোষ ঘোষ ভানু আমার গায়ে হাত তোলে। এমনকি তার কর্মচারীও আমাকে মারধর করে। পরে আমি পুরো বিষয়টি আমার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের জানাই। তারা আমাকে মারধর করার কারণ জানতে চাইলে তাদের ওপরও হামলা চালানো হয়।'

অভিযোগের বিষয়ে ভব‌তোষ ঘোষ ভানু ব‌লেন, 'নাশতার বিল ৪০ টাকা। আমাদের তা‌লিকায় এটা লেখা আছে। ত‌বে সৌরভ ঢালী মিথ্যা ব‌লে আমা‌দের ৩০ টাকা বিল দি‌তে চেয়েছিল। তা নি‌য়ে ওই ব্যক্তি আমার কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ক‌রে। এ নি‌য়ে মারামারি হ‌য়ে‌ছে, ত‌বে ধর্ম অবমাননার মতো কো‌নো ঘটনা ঘ‌টে‌নি। বরং তারা আমার হোটেলের আসবাব ও অন্য মালামাল ভাঙচুর করেছে। এখন নিজেদের দোষ এড়াতে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে।' (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি ২০২৩)

এই বক্তব্য পড়ে ঘটনাটি আরও গভীর থেকে জানার চেষ্টা করি। কেন ১০ টাকার জন্য এত বড় মাপের হামলা হলো তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

খুঁজে পাই জঘন্য মানসিকতার সন্ধান।

মিষ্টির দোকান থেকে বের হয়ে সৌরভ ঢালী প্রচার করেন, তার দাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ধর্ম, ধর্মীয় অনুভূতি, পোশাক, বেশভূষা নিয়ে মানুষের আবেগ বা উগ্রতা স্বভাবতই তীব্র। সেখানে কেউ যখন প্রচার করেন যে তার 'দাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে', তখন সেই আবেগ আরও তীব্রতর হয়। সেটাই হয়েছে বরিশালে।

অন্যথায়, ১০ টাকার জন্য কেউ কারো দোকানে হামলা করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য না।

সবচেয়ে বড় কথা, যেভাবে ভবতোষ ঘোষের দোকানে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে এটা আসলে ১০ টাকার জন্য হামলা না। এটা হয়তো অনেকদিনের পরিকল্পনার অংশ, না হয় ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বিক্রি কমানো বা বন্ধ করে দেওয়ার কূটকৌশল।

এই পরিকল্পনাকে বলা হয় লক্ষ্যভিত্তিক আক্রমণ বা হামলা। এমন ঘটনা এ দেশে এটাই প্রথম নয়। আগেও দেখেছি। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল বা আমোদিনী পালকেও এভাবেই লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল, বিপদে ফেলা হয়েছিল।

প্রশ্ন হলো, কেন মানুষ লক্ষ্যভিত্তিক আক্রমণ করে?

এটা সবচেয়ে আদিমতম উপায়। এই উপায় মানুষ তখনই বের করে, যখন দেশে সেই অপরাধ করলে শাস্তি হয় না। ২০ বছরে এই দেশে যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, তার কি বিচার হয়েছে? আরও বড় পরিসরে বললে, ৫০ বছরে দেশে যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, তার কি বিচার হয়েছে? হয়নি।

২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর। কুমিল্লায় যে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, তার বিচার কিন্তু হয়নি। উল্টো অভিযুক্ত ইকবালকে পাগল প্রমাণে সবাই উঠে পড়ে লেগেছে। শুধু ইকবাল নয়, তারও আগে যত ঘটনা ঘটেছে তারও বিচার হয়নি। এই যে বিচার হয় না, এটা সবাই জানে। তাই মানুষ মিথ্যা বলার সাহস সঞ্চয় করে।

ধর্ম, ধর্মীয় অনুভূতি, পোশাক, বেশভূষা বিষয়ক ঘটনার ক্ষেত্রে আক্রমণকারীরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন উগ্রতায় অন্ধ হয়ে এই ধরনের কাজ করেন।

বরিশালের ঘটনায় গণমাধ্যম বলছে, বিভিন্ন স্থানে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মুসলমানদের মারধর করে দাড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি হঠাৎ জটিল আকার ধারণ করে। মহসিন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ছাড়াও চারপাশের এলাকা থেকে কয়েকশ মানুষ এসে পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে ফেলে।

এসব ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। দ্রুত এক জায়গা থেকে সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় একপক্ষ সুবিধা নেয়, আরেকপক্ষ হামলা থামানোর চেষ্টায় নামে। এইখানেও তা হয়েছে।

এ ঘটনার খবর পেয়ে 'স্থানীয় তৌ‌হিদী জনতার' ব্যানারে বিক্ষুব্ধ লোকজন সেখানে জড়ো হয়ে 'ধর্ম অবমাননার' অভিযোগ তুলে ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এর একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ লোকজন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ভাঙচুর ও কর্মচারীদের মারধর করে। (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি ২০২৩)

এই তৌহিদী জনতা কিন্তু গোটা বরিশালে খুবই সক্রিয়। এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভোলার বোরহানউদ্দিনে মিথ্যা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়েছিল 'তৌহিদী জনতা'। সেই পোস্ট নিয়ে তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে দুঃখও প্রকাশ করেন।

প্রশ্ন হলো, এইভাবে আর কতদিন? ২০২৩ সালের প্রথম সাম্প্রদায়িক হামলা এটি। প্রতি বছর অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, যার বিচার কখনো হয় না। আর বিচার হবে, সেই আশাও করা যায় না। সংকট হলো, মানুষের আস্থা বা বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া।

সৌরভ ঢালী তার জ্ঞানবুদ্ধিতে যেভাবে বাংলাদেশকে দেখেছেন, সেভাবেই কাজ করেছেন। তার মাথায় এই যে সাম্প্রদায়িক বিষ, তা নিশ্চয় একদিনে তৈরি হয়নি। ঘটনার পরিক্রমা প্রতিনিয়ত অসংখ্য সৌরভ ঢালী তৈরি করে।

সৌরভ ঢালীর মিথ্যাচারে একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, ভব‌তোষ ঘোষের অনেক দিনের কষ্টে দাঁড়ানো প্রতিষ্ঠান ভেঙে যায়। এই কষ্ট কি তার কোনোদিন লাঘব হবে? এই ঘটনার পর সৌরভ ঢালীর যে সাহস সঞ্চয় হলো, তা হয়তো সে আরও অনেক জায়গায় ব্যবহার করবে।

সৌরভ ঢালী জানে, এ দেশে মিথ্যা বলে বা ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত হেনেছে বলে অনেক বড় বড় অপরাধ করা সম্ভব। আর রাষ্ট্র সৌরভ ঢালীদের বিচার করতে ভয় পায়। তাই তাদের গ্রেপ্তার না করে ভবতোষ ঘোষদের গ্রেপ্তার করা হয়। ঝুমন দাশ বা রসরাজদের গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবে কি একটা রাষ্ট্রে অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি সম্ভব? এভাবে কি অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া সম্ভব?

আপনি হয়তো এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলবেন, কিন্তু ভব‌তোষ ঘোষ কি তা বিচ্ছিন্ন বলবে? তার মন কি সায় দেবে আবার সবকিছু ঠিক করে ব্যবসা পরিচালনা করার?

বিনয় দত্ত; কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক; benoydutta.writer@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Will protect investments of new entrepreneurs: Yunus

Yunus held a meeting with young entrepreneurs at the state guest house Jamuna where15 male and female entrepreneurs participated

4h ago