দুর্গাপূজা: মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোত্সব। এই দুর্গোত্সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রধান উৎসব। রাজা সুরথের দুর্গাপূজা করার কথা বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ থাকলেও ১৬১০ সালে কলকাতার রাজা সাবর্ণ রায় চৌধুরী সপরিবারে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। সেই প্রচলিত ধারায় দুর্গাপূজা সর্বজনীনতা পায়।
শারদীয় দুর্গোত্সবের তিন পর্ব যথা—মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ সাঙ্গ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা শুরু হয়। এদিন থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে অধিষ্ঠান করেন মা মহামায়া।
এই দিন চণ্ডী পাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে আবাহন জানানো হয় মর্ত্যলোকে। আর চণ্ডীতেই দেবী দুর্গার সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিশদভাবে বলা আছে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মহালয়া। মহালয়ার পরে মহাষষ্ঠী বা বোধনের মধ্য দিয়ে মূল দুর্গোৎসবের শুরু।
মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা। মায়ের মতোই তার আবির্ভাব ও ভূমিকা। এ জন্যই তিনি সকলের মা দুর্গা। প্রতিবছর শরৎকালে হিমালয়ের কৈলাশ ছেড়ে দুর্গা দেবী মর্ত্যে আসেন। ভক্তদের কল্যাণ সাধন করে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টিকে পালন করেন। তার সঙ্গে থাকেন জ্ঞানের প্রতীক দেবী সরস্বতী; ধন ও ঐশ্বর্যের প্রতীক দেবী লক্ষ্মী; সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বলবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক কার্তিক।
শরৎকাল দক্ষিণায়নের সময়। দেবতাদের রাত্রিকাল। তাই শরৎকাল পূজার্চনার উপযুক্ত কাল নয়। অকালে দেবতার পূজা করতে হলে তাকে জাগরিত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় 'বোধন'।
মহাশক্তির মহাপূজার সূচনা হয় বোধনের মধ্য দিয়ে। দেবীপক্ষের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে উদবোধিত করা হয়। ষষ্ঠীতে দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাঁচ দিনের পূজার আনুষ্ঠানিকতা।
মূল প্রতিমায় দেবীর রূপ কল্পনা করে আট উপাচারে অর্থাৎ দেবীর অধিবাসের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠী পূজায় ভক্তরা দেবীবন্দনা শুরু করেন। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, দেবীর পূজার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে বসন্তকাল। চৈত্রমাসের শুক্লাষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীর বাসন্তী পূজার রীতিও প্রচলিত আছে।
২.
মহাসপ্তমীতে ষোড়শ উপাচারে অর্থাৎ ষোলটি উপাদানে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের এই দিন সকালে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হয়। সকালে দেবীকে আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, স্নানীয়, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে ভক্তরা পূজাঅর্চণা করেন।
সপ্তমী পূজার উপকরণে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সকল পূজার অনুরূপ সবধরনের উপঢোকন প্রয়োজন হয়। একশ আট প্রকার দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে নব পত্রিকা স্নান অন্তে দেবীকে আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। স্থাপন ও সপ্তাদি কল্পারম্ভ, দেবীর পায়ে ভক্তদের অঞ্জলি প্রদানসহ নানা আয়োজনে মহাসপ্তমী পূজা উদযাপিত হয়।
সকালে কুমারী পূজা, অঞ্জলি প্রদান ও রাতে সন্ধি পূজার মধ্যে দিয়ে মহা অষ্টমী পূজা পালিত হয়। সনাতনশাস্ত্রে নারীকে শক্তি আর সমৃদ্ধির প্রতীক বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে নারী চিরন্তন শুদ্ধতার প্রতীকও। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূতপবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন। পৃথিবীতে সব নারীর মাঝেই মায়ের রূপে বিরাজ করেন দেবী দুর্গা। আর সেই দেবীকে সম্মান জানাতেই অষ্টমীতে আয়োজন করা হয় কুমারী পূজার।
কুমারী পূজার ১৬টি উপকরণ দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত। শুরুতেই গঙ্গাজল ছিটিয়ে 'কুমারী মা'কে পরিপূর্ণ শুদ্ধ করে তোলা হয়। এরপর 'কুমারী মা'র চরণযুগল ধুয়ে তাকে বিশেষ অর্ঘ্য প্রদান করা হয়। অর্ঘ্যের শঙ্খপাত্রকে সাজানো হয় গঙ্গাজল, বেল পাতা, আতপ চাল, চন্দন, পুষ্প ও দূর্বাঘাস দিয়ে। অর্ঘ্য প্রদানের পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য। এরপর অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বায়ু—এই পাঁচ উপকরণ দেওয়া হয় 'কুমারী' পূজাতে।
শাস্ত্রমতে, কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে কুমারী পূজার উদ্ভব। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সেই সব দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।
হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, সাধারণত এক বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজা করার উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে।
বয়সভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন। শাস্ত্রমতে; এক বছর বয়সের কন্যাকে বলা হয় 'সন্ধ্যা', দুইয়ে 'সরস্বতী', তিনে 'ত্রিধামূর্তি', চারে 'কালিকা', পাঁচে 'সুভগা', ছয়ে 'উমা', সাতে 'মালিনী', আটে 'কুব্জিকা', নয়ে 'অপরাজিতা', দশে 'কালসন্ধর্ভা', এগারোতে 'রুদ্রাণী', বারোতে 'ভৈরবী', তেরোতে 'মহালক্ষ্মী', চৌদ্দতে 'পীঠনায়িকা', পনেরতে 'ক্ষেত্রজ্ঞা' এবং ষোলতে 'অম্বিকা' বলা হয়ে থাকে। অষ্টমী পূজার দিন জবরদস্তি ও অকল্যাণের প্রতীক মহিষাসুর বধের চূড়ান্ত পর্যায়। এই তিথিতে শান্তি ও কল্যাণ কমনা করে অষ্টমী পূজা শুরু হয়।
শাস্ত্রমতে, নবমী পূজার মাধ্যমে মানবকুলে সম্পদলাভ হয়। শাপলা-শালুক ও বলিদান সঙ্গে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নবমী পূজা পালিত হয়। শাস্ত্রমতে, নবমীতেই দেবী বন্দনার সমাপ্তি। তাই ভক্তরা প্রার্থনা করতে থাকেন দেবীর উদ্দেশ্যে। যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়।
ধর্মের গ্লানি আর অধর্ম রোধ, সাধুদের সেবা, অসুরের বধ আর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি বছর দুগর্তিনাশিনী দেবী দুর্গা ভক্তদের মাঝে আবির্ভূত হন। নবমীর উচ্ছ্বাস-আনন্দের পরই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে বিজয়া দশমী।
৩.
বছরের আশ্বিন-কার্তিকের পঞ্চমী থেকে দশমী তিথির পাঁচ দিন 'জগজ্জননী' দুর্গা দেবী পিতৃগৃহ ঘুরে যান। পাঁচ দিনের শারদ উত্সব শেষ হয় বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে। বিজয়া দশমীতে বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা হয়। এই দশমী তিথিই বিজয়া দশমী নামে খ্যাত।
প্রথমে দেবীবরণ। তারপর সিঁদুরখেলা, মিষ্টি বিরতণের মধ্য দিয়ে বিদায়পর্বের সূচনা। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গশিখর কৈলাশে স্বামীগৃহে ফিরে যান। পেছনে ফেলে যান ভক্তদের শ্রদ্ধা ও আনন্দমাখা জল। ভক্তদের কাছে রেখে যান আগামী বছরে ফিরে আসার অঙ্গীকার।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংশনারায়ণ বঙ্গভূমিতে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন করেন। দেবী দুর্গা যেহেতু অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন, তাই তিনি সত্য, শুভ ও ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামকারীদের আজও আদর্শ ও অনুপ্রেরণা দানকারী। দুর্গা অর্থই যিনি দুর্গতি নাশ করেন।
মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু এবং বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে দুর্গোৎসবের ইতি ঘটে।
বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments