জোটজট: ভোটের ৮৮ সিন্ড্রোম
২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন আগামীতে হবে না বলে একটি কথা বাজারে বেশ চাউর। তাহলে কিসের বা কোন সালের মতো হবে? সেই জবাবও নেই। বর্তমান কমিশন গ্যারান্টি দিয়ে বলেছে, দিনের ভোট আর রাতে হবে না। অর্থাৎ ২০১৮ সালের স্টাইলে হবে না।
এর আগের, মানে ২০১৪ সালের নির্বাচন পরিচালনাকারী কমিশনের ওয়াদা ছিল নজিরবিহীন ভোট উপহার দেওয়ার। ঠিকই ১৫৩ আসনে বিনাভোটে নির্বাচনের নজিরবিহীন নজির তৈরি করেছে তারা।
এরপর ২০১৮ সালের কমিশন এসে বলেছে, ২০১৪ সালের মতো বিনোভোটে কাউকে সংসদ সদস্য হতে দেওয়া হবে না। তারাও কথা রেখেছেন। বিনাভোটের বদলে আগের রাতেই ভোট সেরে ফেলেছেন।
বর্তমান কমিশন বলছে, সামনে রাতে আর ভোট দেবে না। মানে দিনে হবে। সেটা কোন ধাঁচের? ২০১৪ সালের দিনের মতো? নাকি আরও কোনো রকমফের অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের সামনে?
নমুনা ও হাল বাস্তবতার মধ্যে ১৯৮৮ সালের বেশ রেশ মিলছে। পাড়া-মহল্লায়ও এবার কেবল দল নয়, জোট গজাচ্ছে। জোট, ফ্রন্ট, মঞ্চ, পরিষদ, অ্যালায়েন্স— কতো যে নাম। এগুলোর বেশকটি একই ঠিকানা বা হোল্ডিংয়ে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করা আছে তাদের অনেকের। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি এরইমধ্যে সফল হয়ে গেছে। বাদবাকিরাও আশাবাদী।
সরকারের বিশেষ মহলে তাদের বেশ ঘোরাঘুরি। খুদ-কুঁড়া পাচ্ছে। মানববন্ধন, রাউন্ড টেবিলের খরচাপাতির সাপ্লাই আসছে। টুকটাক হাত খরচও মিলছে। কিছুদিন আগেও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, টুলে বা ফুটপাতের পাশে টং দোকানে চা-সিগারেট খাওয়া ওই শ্রেণিটি এখন হোটেলে পানাহার করে। দেখতে নতুন হলেও কিছিমটা পুরনো।
১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ নির্বাচিত হওয়ার মতো পরিচিত সব দল এরশাদের অধীনে নির্বাচন বয়কট করলে রাতারাতি বহু নতুন দল গজিয়ে দেওয়া হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়। তখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের বিষয় ছিল না। একটা প্যাড আর ঠিকানা হলেই চলেছে। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, শালা-দুলাভাইসহ চেনাজানারা এক ঠিকানা, এমনকি একই টেলিফোন নম্বরে প্যাড জমা দিয়ে মাঠে নেমে যান, নির্বাচনে অংশ নেন, জয়ীও করা হয়।
সংসদে তাদের দিয়ে বানানো হয় সম্মিলিত বিরোধী দল। কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি-কপ নামের ওই বিরোধী দলের নেতা করা হয় আ স ম রবকে। মানুষের কাছে ছিল সেটি বিনোদনের এক যুগান্তকারী আইটেম। বিশেষ কারণে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ওই আচানক কিছিমের সংসদকে আ স ম রব 'শুয়োরের খোঁয়াড়' বলে মন্তব্য করে বসেছিলেন। তখনকার রাজপথের বিরোধী দলগুলো এতে যারপরনাই তৃপ্তি পায়।
এরপর 'খোঁয়াড়'টি আর বেশিদিন টেকেনি। এরশাদকে বিদায় নিতে হয়। এরশাদ পতনের পর জাতীয় পার্টির নেতারা নানান জায়গায় লুকানোর আগেই পালিয়ে যায় ওই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। এরশাদেরই প্রধানমন্ত্রী রসিক নেতা মিজান চৌধুরী মজা করে বলেছিলেন, বছরের সেরা ঘটনা হচ্ছে, পতন হয়েছে সরকারের, পালায় বিরোধী দল।
সময় অনেক গড়ালেও বহু বছর পর আবার নানান বিতিকিচ্ছিরি নামে আবার এখন চলছে দল ও জোট উৎপাদনের নোংরা খেলা।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংস্কৃতি বহুল আলোচিত 'ওয়ান ইলেভেন' সরকারের ফসল। শুরুতে সমালোচনা থাকলেও পরে পদ্ধতিটি সমাদৃত হয়। ওই সরকারের পর থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়। তখনকার সরকার-ঘনিষ্ঠ অনেকে রাতারাতি দল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়, সংবাদমাধ্যম যেগুলোকে 'কিংস পার্টি' নাম দিয়েছিল।
এখন ওইসব দল কি আছে? তারা কিন্তু নিবন্ধিতই ছিল। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্তমান শাসকদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অনেক আগেভাগেই ঘোষণা দিয়ে বর্জন করেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ৩টি দলকে নিবন্ধন দেয়, যারা একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল হলেও ওই ঝঞ্ঝামুখর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়াতে সহযোগিতা করেছিল।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যে ৩টি দল নিবন্ধন পেয়েছিল তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট বা বিএনএফ অন্যতম। দলটির নেতা আবুল কালাম আজাদ ওই নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, তাও ঢাকার একটি অভিজাত এলাকা থেকে। তিনি এখন কী করেন, কোথায় আছেন, তার পার্টি অফিস কোথায়— এসবের হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে এখন নির্বাচন করা যায় না বলে নাকফুল, মুসকিল লীগসহ নানান মঞ্চ-পরিষদকে ফিটসেন সনদের আওতায় আনতে কিছু কাগজপত্র সাজানোর পর্ব রয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৩৯টি। নিবন্ধিত এ দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকিগুলো নামসর্বস্ব। নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীরও কিছু ভোট আছে। এই ৪টি দলই বেশিরভাগ ভোটের ভাগীদার। এর বাইরে দুয়েকটি ইসলামি দলের কিছু পকেট ভোট আছে।
কিছু একটার আভাসে ও মদদে ওইসবের বাইরে অর্ধশতের মতো আচানক দল সম্প্রতি বেশ পুলকে। ১৯৮৮ সালের পর ২০১৪ সালের নির্বাচনেও এ ধরনের কিছু দলের কয়েক নেতার ভাগ্য খুলেছে বাংলা সিনেমার মতো ঘটনায়। কেবল সংসদ সদস্য নন, মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত জুটেছে তাদের ভাগ্যে।
নতুন আবেদন করা বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী, ননপ্রবাসী কল্যাণ দল, বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, ফরওয়ার্ড পার্টি, জাতীয় লীগ, সর্বজনীন দল, গজো, স্বদেশ কল্যাণ কর্মসূচি, বেকার সমাজ-বাবেস, নৈতিক সমাজ তো আছেই; বাংলাদেশ হিন্দু লীগ, আমজনতা পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, জনমত পার্টি, বাংলাদেশ গরীব পার্টি, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ গ্রিন পার্টি, ন্যাশনাল গ্রিন পার্টি, সর্বজনীন দল, বঙ্গবন্ধু দুস্থ ও প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদও বাদ পড়েনি। বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি নামে পর্যন্ত দল রয়েছে এ তালিকায়।
বলা হয়ে থাকে, নামে কিছু আসে-যায় না। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন বা কুচকুচে কালো কারো নাম সাদা মিয়া রাখলে কারো বাধা দেওয়া মানায় না। মানুষের ক্ষেত্রে নামকরণের এমন স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু, কোনো রাজনৈতিক দলের নাম নিয়ে এ ধরনের মশকরা বেমানান। এগুলোর বেশিরভাগেরই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশে। রাজধানীর বাইরেও আছে কয়েকটির ঠিকানা।
আজগুবি ধরনের নাম 'বৈরাবৈরী পার্টি' নামের একটি দলও রয়েছে। আবেদনে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার আজগানা ইউনিয়নের কুঁড়িপাড়া গ্রামে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় উল্লেখ করা হলেও, ওই গ্রামের কেউ জীবনে এ দলের বা এ ধরনের অন্য কোনো নামও শোনেননি। নামে কি-ই বা যায় আসে— এ মানসিকতা দলগুলোর নেতাদের অনেকের।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের তামাশার সাহস কে দিয়েছে তাদের? লক্ষণ কিন্তু বড় খারাপ বার্তা দিচ্ছে। নামেই যখন এ দশা, সামনে তাদের দিয়ে কোনো 'খোঁয়াড়' সাজালে কোন পরিণতিতে যাবে, তা সবার আগে ভাবতে হবে রাজনীতিবিদদেরই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments