‘জনগণ জাগলে কোনো অপশক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারে না’

আবুল কাসেম ফজলুল হক। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষাবিদ, সমাজ-বিশ্লেষক ও চিন্তাবিদ আবুল কাসেম ফজলুল হক। জন্ম ১৯৪০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘ চার দশক। পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে চলছেন এখনো। 

তিনি ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্বদেশ চিন্তা সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার রাষ্ট্রচিন্তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদ থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদ পর্যন্ত।

সময়ের গুরুত্বপূর্ণ এই চিন্তকের মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০টির বেশি। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। গত ১০ জুন ঢাকার পরীবাগের বাসায় সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি ও গণতন্ত্রসহ বিবিধ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

উপাচার্য-শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। এরকম ঘটনা দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক পরিবেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপরেও। এর পেছনের কারণ কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: উপাচার্য-শিক্ষক দুই গোষ্ঠীই অন্যায় করে করছে। দুই পক্ষই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন সংকট তৈরি করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরা সবাই স্বার্থ, পদ ও ক্ষমতার জন্য দলাদলি করে। কখনো ভিসির পক্ষে লোক বেশি হয়, কখনো শিক্ষক সমিতিতে। যখন যার পক্ষে লোক কম থাকছে তারা চাপে পড়ছে। আর তখনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান।

এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে সরকারি দল তথা সরকার। তারা তাদের কর্তৃত্ব সীমিত রাখতে পারে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানে সরকার কর্তৃত্ব করবে। কিন্তু এটা করতে হবে বিধির মধ্যে থেকে। আইনের বাইরে গিয়ে না।

আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক কথা বলতে শোনা যায়। বলা হচ্ছে—ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই বলে গতিহীন হচ্ছে মৌলিক ছাত্র রাজনীতি। আপনিও কি তাই মনে করেন?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: ১৯৭২ সাল থেকে এই সংকট শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেনি। তারা সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো হয় এমন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি।

স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর— এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে দেয় না সরকার। নানা কায়দায় হস্তক্ষেপ করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সেভাবে ঠিক থাকে না।

আর ছাত্রদের দিয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করানোর জন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হয় না। এক কথায় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের কথা কেউ চিন্তা করে না।

আবরারের ঘটনায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। ক্ষমতাসীনরা সেখানে আবার ছাত্র রাজনীতি চালু করতে চায়। এই ছাত্র রাজনীতি দিয়ে দেশের কি হবে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: বর্তমানে যে ছাত্র রাজনীতি চালু আছে তা দিয়ে আগামীতে সুস্থ-স্বাভাবিক রাজনৈতিক নেতা তৈরি হবে না। প্রকৃত ছাত্রনেতা তৈরি হবে নির্বাচনের মাধ্যমে, তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে সচেতন শিক্ষকরা। চর্চা করবে সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাষ্ট্র নিয়ে করবে পড়াশোনা, নানা বিষয়ে আয়োজন করবে বিতর্ক। 

কিন্তু বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে সে চর্চা হয় না। শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই শিক্ষার্থীদের, বরং কিছু শিক্ষক ছাত্রদের গুণ্ডামিতে প্রশ্রয় দেয় নিজেদের সুবিধার জন্য। আর ছাত্ররা সেভাবেই চলে এবং তারা কেবল বড় দলের হয়ে কাজ করে। এভাবে লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক চর্চা অস্বাভাবিক পরিবেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের এবং তাদের।

দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। এই রাজনীতি দেশকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: এটাকে বলা যায় মহাজনের রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিন ধরেই অস্বাভাবিক অবস্থায় আছে। একদল বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। অর্থের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেতারা লিপ্ত। কারও মধ্যে দেশ নিয়ে ভাবনা-ভালোবাসা নেই। কৃষক সারাদিন পরিশ্রম করে অল্প ভোগ করতে পারে, বাকিটা ছেড়ে দিতে হয়। নেতারা গরীব মানুষের জীবনকে রীতিমতো ভোগ করে।

বাস্তবতা হচ্ছে ভালো-মন্দ মিলিয়ে আওয়ামী লীগই বেশি শক্তিশালী এবং মনে হচ্ছে তারা আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকবে। তাদের হাতে সুযোগ আছে পরিবর্তনের এবং সেটা কেবল পারবে শেখ হাসিনা। তার মতো ক্ষমতা দেশে আর কারও নেই।

অনেক বাবারা সন্তান হারিয়ে বিচারের দাবিতে ঘুরছেন। আপনি নিজ সন্তান হারিয়ে কেন বিচার চাইলেন না?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমি কেন বিচার চাইব? আমার সন্তান দীপন কি ব্যক্তিগত কারণে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে? পারিবারিক কারণে খুন হয়েছে? এমন হলে আমি বিচার চাইতাম।

আমার সন্তানকে মুক্তবুদ্ধি-চর্চার জন্য হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে বিচারের দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। আমি না চাইলেও তো রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করবে। আইনকে গতিশীল রাখবে।

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। তরুণদের একটা বড় অংশ এর প্রতিবাদ করছেন। এ বিষয়টি নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: হাইকোর্ট রায় দিলেই সে বিষয়টা ন্যায়সঙ্গত হবে এমনটা মনে করার কারণ নেই। মনে রাখতে হবে একাত্তরে যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে চাননি। মানে কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল হবে এমন চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তথাপি স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার শহীদ পরিবার এবং আহতের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কোটা চালু করে। পারিবারিক সংকট তথা এক ধরনের নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা নেই। কোটার রেওয়াজ দীর্ঘস্থায়ী হবে— এমনটি অপ্রত্যাশিত।

তারপরও মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানের জন্য কোটার সুবিধা মানা যায়। কিন্তু ছেলে-মেয়ের ঘরে নাতির সুবিধা বেমানান। এতে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে। অনাদিকাল ধরে এই কোটা পদ্ধতি চলতে পারে না। এতে যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, স্বাধিকার, স্বনির্ভরতা চেয়েছেন— তাদের আত্মাও কষ্ট পাবে।

জাতীয় নির্বাচনের পরে উপজেলা নির্বাচন নিয়েও ভোটারদের তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। গণতান্ত্রিক একটা দেশে এমন ভোট বিমুখতা কী বার্তা দেয়?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র নেই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। তাহলে জাতীয় নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কীভাবে হবে? এমন নির্বাচনে জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনা কেন থাকবে? গণতন্ত্র আশা করলে তার একটি ধারাবাহিক চর্চা থাকতে হবে। এরপর এর ফল আসবে ধীরে ধীরে।

অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষেরও কোনো আওয়াজ নেই। তারা ঘুমন্ত। মনে রাখতে হবে ভোগবাদী ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা জাতীয় সমস্যার সমাধান হবে না। বরং নেতৃত্বের সংকটে পড়বে আগামী।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে মোদি সরকার ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে ভারতের জাতীয় নির্বাচনেও। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রকৃত অর্থে তরুণ কিংবা প্রগতিশীল প্রজন্ম কখনোই গ্রহণ করে না।

তার উদাহরণ ভারতের এবারের নির্বাচন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সেখানকার তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি তাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য শিক্ষা। আমাদের জন্যও বটে।

বাংলাদেশ বস্তুত কোন দিকে যাচ্ছে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমরা খুব খারাপ সময় পার করছি। সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা সবখানেই সংকট। কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সবাই চুপ। মিডিয়া কেবল প্রশংসা করে, উন্নয়ন দেখে। ব্যবসায়ী মালিক যেভাবে বলে সাংবাদিকরা সেভাবে চলে। নিজেদের কোনো বিবেচনা নেই।

দুয়েকটি পত্রিকা কিছু লেখে, বলে। সেগুলোর কোনো প্রভাব নেই, উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া নেই। কার্যকারিতা নেই সমাজে।

আমি মনে করি জনগণের জেগে ওঠা উচিত। আমরা দেখেছি জনগণ যখন বিবেকবুদ্ধি দিয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছে তখন সেই শক্তির সামনে কোথাও কোনো অত্যাচারী শাসক, কোনো যুদ্ধবাজ শক্তি টিকতে পারেনি। কেননা জনগণ পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। জনগণ জাগলে কোনো অপশক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারে না।

ঈদ কী সবার মাঝেই সমান হয়ে আসে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: না, বাজারের কারণে মানুষের মনে আনন্দ নেই আর। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে তারা কী খাবে, কীভাবে চলবে? লোক দেখানো কোরবানি করে অনেকে। কিন্তু প্রতিবেশীর প্রতি খেয়াল রাখে না, যেভাবে রাখে না রাষ্ট্র। অথচ ঈদের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। এটা কেউ মন দিয়ে অনুভব করে না।

Comments

The Daily Star  | English

1,500 dead, nearly 20,000 injured in July uprising: Yunus

He announced plans to demand the extradition of deposed dictator Sheikh Hasina from India

53m ago