গণঅভ্যুত্থানের ঐক্য যেভাবে ফিরবে

ছবি: সংগৃহীত

যে শিক্ষার্থীদের ডাকে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামে, জীবন দেয়, গণঅভ্যুত্থান হয়, স্বৈরাচার পালিয়ে যায়, সেই তারা কেন নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ায়? শিক্ষাঙ্গণে কেন অস্থিরতা? ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু জায়গায় সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় অনেকে আশাহত, প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যকার ঐক্য নিয়ে।

'ভোটবঞ্চিত' এই তারুণ্য জুলাই গণঅভ্যুত্থানে লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে, আহত হয়েছে, থামেনি ফ্যাসিস্টমুক্ত করার আগ পর্যন্ত। শেষ হয় টানা এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। দেয়ালে দেয়ালে লিখে জানান দেন, 'বিকল্প কে? তুমি-আমি-আমরা'।

আজ তারাই কেন নিজেদের মধ্যে রক্ত ঝরাচ্ছেন? পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এক পাঁয়তারা করছে একটি মহল। ইনিবিনিয়ে তিলকে তাল করছে। সহজ বিষয়কে জটিল করে তুলছে।

যেমন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেশ পুরানো। তবে সময়ের পরিক্রমায় সেগুলো কমার পথেই ছিল, যদিও বড় পরিসরে নয়। সাত কলেজে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। তাদের মধ্যে যদি বিপত্তি তৈরি করা যায়, তাহলে শহরের সব প্রান্তেই এর ছাপ বাজেভাবে পড়বে, শুরু হবে জনভোগান্তি। হোক জনভোগান্তি! তবুও গণঅভ্যুত্থানের পরের এ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেই শান্তি পাবে একটি গোষ্ঠী। এ দেশের মানুষের অনেক অযৌক্তিক আন্দোলনে অস্থিরতা তৈরি হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ মানবিকতা ও ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে।

ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত হওয়ায় গণঅভ্যুত্থানের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, 'শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিশ্চয়ই ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। তবে ৫ জুলাইয়ের আগে যারা এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, তারাই এখন শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন আন্দোলনে দাঁড় করিয়ে আমাদের স্বাধীনতার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছে। বলতে পারি এতটুকু, ছাত্রশক্তিতে ঐক্যের বিভেদ তৈরি করে এরা কখনোই সফল হতে পারবে না। তারুণ্য লড়তে শিখে গেছে।'

৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। তার মতে, 'কোটা আন্দোলন থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীজ বপন হয়েছে। আর এ আন্দোলনের ফসলের জন্য এক দফা এক দাবিতে উপনীত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। গণঅভ্যুত্থানের পর লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পুলিশ বাহিনী কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়েছে। তবে বড় অংশ, আনুমানিক ৮০ শতাংশ পুলিশ পুনরায় কর্মস্থলে ফিরেছে। বাকিরা এখনও ইনএক্টিভ। পালিয়েছে ইমাম থেকে শিক্ষক, নেতা থেকে কর্মী। সুবিধাভোগী কেউ আর স্থির নেই। দৌড়ের মধ্যে আছে স্বৈরাচারের সহযোগীরা।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো অভ্যুত্থান দেখেছি, এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ভিন্ন বলে দাবি করছি। কারণ, বাংলাদেশ কিংবা বহির্বিশ্বে অভ্যুত্থানের পর পুলিশ বাহিনী পালিয়েছে, তা কেউ কখনো দেখেনি। কিন্তু, বাংলাদেশ এবার সেটাই দেখেছে।'

আন্দোলনের পুরো সময়টা শিক্ষার্থীদের দারুণ ঐক্যশক্তি ছিল। এখন সেই ঐক্যশক্তিটা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের এই ঐক্যশক্তিটা খুব দরকার। আরেকটি বিষয়, ট্রান্সজিশন অব পাওয়ার নিরাপদ দরকার।

'এ ছাড়া, অভ্যুত্থানের পর পুলিশ বাহিনী হারিয়েছে কাজের প্রতি মনোবল এবং জনগণের জানমাল নিরাপদ রাখার শক্তি। এমনকি, এই নিরাপত্তা বাহিনী এখন জনগণের মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে, যা কোনো অভ্যুত্থানে এ দেশ দেখেনি। একটি কথা না বললেই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রতিটি সেক্টর ভেঙে পড়ছে। এমন ভঙ্গুর রাষ্ট্রকে সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে,' যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ আরও বলেন, 'মানুষ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে, দেশের পরিস্থিতি এমন অস্থিতিশীল করছে, তার কারণ হলো—১৬ বছরে বাংলার মানুষ নিজেদের চাহিদার কথা বলার পরিবেশ বা জায়গা পায়নি। তবে, সব আন্দোলনই যে নির্দোষ, তা কিন্তু নয়। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার জন্য।'

তার মতে, 'আন্দোলনের পুরো সময়টা শিক্ষার্থীদের দারুণ ঐক্যশক্তি ছিল। এখন সেই ঐক্যশক্তিটা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের এই ঐক্যশক্তিটা খুব দরকার। আরেকটি বিষয়, ট্রান্সজিশন অব পাওয়ার নিরাপদ দরকার। দেশের পলিটিক্যাল ফোর্সের নূন্যতম একটা বিষয়ে একমত হওয়া দরকার যেখানে তারা কোনো প্রকার অস্থিতিশীলতাকে প্রশ্রয় দেবে না।'

'আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা দরকার। সেই আলোকে বাস্তবসম্মত উপায়ে সেগুলো সমাধানের পথ বের করতে হবে। তবেই, রাষ্ট্র সংস্কার হবে, দেশ ও দেশের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে,' বলেন তিনি।

যে আইনজীবীরা ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা আজ যে বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছেন, এটাই কি চেয়েছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন বলেন, 'স্বৈরাচার হাসিনামুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম। পেয়েছি। তবে সহজ স্বীকারোক্তি হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের পর এমন পরিস্থিতি হবে তা স্বাভাবিক, কিন্তু তা সংস্কারের অনেক সুযোগ আছে। আন্দোলনে আমরা যার যার অবস্থান থেকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, এখনও আবার সময় এসেছে সবার ঐক্যবদ্ধতার বিনিময়ে এমন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে স্বাধীন বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা।'

এসব সংকট কাটিয়ে গণঅভ্যুত্থানের ঐক্য ফিরিয়ে আনাই এখন বিপ্লবীদের প্রধান কাজ। যেকোনো ইস্যুতে যেন আবারও কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে এক হতে পারে সবাই—তার জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ত্যাগের মানসিকতা জরুরি। সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট, কলেজ, মাদ্রাসা—এমন দূরত্ব রাখলেই ডুকে পড়বে স্বৈরাচারের সহযোগীরা।

Comments

The Daily Star  | English

Students suffer as NCTB fails to deliver books

Only 37% of 40.15cr textbooks distributed till first half of Jan

12h ago