কমলা দাসীদের দুঃখ কি এ বছর যাবে
সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় ৬৯ বছর বয়সী নারী কমলা দাসী প্রায় ৩৫ বছর আগে বিধবা হয়েছেন এবং গত ১৫ বছর ধরে তিনি বিধবা ভাতা পাচ্ছেন। প্রথম দিকে ভাতা পেতেন ২০০ টাকা। এখন পান ৫০০ টাকা।
বাল্য বয়সেই কমলার বিয়ে হয় পাগলা দাসের সঙ্গে, যিনি আগে আরও ৪টি বিয়ে করেন এবং ৪ জনই ১টি করে ছেলে রেখে মারা যান। প্রথম ৪ স্ত্রী মারা যাওয়ার পরই কমলার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পাগলা দাসের মৃত্যুর পর নিজের মেয়ে ও ৪ সৎ ছেলেকে নিয়ে তার সংগ্রাম শুরু হয়। কোনো রকম স্বাক্ষরজ্ঞানহীন কমলা দিনমজুরি ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়ে ও ৪ ছেলেকে নিয়ে জীবন যাপন করতে থাকেন। ছেলেরা বড় হলে কমলা দাসীকে তাদের বাবার কুঁড়ে ঘরে রেখে নিজেরা আলাদা সংসার করে। মেয়েকে বিয়ে দেন। ৩ বছর আগে সেও মারা গেলে কমলা একা হয়ে পড়েন। খাবার, পোশাক ও থাকার জায়গা জোগাড় করাই তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন।
কমলা দাসীর মতো দুঃস্থ নারীদের জন্য সরকারের একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে, যার নাম 'বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা'। এটি বাংলাদেশে বর্তমানে যে ১১৫টি প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলোর একটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর বাজেট ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ কর্মসূচি থেকে ৫৭ লাখ নারী উপকার পাচ্ছেন।
নতুন বছরে এ কর্মসূচির বাজেট ও উপকারভোগীর সংখ্যা আগের বছরের মতোই। অর্থাৎ বর্তমান অর্থবছরে উপকারভোগীর তালিকায় কোনো নতুন নাম যোগ হয়নি। এটি বেশ খারাপ খবর যে বিধবা ভাতা নামে অধিক পরিচিত এ ভাতায় নতুন কোনো নাম চলতি বছরে আর যোগ হচ্ছে না। অথচ অনেক বিধবা ও দুঃস্থ নারীর জন্য এ ভাতা খুব দরকার। জানা গেছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর যে ৮টি নগদ অর্থ প্রদানকারী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্পাদন করে, বয়স্ক ভাতাসহ সেসবের ৬টিতে নতুন নাম সংযোজন বন্ধ রেখেছে।
আর যারা তালিকায় আছেন, তারা যা পান, তা যৎসামান্য। মাসে ৫০০ টাকা দিয়ে কমলা দাসীর মতো একজন নারী কী করতে পারেন? এই বৃদ্ধ বয়সে ওষুধের পেছনেই তাকে মাসে ৮০০ টাকার মতো খরচ করতে হয়। কমলা বলেছেন, মাসে যদি ৩ হাজার টাকা পেতেন, তবে তাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু এখন যে টাকাটা পান, তা কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
কমলা দাসীর মতো লাখো নারী আছেন, যারা এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাচ্ছেন না। তালা উপজেলার খেসড়া ইউনিয়নের ৪৮ বছর বয়সী নূরজাহান তাদেরই একজন। ৩ ছেলে-মেয়ে রেখে তার স্বামী মারা গেছেন ২০০৫ সালে, যাদের বয়স এখন ২৩ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদে অনেকবার গিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কখনো বিধবা ভাতার জন্য কার্ড করতে পারেননি। কেউ তার কাছে ঘুষ না চাইলেও তার ধারণা, যদি তিনি কিছু খরচ করতে পারতেন, তবে ভাতা প্রদানের জন্য যারা তালিকা করেন, তারা তার দিকে নজর দিতেন।
নূরজাহান কৃষিশ্রমিক এবং ১ শতক জমির ওপর তার ভিটে। তিনি তার আশেপাশের অনেককে চেনেন যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভালো অথচ বিধবা ভাতা পাওয়ার তালিকায় তাদের নাম আছে। তিনি যা বলছেন, তার মানে হলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য যারা নির্বাচিত হচ্ছেন, তাদের অনেককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা ভুল করে উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যা সরকারি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।
মাঠ অনুসন্ধান ও কেস ডকুমেন্টেশন থেকে অনেক জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে এমন অনেকে উপকার পেয়েছেন, যাদের পাওয়ার কথা নয়। উপকারভোগী নির্বাচনে এমন ভুলের কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ছেন। কারণ প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিটি কর্মসূচির জন্য উপকারভোগীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সাতক্ষীরাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উত্তরণের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৪২ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে উপকার পায় না। এতে উপকারভোগী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার অবস্থাটা আঁচ করা যায়।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং বাদ পড়া নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন সব পরিবারের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশের মাথাপিছু আয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের আয়ের দ্বিগুণ। যেসব কারণে এমন অনিয়ম হচ্ছে, তার মধ্যে উপকারভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনা, দক্ষতার অভাব, দুর্বল শাসন, জটিল প্রশাসন, দায়বদ্ধতার অভাব ও দুর্নীতি অন্যতম। এসবের মধ্যে আবার প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত, বাদপড়া ও ভূমিহীন গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্ভুক্তিতে ঘাটতি বেশি।
বিগত বছরগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা সামগ্রিকভাবে বাড়লেও বাজেটের একটা বড় অংশ যাচ্ছে যারা দরিদ্র নয় এমন মানুষের কাছে। যেমন: ২০২১-২০২২ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ৬ লাখ ৩০ হাজার সরকারি কর্মচারীর অবসর ভাতা এবং ২ লাখ ১৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভাতা, সম্মানী ও চিকিৎসা বাবদ প্রদান করা হয়েছে। একই অর্থবছরে এই বাজেট থেকে ১০ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (কুটির শিল্পসহ) জন্য ভর্তুকি দিতে। বিশ্বব্যাপী অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
বিভিন্ন সূত্রমতে, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মোট বাজেট থেকে দরিদ্র নয় এমন মানুষের হাতে যেসব সুবিধা যাচ্ছে, তা যদি বাদ দেওয়া হয়, তবে জিডিপির ১ শতাংশেরও কম যায় দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে কাগজে কলমে তা জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ। পিছিয়ে পড়া মানুষ, তা সে হোক ভূমিহীন, দুঃস্থ নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সামাজিকভাবে অচ্ছুত, দরিদ্র অথবা হতদরিদ্র, বাজেটে এ ধরনের বরাদ্দ তাদের কারোরই কাম্য নয়।
হরিজন, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত চা-শ্রমিক, হিজড়া, বেদে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতি ও পেশাগত সম্প্রদায় ও এই অঞ্চলের খাদ্য সহায়তা পায় এমন সব জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৮ রকম সুবিধা বরাদ্দ আছে। এই বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-২০২২ সালে ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা, যা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের দশমিক ৯৩ শতাংশ। উপকারভোগীর প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় এই বরাদ্দের পরিমাণ অনেক কম। তাই কিছু সাহায্য পেলেও তা মোটেও যথেষ্ট নয়। এসব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজমান দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ও আধুনিক দাসত্ব থেকে তাদের বের করে আনতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।
আধুনিক দাসত্বের জালে আটকে পড়া যৌনকর্মী, যারা প্রতিনিয়ত চরম সহিংসতা, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হন, তাদের জন্য বাজেটে আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। পুনর্বাসনসহ নিজেদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য একটি আলাদা কর্মসূচির দাবি তাদের। এমন দাবি অযৌক্তিক নয়, বরং যথাযোগ্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের ১১টি যৌনপল্লী, বিভিন্ন হোটেল, বাসা-বাড়ি ও রাস্তায় কর্মরত প্রায় ১ লাখ যৌনকর্মীর অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক। সন্তানদের শিক্ষার জন্যও প্রয়োজন সাহায্যের। এমন মানবেতর জীবনযাপন সত্ত্বেও তারা আমাদের সমাজের কারো বিবেচনায় আসেন না, থেকে যান নজরের বাইরে।
আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ভূমিহীন অথবা কার্যত ভূমিহীন। খাস জমি ও ভূমিহীন জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা যেসব তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে, তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের মোট পরিবারের প্রায় ৭৭ শতাংশ হয় সম্পূর্ণ ভূমিহীন অথবা ভাড়া নিয়ে অন্যের জমি ব্যবহারকারী এবং ৫ শতাংশ ভূমির মালিকানা আছে এমন।
একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সেখানকার দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমির মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশে ৩৩ লাখের মতো সরকারি খাস জমি রয়েছে, যা ভূমিহীন মানুষের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব। এর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে একটি আলাদা কার্যক্রম চালুর প্রস্তাবও ইতোমধ্যে সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে। এরকম বিশেষ কার্যক্রম দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের আদর্শ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
সামনের দিনগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও কার্যকরী করে তোলার অনেক বড় দায়িত্ব এখন সরকারের। একদিকে সরকারকে যেমন এসব কর্মসূচির যথার্থ বাস্তবায়নে বিভিন্ন অনিয়ম দূর করতে হবে, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনসংখ্যার ওপর সুষ্ঠু তথ্যভাণ্ডার তৈরি এবং উপকারভোগীর একটি বাস্তব ও প্রকৃত তালিকা নির্ধারণ করতে হবে, এর পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের অবসর ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ— এই কার্যক্রমগুলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে আলাদা করতে হবে, যেন প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত উপকারভোগীর অন্তর্ভুক্তি ও প্রাপ্ত ভাতার পরিমাণ সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি পায়।
এই মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত প্রকৃত উপকারভোগীর অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে। এই উদ্দেশ্যে যত দ্রুত সম্ভব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কেবল তখনই বাংলাদেশের পক্ষে তার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়নের যে মূল উদ্দেশ্য, 'অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতি গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে মানবিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের মানুষের কল্যাণ সাধন', তা অর্জন করা সম্ভব হবে।
তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে লেখককে সাহায্য করেছেন ফাহমিদা আফরোজ নাদিয়া, মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও সাবরিনা মিতি গাইন।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের (সেড) পরিচালক
Philip.gain@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments