জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ঝুঁকিতে তৈরি পোশাক শিল্প
বিশ্ব বাজারে আকাশছোঁয়া জ্বালানি তেলের দামের অজুহাত দেখিয়ে হঠাৎ করে দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে পঞ্চাশ শতাংশের ওপরে বাড়ানো হয়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে এখন তেলের দাম নিম্নমুখী। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সামনের দিনগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি এবং রপ্তানি খাত কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয় সেই হিসাব-নিকাশ করেছেন। তাদের হিসাবের বিপরীতে কৃষি এবং রপ্তানি সংশ্লিষ্টদের বা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হিসাব কি মিলবে?
একটু দেখে নেওয়া যাক এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন। জ্বালানি তেলের মজুদ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, 'ডিজেল আমাদের কিনতে হয় এটা ঠিক, কিন্তু অকটেন আর পেট্রল আমাদের কিনতে হয় না। আমরা যে গ্যাস উত্তোলন করি সেখান থেকে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে রিফাইন করা পেট্রল পাই, অকটেনও পাই। বরং যতটুকু চাহিদা তার থেকে অনেক বেশি পেট্রল এবং অকটেন আমাদের আছে। এগুলো অনেক সময় বাইরে বিক্রিও করি।'
দেশের প্রধানমন্ত্রী কোন অবস্থাতেই অসত্য তথ্য দেন না। তার বক্তব্য ১০০ ভাগ বিশ্বাস করি আমরা।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী দেশে পেট্রল-অকটেন পরিশোধিত অবস্থায় বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া যায়। পরিশোধনের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় না। প্রশ্ন আসে, দেশে পেট্রল-অকটেন উৎপাদনে গ্যালন প্রতি খরচ তাহলে কত? পেট্রোবাংলা এবং বিপিসির ওয়েবসাইট ঘেঁটে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নানা মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে অন্যান্য দেশের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনে খরচের একটা ধারণা পাওয়া যায়। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি আমেরিকায় আর সর্বনিম্ন খরচ হয় রাশিয়ায়। মধ্যপ্রাচ্যের খরচ অনেকটা এই বড় দুই দেশের মাঝামাঝি পর্যায়ে। রয়টার্সের তথ্যমতে রাশিয়ায় প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের উত্তোলনের খরচ ৩-৪ ডলার। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে মধ্যপ্রাচ্যে ১০-২০ আর আমেরিকায় ৩০-৩৫ ডলার ব্যারেল প্রতি খরচ হয় অপরিশোধিত তেল উত্তোলনে।
রাশিয়ায় তেল উত্তোলনের খরচ পানির চেয়ে সস্তা, যদি আমরা ফ্রেঞ্চ ব্র্যান্ড ইভিয়ানের সঙ্গে তুলনা করি। এ কারণে রাশিয়া তার বন্ধু দেশ চীন এবং ভারতকে বিশ্ব বাজারে আকাশ ছোঁয়া দামের (১৪০ ডলার প্রতি ব্যারেল) সময়েও ৩০ থেকে ৪০ ডলার দরে তেল সরবরাহ করেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা তখন বলছিলেন, রাশিয়া যদি ২৫-৩০ ডলারেও প্রতি ব্যারেল তেল বিক্রি করে তাতেও তাদের যথেষ্ট মুনাফা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ আমেরিকার ভয়ে রাশিয়া থেকে ছাড় দেয়া মুল্যে তেল আমদানিতে উৎসাহ পায়নি নাকি ব্যাংকিং চ্যানেলে মূল্য পরিশোধের জটিলতা অথবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সরবরাহ চুক্তির বাধ্যবাধকতা আছে কিনা, প্রকাশ করেনি।
তবে উত্তোলন খরচের সঙ্গে পরিশোধন এবং সরবরাহ খরচ ও মুনাফা হিসাব করেই জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ হয়। ধরা যাক বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান আমেরিকার মতোই। ন্যূনতম মজুরিও আমেরিকার মতো এবং তেল উৎপাদন খরচ আমেরিকার সমান। আরও ধরে নিলাম, সিলেটের গ্যাসক্ষেত্র থেকে তোলা জ্বালানি তেল পরিশোধিতও নয়। সেই তেল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করে বিক্রি করা হয়। তাহলে এর উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্য কত হওয়া যৌক্তিক?
জ্বালানি বিষয়ক সাইটগুলো থেকে পাওয়া তথ্য মতে, দেশ অনুযায়ী পরিশোধন খরচ গ্যালন প্রতি সর্বনিম্ন ০.৪০ থেকে সর্বোচ্চ ০.৭০ ডলার। সাথে পরিবহন ও বিপণন খরচ, ট্যাক্স এবং অন্যান্য খরচসহ প্রতি গ্যালন সর্বনিম্ন ০.২৭ থেকে সর্বোচ্চ ০.৪৯ ডলার ধরা হয়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ উত্তোলন, পরিশোধন ও বিপণন খরচ যোগ করলে বাংলাদেশের উৎপাদিত অকটেনের দাম লিটারে ০.৪৮ ডলার অর্থাৎ ৪৮ টাকার বেশি হওয়ার যুক্তি নেই। আর এখনকার বাজার অনুযায়ী ৯০ ডলারে প্রতি ব্যারেল আমদানি করলে লিটারে ০.৮৫ ডলার বা ৮৫ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। এই খরচ ডিজেলে ও কেরোসিনের জন্য প্রযোজ্য নয়। ওগুলোর পরিশোধন খরচ অনেক কম। তবে পরিবহন খরচ অকটেন, পেট্রলের চেয়ে একটু বেশি।
বিপিসি প্রচুর লোকসান দিয়েছে এক সময়। তারা আর লোকসান করুক এটা কাম্য নয়। তবে মুনাফার সর্বোচ্চ সীমা কত শতাংশ হওয়া উচিত, এটা নৈতিক প্রশ্ন।
বিপিসি ব্যবসা করছে, মুনাফাও করছে বিগত কয়েক বছর। বিশ্ব বাজারে দাম যখন তলানিতে ছিল তখন তারা দাম কমায়নি। এখন সাময়িক সংকটে দাম বাড়ানোর এই হঠকারী সিদ্ধান্ত মরার উপর খাড়া ঘা এর মতো। অথচ এই সময়ে সরকারের উচিত ছিল পেট্রোবাংলা ও বিপিসির ওভারেহেড কমানো, তেল উত্তোলন ও পরিশোধনের সিস্টেম লস টেনে ধরায় গুরুত্ব দেওয়া। তা না করে তারা জনগণের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিলেন এমন সময়ে যখন মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতিতে জীবনমান বিপন্ন।
গত বছর খরায় ফসল ভালো হয়নি। এবার সিলেট ও রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষ বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদন খরচ অসহনীয় পর্যায়ে যাবে নিশ্চিত করে বলা যায়।
এমনিতেই বাজারে আগুন। শ্রমিক, কর্মজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন অতিষ্ট। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খাতে নৈরাজ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকায় প্রভাব পড়বে উৎপাদন খাতেও। বেসরকারি খাতে বেতন বাড়ানোর চাপ এবং শ্রমিক অসন্তোষের ব্যাপক আশঙ্কাও তৈরি হলো।
দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প গত কয়েক মাস ধরে ধুকছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে মন্দার প্রভাবে পোশাক বিক্রি কমেছে। বড় বড় ব্রান্ডগুলো দোকানের পোশাক বিক্রি করতে পারছে না। তাদের গুদামে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাক স্তূপ হয়ে আছে। গুদাম খালি করতে না পেরে তারা আগামী দুই-তিন মাসের শিপমেন্ট পিছিয়ে দিয়েছে। নতুন অর্ডার দিচ্ছে না। এর প্রভাব পড়বে খুব কাছাকাছি সময়ে এমনকি আগামী দুই-তিন মাসের রপ্তানি আয়ে।
গত মাস থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল বিশেষ করে ফেব্রিক মিল ও এক্সসরিজ কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়েছে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহারে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় অনেক ডাইং কারখানাকে ডিজেল বয়লারের মতো ব্যয়বহুল বিকল্পে যেতে হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে তৈরি পোশাক কারখানায় দিনে কয়েক ঘণ্টা ডিজেল জেনারেটর চালাতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বেতন বাড়ানোর যৌক্তিক দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হলে কী করবেন এই খাতের উদ্যোক্তারা?
গত কয়েক মাসে শুধুমাত্র জ্বালানি সংকটেই উৎপাদন খরচ বেড়ে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছিল শিল্পখাত। এর মধ্যে ডিজেলের দাম নাগালের বাইরে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ আরেক দফা বাড়বে।
সাধারণত বাজারে চাহিদা কমে গেলে পণ্যের দাম কমে যায়। পশ্চিমা বড় বড় ব্রান্ডগুলো বিক্রি বাড়াতে, গুদাম খালি করতে এবং ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পণ্যের দাম কমিয়ে দিবে, এটাই স্বাভাবিক। বাজারে বিক্রি মূল্য কমলে ব্র্যান্ডগুলো সামনের দিনগুলোতে সাপ্লাই চেইনের উপর চড়াও হবে। চাপ তৈরি করবে তৈরি পোশাকের দাম কমাতে। অথচ বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এই অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে পোশাক শিল্পকে লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হবে নয়তো অর্ডার ছেড়ে দিতে হবে। সেই সুবিধা নেবে প্রতিযোগী দেশগুলো।
ডলার সংকটের এই সময়ে রপ্তানি খাতসহ দেশের মানুষকে বিপদে ফেলার এই সিদ্ধান্ত একটা রাজনৈতিক সরকার নিতে পারে, ভাবা যায় না। বিপিসিকে ফুলে ফেঁপে ওঠার সুযোগ দিতে গিয়ে মানুষের জীবন বিষিয়ে দেওয়া, রপ্তানি খাতকে ঝুঁকিতে ফেলা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভোটের আশা বা প্রয়োজন থাকলে এমন সিদ্ধান্ত কোনো রাজনৈতিক সরকার নিতে পারে না।
জসিম আহমেদ: চলচ্চিত্র নির্মাতা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments