শ্রীলঙ্কার সংকট ও দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র
একটি আন্দোলন-অভ্যুত্থান যদি উপযুক্ত নেতৃত্ব, সংগঠন, কর্মসূচী ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া হয়, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে তা আবারো প্রমাণিত হলো শ্রীলঙ্কার ঘটনায়।
সম্প্রতি সংগঠিত হওয়া মাসব্যাপী দুনিয়া কাঁপানো সেই আন্দোলন চোরাবালিতে পরেছে। যে তরুণদের নেতৃত্বে রাজপ্রাসাদ, প্রধানমন্ত্রীর বাসা-কার্যালয়, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর দখল করা হলো, দেশ অচল করে দেওয়া হলো তারা আজ আত্মগোপনে যাচ্ছেন, জেলে ঢুকছেন, মামলা ও বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। এমনকি বিদেশ যাওয়ার সময় উড়োজাহাজ থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কে করছে এই কাজ? এই আন্দোলনের সুবিধাভোগী নবনির্বাচিত পতিত শাসকের ঘনিষ্ঠজন রাষ্ট্রপতি রনিলের সরকার।
সাবেক রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন। শুধু তাই নয়, সেখানে তিনি তার অবস্থানের মেয়াদ বাড়িয়েছেন। তার মানে আপাতত তিনি সেখানেই থাকছেন। সেখান থেকে কথিত নতুন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং কলকাঠি নাড়ছেন। অপেক্ষায় আছেন কখন আবার নায়কের মতো দেশে ফিরবেন।
তাহলে কী দাঁড়ালো? আন্দোলনের নায়করা হবেন খলনায়ক, আর অপরাধী, খুনি, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, দেশ ধ্বংসকারীরা হবেন নায়ক ও ত্রাণকর্তা।
বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, দেশটিতে বিরোধী দলগুলো পতিত শাসকের সাজানো ছকে পা দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হচ্ছেন। তারা এই শাসকের বিরুদ্ধে ও আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান নিতে পারলেন না। তাদের দায় মুক্তি নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। যে কারণে শ্রীলঙ্কা সংকট আজ ভিন্ন রূপ নিয়েছে, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সামনের নির্বাচনে বিরোধীরা আবারো বিভক্ত হয়ে পরবে। পতিত শাসকের দল সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার ক্ষমতায় আসবে। যদিও এখনো তাদের দলই ক্ষমতায় আছেন।
বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আপাতত শ্রীলঙ্কাকে কোনো ধরণের আর্থিক সহযোগিতা করছে না। কারণ তারা তাদের প্রত্যাশিত শর্ত ও সংস্কারের কোনো কিছুই এখনো সেখানে করেনি। তার অর্থ এই দরজা বন্ধ। আর আইএমএফ এখনো তাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। এই সংস্থার ঋণ খুব সহজ নয়, পেলেও কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন ডলার। নতুন সরকার বলেছে, তারা আপাতত কোনো ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। কিন্তু ঋণের পূর্ণগঠন (বেল আউট) ছাড়া ঋণপ্রাপ্তি কোনো সাধারণ বা স্বাভাবিক বিষয় নয়। সেটা করতে পারা না পারা এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শিগগির শেষ হচ্ছে না। এর নানামাত্রিক টানাপড়েন চলছে। আসন্ন শীতে সেই সংকট আরও বাড়বে, ঘনীভূত হবে। বিশ্বে খাদ্য, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে সেই ঢেউ শ্রীলঙ্কাতেও এসে পড়বে। তখন দেশটি আবার বড় বিপর্যয়ে পরতে পারে, আবার জনবিক্ষোভ তৈরি হতে পারে। কেননা নতুন সরকার নিয়ে জনমনে ক্ষোভ-অসন্তোষ এখনো প্রশমিত হয়নি। নতুন সরকারের কঠোর অবস্থান ও আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-পীড়ন ক্ষোভ ও হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শাসক ও ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন মানেই আন্দোলন-সংগ্রামের জয় নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রক্ত ঝরা অনেক আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তার সব লক্ষ্য-আকাঙ্ক্ষা অর্জন করতে পারেনি। ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই, কিন্তু তার চরিত্র ও কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই সব আন্দোলন-সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কর্মসূচী-অঙ্গীকার থাকার পরো তা জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরই আমরা সেই অবস্থা দেখেছি। এমনকি ৯০ এর গণআন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তিত শাসকের চরিত্রেও তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এসব আন্দোলন ছিল ধারাবাহিক, পরিকল্পিত ও কর্মসূচীভিত্তিক। অভিজ্ঞ নেতৃত্বও সেখানে ছিল। নীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তন না করে শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন দিয়ে তা অর্জন করার প্রচেষ্টা ছিল মারাত্মক ভুল।
প্রতিবেশী মিয়ানমারে দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পর সামরিক সরকারকে সরিয়ে সুকি ক্ষমতায় এসেও নিজের হাতকে রক্তাক্ত করেছেন। শান্তিতে নোবেল পেয়েও সেটাকে কলঙ্কিত, কলুষিত করেছেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপোষ করে ক্ষমতায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করতে পারেননি। আবারো সেখানে হত্যা-নির্যাতন চলছে ও সীমাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো শাসকই তার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ইমরান খানের দল আর বছর খানেক থাকলেই সেই গৌরবের অধিকারী হতো। কিন্তু বিরোধীদের কারণে তা হতে পারেনি। তাকে চলে যেতে হয়েছে।
এই অঞ্চলের আরেক দেশ আফগানিস্তানের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। দীর্ঘ যুদ্ধে তার সবকিছুই ভেঙে পরেছে। দেশটির অর্থনৈতিক সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী ও ধর্ম দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির বর্তমান সরকারের এখনো কোনো স্বীকৃতি নেই।
শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বেই বিচিত্র মাত্রায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গত কয়েক দশকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে বামপন্থিদের প্রভাব বাড়ছে। ইউরোপের অনেক জায়গাতেও বামপন্থিরা এগিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক জায়গায় ডান ও অতি ডানপন্থিদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কোথায় জাতীয়তাবাদ ও উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তিশালী হচ্ছে, কোথাও ধর্মান্ধতার প্রভাব বাড়ছে।
মানুষের স্বাধীনতা ও পছন্দের অধিকারকে অস্বীকার করি না। যেকোনো দেশের মানুষ তারা পছন্দ অনুযায়ীই চলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব দেশ-জাতির চিন্তা-চেতনা-পছন্দ-আকাঙ্ক্ষার মানের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো। তাদের দায়িত্ব সেভাবেই সেখানে শাসন কাঠামো ও পদ্ধতির পরিবেশ তৈরি করা। একটি অগ্রসর রাজনৈতিক ধারা বা সংস্কৃতির বিস্তার ও সমাজের গুণগত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। কিন্তু নীতিহীন, দুর্নীতিবাজ শাসকদের পাল্লায় পরে দেশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পিছিয়ে যায়, সংকটপূর্ণ হয়। শিক্ষা ও উন্নয়নে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কায় ভুল নেতৃত্বের কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে সৃষ্ট বিরল বিদ্রোহের দৃশ্য বিশ্ব প্রত্যক্ষ করলো।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি তুলনামূলক আলোচনা সর্বত্রই আছে। অনেকেই শ্রীলঙ্কা সংকটের কারণ ও উপাদানগুলো বাংলাদেশেও দেখতে পান। সরকার সেই সমালোচনা উড়িয়ে দিলেও তাদের বেশ কিছু উদ্যোগ তার পরোক্ষ স্বীকারোক্তি দেয়। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকার দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং ঘোষণা দিয়েছে, আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করেছে, ডলারের মূল্য বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, জ্বালানির অভাবে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। সরকার জ্বালানি সাশ্রয় ও অপচয় বন্ধের কথা বলছে, রিজার্ভ কমায় আমদানির ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণের কথা বলছে। এসব উদ্যোগ বড় কোনো সংকট থেকে রক্ষার আগাম সতর্কতা ছাড়া আর কিছুই না।
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। কীভাবে নির্বাচন হবে, সেখানে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি না—তা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে।
গতবারের মতো নির্বাচন হলে দেশ-বিদেশে তা গ্রহণযোগ্য হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। তেমন কিছু হলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেই ভাবনায় নাগরিকরা শঙ্কিত। ক্ষমতাসীনরা কি পারবে বিগত দিনের মতো সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে? নাকি বিগত ও বিদ্যমান সংকট থেকে শুরু হওয়া কোনো গণআন্দোলন সবকিছু এলোমেলো করে দেবে?
তা হলেও কথা তো একটাই, সেক্ষেত্রে দেশে কি গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার সরকার তৈরি হবে? নাকি সেই অর্জন অতীতের মতোই আবার কোনো চোরাবালিতে হারাবে?
ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments