‘অভিবাসী কূটনীতি’ ও অর্থ দিয়ে খোঁজা ‘কলাম লেখক’
সরকার শুরু করতে যাচ্ছে 'অভিবাসী কূটনীতি'। বিদেশে বসবাসরত প্রবাসী ও অভিবাসী বাংলাদেশিদের 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা' মোকাবিলা ও ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে অভিবাসী কূটনীতির লক্ষ্য।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের কাছে অনেক ইতিবাচক তথ্য আছে, কিন্তু লেখক নেই। ফলে তারা ভালো 'কলাম লেখক' খুঁজছে, যাদেরকে সম্মানী দিয়ে লেখানো হবে।
'নেতিবাচক প্রচারণা' মোকাবিলায় কেন 'অভিবাসী কূটনীতি', কেনই বা 'কলাম লেখক' খোঁজা—সেই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা ও প্রশ্ন।
১. দেশের বাইরে অবস্থান করে 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা' চালাচ্ছেন বলে যাদের কথা বলা হচ্ছে, তাদের সংখ্যা ৫-৭ জনের বেশি নয়। দু-একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ফেসবুক ও ইউটিউব নির্ভর তাদের প্রচার-প্রচারণা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, নির্বাচনের আগের দেড় বছরে 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা' আরও অনেক বাড়বে। তা মোকাবিলায় 'অভিবাসী কূটনীতি' শুরু করা হচ্ছে।
যিনি যে দেশে থেকে 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা' চালাচ্ছেন, তার বিষয়ে তথ্য দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষকে। অনুরোধ করা হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। অর্থের বিনিময়ে 'কলাম লেখক'দের লেখায় তুলে ধরা হবে সরকারের ইতিবাচক দিক। এসব লেখা কোথায় প্রকাশিত হবে, দেশে না বিদেশের গণমাধ্যমে, যদিও তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি।
ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে সরকার একটি চুক্তি করেছিল।
'বাংলাদেশের সাফল্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরে "মেড ইন বাংলাদেশ" ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়ালের (সিএনএনআইসি) সঙ্গে একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি করেছে সরকার।' (দ্য ডেইলি স্টার, ২ জুন ২০২১)
এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক দিক তুলে ধরা। কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় ও লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছিল, সে বিষয়ক কোনো তথ্য আর জানা যায়নি।
২. বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে সরকারি বিটিভি দেখা যায়। বিটিভি শুধু সরকারের ইতিবাচক প্রচার-প্রচারণাই করে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে বিটিভি সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রতিদিন বিটিভির একাধিক টকশোতে সরকারের উন্নয়ন-ইতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়। বিটিভির সংবাদ স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকেও প্রচার করতে হয়।
দেশে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংখ্যা প্রায় ২৫টি। প্রায় সবগুলো টেলিভিশনেই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়। প্রতিটি টকশোতে সরকার দলীয় ও সমর্থকের সংখ্যা বিরোধী মতের চেয়ে কম থাকে না। ২ জন আলোচক থাকলে, একজন অবশ্যই সরকার দলীয় নেতা বা সমর্থক থাকেন।
প্রশ্ন আসে, বিটিভিকে দিয়ে কেন ৫-৭ জন ফেসবুক-ইউটিউব নির্ভর 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা'কারীকে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না? তাহলে কি মানুষ এই কয়েকজনের ফেসবুক-ইউটিউব চ্যানেল বিটিভির চেয়ে বেশি দেখছে? এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেলে নেতা-মন্ত্রী-সরকার সমর্থকরা যা বলছেন, তা দিয়েও ৫-৭ জনের ফেসবুক-ইউটিউব চ্যানেলকে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না?
৩. দেশের বাইরে থেকে প্রবাসীদের দ্বারা পরিচালিত যতগুলো অনলাইন পোর্টাল আছে, তার মধ্যে ২-১টি ছাড়া কোনোটিরই দেশে তেমন কোনো অবস্থান নেই। দেশে যতগুলো অনলাইন পোর্টাল এবং ছাপা পত্রিকা ও তাদের অনলাইন সংস্করণ আছে, তাতে ৪-৫টি ছাড়া সরকারের সমালোচনামূলক লেখা কমই প্রকাশিত হয়। কলাম লেখকদের বড় একটা অংশ সরকার সমর্থক। সমালোচনাকারী বা তীব্র সমালোচনাকারী কলাম লেখকের সংখ্যা সম্ভবত ৫-৭ জনের বেশি নয়। তারপরও অর্থের বিনিময়ে কলাম লেখক খুঁজতে হচ্ছে কেন? এত এত কলাম লেখকের উন্নয়নমূলক লেখা যদি মানুষ গ্রহণ না করে থাকে, অর্থ দিয়ে লেখালেই তা গ্রহণ করবে?
৪. উদাহরণের জন্যে একটু পেছনে ফিরি। 'বাংলার বাণী' ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় পত্রিকা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা যদি বাংলার বাণী কিনতেন-পড়তেন, তবে সার্কুলেশন হতো ৩-৪ কোটি। কিন্তু বাংলার বাণী চালানো যায়নি, বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
'দিনকাল' বিএনপির পত্রিকা। প্রকাশনা এখনও অব্যাহত থাকলেও, প্রচার সংখ্যা অতি নগণ্য। বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকরাও দিনকাল কেনেন না, পড়েন না।
কেন এমন অবস্থা? কারণ সত্য ও বাস্তবতা ভিন্ন যা কিছুই লেখা হোক না কেন, সাধারণজন তো নয়ই, দলীয় লোকজনও তা গ্রহণ করেন না। বাংলার বাণী ও দিনকাল তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।
৫. দেশে 'গুম' বা 'নিখোঁজ'র ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, বাবা-মা স্বজনের সন্ধানে রাস্তায় মানববন্ধন করছেন। অবতারণা হচ্ছে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখা গেল, এসব মানুষের বাড়িতে গিয়ে 'গুম' হয়নি, 'নিখোঁজ হয়নি', এমন লিখিত দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।
এর ফলে কি ঘটলো? 'গুম' সংবাদের কারণে সরকার দেশে, দেশের বাইরে যে ইমেজ বা ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছিল, চাপ দিয়ে লিখিত নিতে চাওয়ার ঘটনায় তা আরও বাড়লো।
'অভিবাসী কূটনীতি'র লক্ষ্য যদি হয় 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা'কারীদের দেশবিরোধী তকমা দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ানোর চেষ্টা করা, তবে তা কি সফল হবে? সম্ভাবনা শুধু কমই নয়, নেই বললেই চলে। কারণ সরকার যা বলবে, সংশ্লিষ্ট দেশ যদি তা আমলে নেয়, তবে নিজেরাও অনুসন্ধান করে দেখবে। সেখানে যদি দেখা যায়, ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা সরকারের সমালোচনা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে, তাহলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এমন ধারণা শক্তিশালী ভিত্তি পেয়ে যেতে পারে যে, এরা দেশে কথা বলতে পারেনি, নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিদেশেও তাদের কথা বলতে দিতে চাওয়া হচ্ছে না। উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো দেশ সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনাকে উৎসাহিত করা ছাড়া বন্ধ করতে বলবে বলে মনে হয় না।
সেই ৫-৭ জন সমালোচনাকারী সরকারের ভাষায় 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা'কারী যেসব উন্নত দেশে বসবাস করেন সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে চর্চা করা হয়। এর ফলে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীর কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ সরকার।
৬. আগেই বলেছি সরকারের সমালোচনার চেয়ে পক্ষের কলাম লেখকের সংখ্যা কম নয়, হয়ত বেশিই হবে। টকশোর আলোচক, উপস্থাপকের চিত্রও এর বাইরে নয়। এসব দিয়ে যদি 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা'কারী কয়েকজনকে মোকাবিলা করা না যায়, তবে অর্থের বিনিময়ে কলাম লিখিয়ে তা করা যাবে? বিদেশের পত্রিকায় যদি অর্থের বিনিময়ে সেসব কলাম প্রকাশ করাও হয়, তা কি বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে? সিএনএনের সঙ্গে চুক্তি কি কোনো কাজে এসেছিল?
'অভিবাসী কূটনীতি' দিয়ে যা করতে চাওয়া হচ্ছে, বিদেশের দূতাবাসগুলো যে তা একেবারে করছে না, তা নয়। দেশের বিপুল অর্থ ব্যয়ে সরকার বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিল, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির জন্যই। তা কি সফল হয়েছে? উত্তর আর যাই হোক, হ্যাঁ বলার সুযোগ নেই। সত্য ও বাস্তবতা ভিন্ন কোনো কিছু মানুষ সাধারণত গ্রহণ করে না। নিরব থাকলে বা বিএনপি আমলে সৃষ্টি বললেই 'আয়না ঘর' মানুষের মন থেকে মুছে যায় না। দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, সুশাসন থাকলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইন না থাকলে 'নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা' বা ভাবমূর্তি বা ইমেজ সংকট নিয়ে সরকারকে এত চিন্তায় পড়তে হতো না।
mortoza@thedailystar.net
Comments