খেলা: ইনডোরে জাপা, আউটডোরে কারা
ব্যাংককে টানা ৫ মাস চিকিৎসা শেষে রোববার দুপুরে দেশের মাটিতে পা রেখেই সাবেক ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদের ঘোষণা— সামনের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, জাপার ওপর অনেক অত্যাচার করেছে বিএনপি। মামলায় জেলে দিয়েছে এরশাদসহ অনেককে। জাপাকে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়নি।
তাহলে কার সঙ্গে জাপার জোট হবে? তার জবাব, সেটা সময়ই বলে দেবে। কখন বা কবে হবে ওই সময়টা? এ প্রশ্ন করেননি গণমাধ্যম কর্মীদের কেউ। জবাবও দিতে হয়নি জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদকে।
রাজনীতির ময়দানে 'খেলা হবে, খেলা হবে'র রঙ্গভরা বাজনা বাজানো হলেও খেলাটি 'হবে'র পর্যায়ে নেই। তা হচ্ছে, চলছে। শুরু হয়েছে আরও আগেই। রাজনীতির বাঁকবদল জানাশোনাদের উপলব্ধি হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের অনেক দিনের বোঝাপড়ার বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ইনডোরের হাউকাউ ওই খেলারই একটি ছোট অংশ। নির্বাচন সামনে রেখে দলটিকে দিয়ে আরও খেলা ও খেলানোর স্লট-মাঠ সবই প্রস্তুত। বেগম রওশন এরশাদের আগমন ও একটি স্ক্রিপ্ট পাঠও এই খেলার বাইরে নয়।
তাকে স্বাগত জানাতে কয়েকদিন আগে বহিষ্কৃত মশিউর রহমান রাঙ্গাই কেবল বিমানবন্দরে যাননি, রওশনবিরোধী বলে প্রচারিত আরও কয়েকজন গেছেন। কেউ পাশে থেকেছেন, কেউ সালাম দিয়ে একটু দূরে সরে গেছেন ক্যামেরার আউট অব ফোকাসে। রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, বহিষ্কৃত জিয়াউল হক, গোলাম মসীহসহ উপস্থিত নেতাদের গত কয়েকদিনের গতিবিধি ও ভূমিকা অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
তবে, রওশন এরশাদকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে ফোনে দলের অনেককে নিষেধ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রাঙ্গা। তিনিই দিন কয়েক আগে রংপুরে এরশাদের কবর সামনে রেখে বলে এসেছেন, জাপায় দেবর-ভাবির বিভেদ শিগগির কেটে যাবে। আবার সবাই এক হয়ে যাবেন। রওশনও এ বার্তাই দিয়েছেন।
রওশনকে দিয়ে শুধু এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সংগঠিত নয়, বিভিন্ন সময়ে এ পার্টি ছেড়ে যাওয়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জু, কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে চলে যাওয়াদেরও নিয়ে আসার একটি এজেন্ডা এগোচ্ছে। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার নেতৃত্ব নিয়ে ছোট ভাই জি এম কাদের ও ভাবি রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার পুরোটাই ছিল বৈষয়িক; নৈতিক বা রাজনৈতিক নয়। এরশাদের সম্পদ-সম্পত্তি, দলীয় শক্তির মালিকানার এ বিরোধ পরে মিটমাট হয় জি এম কাদের জাপার চেয়ারম্যান ও রওশন এরশাদকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ ভাগের মধ্য দিয়ে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা ও শক্তির হালখাতা মেলাতে এরশাদকে নানা সুবিধা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কেউ বেশি সফল হয়েছে, কেউ কম। এরশাদ ও তার পার্টিকে নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় 'হাতিয়ার' ছিল তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো। পতনের পর তার বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা হয়। কয়েকটিতে তাকে নিম্ন আদালত থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। কয়েকটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ৩টিতে নিম্ন আদালতে সাজার আদেশ হলেও হাইকোর্ট থেকে একটিতে খালাস পান। সাজা খাটেন বাকি ২টি মামলায়। জীবনের শেষ দিকে এরশাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় মঞ্জুর হত্যা মামলা। জোট আর ভোটের রাজনীতির সমীকরণে এরশাদের সমর্থন পেতে তুরুপের তাস হয়ে পড়ে মামলাটি।
এরশাদের মৃত্যুর পরও আজ এদিক, কাল সেদিক করার রাজনীতিতে সক্ষমতা দেখিয়ে আসছিল জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিত্ব নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের, সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বা বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বেশি বেনিফিসিয়ারি হয়েছেন। ভাগে-যোগে কিছু না কিছু হাছিল হয়েছে অন্য আরও কারো কারো। একেবারে বঞ্চিতরা খেপেছেন। আবার মেনেও নিয়েছেন। না মানলে বহিষ্কার হয়েছেন। বাস্তবতা বুঝে শীর্ষ নেতাদের সম্পৃক্ততায় দলের আশপাশেই থাকছেন বহিষ্কার প্রত্যাহারের অপেক্ষায়। তারা জানেন, এ পার্টিতে বহিষ্কার এবং বহিষ্কার প্রত্যাহার অনেকটা স্বাভাবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া। রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরেরও জাপা থেকে বহিষ্কার করার ঘটনা রয়েছে।
এরশাদের জীবদ্দশায়ও মাঝেমধ্যে জাপায় স্বামী-স্ত্রী, দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব বাঁধলেও তা খোলা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলসহ নানা পক্ষীয় মুসাবিদায়। রওশন এরশাদ অসুস্থ হয়ে পড়ায় খটকা একটু বেশি পাকতে থাকে। গত জুনে রওশন এরশাদ একবার চিকিৎসাধীন অবস্থার মধ্যেই ব্যাংকক থেকে ঢাকা এসে তার একান্ত সমর্থকদের বল-ভরসা দিয়ে চলে গেছেন। বলে গেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনো তিনি গুলশানের নিজের বাসায় না উঠে ওয়েস্টিন হোটেলে থাকেন। সেখান থেকেই গত ৫ জুলাই তিনি আবার চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক যান। রোববার আবার ফিরে ওই হোটেলেই থাকছেন।
একদিকে নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে খেলার হুঁইসেল, আরেক দিকে জাপায় বিভক্তি, সাবেক মহাসচিব রাঙ্গাকে অব্যাহতি, নেতৃত্ব নিয়ে মামলাবাজি, এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার উৎপাত, এরশাদ ট্রাস্টের সম্পত্তি রক্ষাসহ এক জটিল সময়ে দেশে এলেন রওশন এরশাদ। এর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির আউটডোরের খেলার বিষয়-আসয়ের সংযোগও অনেকটা স্পষ্ট। এ রকম সময়ে 'ঝিম মেরে যাওয়া'র মতো অবস্থান নিয়েছেন জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
জাপার বহিষ্কৃত নেতা জিয়াউল হকের করা এক মামলায় গত ৩০ অক্টোবর আদালত জাপার চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। যদিও আজ জি এম কাদেরের নিষেধাজ্ঞা ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই জাপার সব কার্যক্রমের ওপর বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি মামলা হয়েছে।
এসব আদালতি কাণ্ডকীর্তির আগে-পিছে, ডানে-বামের ঘটনা জানা এবং সিদ্ধহস্ত জিএম কাদের কৌশলী ভূমিকায় নেমেছেন। জাপার উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে তাকে সরতে হবে না, পারিবারিক এবং অর্থ-সম্পদসহ নানা কারণে তাদের মধ্যে আবার মিলমিশ হয়ে যাবে তা তিনি নিশ্চিত। এই টম অ্যান্ড জেরিতে কেবল দেবর জিএম কাদের, ভাবি রওশন বা ভাগ্নে রাঙ্গা নন, জাপার বাদবাকিরাও একেবারে কম পাকা নন। তা হাজির-নাজির জেনেই চলে তাদের ইনডোর-আউটডোর রাজনীতি।
ক্ষমতাকালেই জেনারেল এরশাদের নানা গুনাগুণ ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' শিরোনামে কার্টুন এঁকে ঝড় তুলেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। বেহায়াপনার পরম্পরা এরশাদের গড়া দলটিতে অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকতার মতো। ভাই, স্ত্রী, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী, প্রতিবন্ধী ছেলে, পালক পুত্র, ধর্মকন্যা ছাড়াও এতে সংক্রমিত দলটির অনেকে। নেতাদের সমান্তরালে তা কর্মী পর্যায়েও। একেক সময় একেক কথা এবং সিদ্ধান্ত পাল্টানো, বিভেদ, বিভেদের পর মিলে যাওয়াসহ কিছু কাজে এরশাদের যোগ্য অনুসারিত্বের বেশ ছাপ তাদের মধ্যে। তারাই দেশের জাতীয় সংসদের বিরোধী দল। এটাই বাস্তবতা!
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments