রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতেই হবে

৫ আগস্ট অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার চিত্র। ছবি: নাঈমুর রহমান/স্টার

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এক সমুদ্র চ্যালেঞ্জ সঙ্গে করে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেখা গেছে—যে লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, শাসকগোষ্ঠী তা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করেছে। সংবিধান বার বার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। বৃটিশ বেনিয়াদের তৈরি করা আইন স্বাধীন দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তারা যে 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসি অনুসরণ করে ভারতবর্ষ শাসন করে গেছে, সেই অশনির পথ ধরে আমাদের শাসকরা দেশ শাসন করেছে। ফলে একটি মাটির সিঁড়ি নক্ষত্রের আকাশে উঠেছে এবং তা গণ-অভ্যুত্থানের দামামায় ভেঙে পড়েছে।

কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিদায়ঘণ্টা বাজার তিনদিন পর বর্তমান অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। তাদেরকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। মানুষের জীবন ও সম্পদ দুটোই ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হয়। ফ্যাসিবাদি সরকার রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ—আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও গণমাধ্যম পুরোপুরি ধ্বংস করেছিল। মূলত নির্বাহী বিভাগের কাঁধে ভর করেই সরকার তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনকে যত অন্যায্য সুবিধা ছিলো তার সবই সরকার দিয়েছিল এবং উভয় পক্ষ তা অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করেছে। নীতি-নৈতিকতা সেখানে সাইমুমের মতো উড়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় জড়িতদের অধিকাংশের অবৈধ সম্পদের যে বিবরণী পাওয়া যাচ্ছে, তা আরব্য রজনীর শাহরাজাদের গল্পকে ম্লান করে দিয়েছে।

বর্তমান সরকার রাষ্ট্র মেরামতের ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নাজুক অবস্থায় আছে। কেবল সেপ্টেম্বর মাসে ২৮ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন এবং ১৬ জন খুন হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে নিম্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ চরম সংকটে জীবন অতিবাহিত করছেন। দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্টস শিল্পে চলছে চরম শ্রমিক অসন্তোষ।

সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেয়েছেন। বলা হচ্ছে ও সভ্য ভাষ্যও তাই যে, একটি গোষ্ঠী কিংবা একাধিক গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। পরাজিত শক্তির জন্য এটা একটা সুযোগ বটে! তারা 'ঘোলা পানিতে মাছ শিকার' করতে চাইছে কিংবা 'ঝোপ বুঝে কোপ মারা'র কাজটি করছে।

একদলীয় সরকার, সামরিক স্বৈরাচার, নির্বাচিত স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন মাড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই ৫৩ বছরে একটি বিষবৃক্ষ মাটিতে যেমন তার শেকড় গ্রথিত করেছে, আবার আকাশের পথেও ডানা মেলেছে। এই বিষবাষ্পের বাস্তবতার হিসাব অত্যন্ত জটিল, দ্বন্দ্বপূর্ণ, ভয়ানক এবং জঘন্য। যুক্তরাজ্যের ইডসিএল প্রেস থেকে 'দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল একোনোমিক্স ইন সাউথ এশিয়া' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় বইটির নাম দাঁড়ায়, 'বুনো পূর্ব: দক্ষিণ এশিয়ার অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতি'। সহজ কথায় রাজনৈতিক ঠগিতন্ত্রের অর্থনীতি। অধিক ঘনবসতিপূর্ণ, চরম বৈপরীত্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে পরিপূর্ণ নগরসমূহে ক্ষমতাবানরা গড়ে তোলে নিজস্ব বাহিনী ও রাজত্ব। এই দীর্ঘ ঠগিতন্ত্রের ইতিহাস মাথায় রেখে এই সরকারকে তার কর্মপন্থার বিন্যাস সাজাতে হচ্ছে।

৮ আগস্ট সরকার গঠনের পর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা শপথ গ্রহণকারী উপদেষ্টাদের মাঝে দপ্তর বণ্টন করেছেন। উপদেষ্টাগণ বেসামরিক আমলাদের সহায়তায় দেশ পরিচালনা শুরু করেছেন।

এই শতকের শুরুতে বিএনপির শাসনামলে আমলাদের ডিএনএ ফাইল তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই ডিএনএ ফাইলের কার্যপরিধির বিস্তৃতি ঘটেছে। তারই ভিত্তিতে আমলাদের পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে পদোন্নতি বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছে। এটি নিশ্চয় যথাযথ উদ্যোগ। তবে আশঙ্কা থেকে যায় তাদের সহযোগিতার প্রশ্নে। তারা এই সরকারকে কতটা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে? এই প্রশ্নের জবাব তাদের ডিএনএ ফাইলের ভেতরেই প্রথিত রয়েছে। ঠিক সেই কারণেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে হতে হবে যোগ্য এবং চৌকশ। অর্পিত মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধি সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থাকার কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকাটাও বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের এসব গুণাবলী থাকা অপরিহার্য নয়। কিন্তু এই অন্তবর্তী সরকারের চরিত্রটি একেবারেই স্বতন্ত্র। ছাত্র-জনতার সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার চাপ তাদের মাথার ওপরে রয়েছে। বেসামরিক আমলারা যেন কোনোভাবেই উপদেষ্টাগণকে ভুলপথে পরিচালিত করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যেই উপদেষ্টাগণকে হতে হবে বহুমাত্রিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। হতে হবে দূরদর্শী ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন।

উপদেষ্টা পরিষদের দপ্তর বণ্টনের চিত্রে প্রত্যক্ষ করা গেছে যে অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের মেলবন্ধন ঘটেনি। পূর্বেই উল্লেখ করেছি—এই সরকার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সেনাসমর্থিত সরকারের মতো নয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ছিল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সেনাসমর্থিত সরকার মাইনাস-টু ফর্মুলার দিকে ধাবিত হয়েছিল। তবে তারা অবস্থা বেগতিক দেখে অ্যাবাউট টার্ন করে তড়িঘড়ি নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল।

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সরকারের কাজের ক্ষেত্র ব্যাপক, গোলমেলে, গভীর, সুদূরপ্রসারী এবং জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও পটভূমিজাত জ্ঞানের কোনো বিকল্প হয় না। উপদেষ্টা পরিষদে দৃষ্টিপাত করলে প্রত্যক্ষ করা যায়, সেখানে কোনো চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, কৃষিবিদ, প্রযুক্তিবিদ, লেখক কিংবা গবেষক, বিজ্ঞানী অথবা প্রকৌশলীর মতো বিশেষজ্ঞ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি নেই। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতেই হয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণলয়ের দায়িত্বে রয়েছেন মাননীয় উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি দৃশ্যত শিল্প-সংস্কৃতি বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। খোদ কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাসমূহের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি একটি সংস্থার নিয়োগের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তবে সেই নিয়োগ নিয়েও অন্যরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

ইতোমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যদের প্রত্যাখান করে বিবৃতি প্রদান করেছে ২৫টি ক্যাডারের জোট। বিবৃতিতে তারা বলেছে, কমিশনের আটজন সদস্যের ছয়জনই প্রশাসন ক্যাডারের। উপদেষ্টা পরিষদের মতো সংস্কার কমিশনও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এসব কমিশনের কমপক্ষে ৭০% সদস্যকে হতে হবে নির্মোহ, নিরপেক্ষ, যোগ্য ও চৌকশ। মূলত সংস্কার কমিশনের সফলতার ওপর নির্ভর করছে রাষ্ট্র সংস্কার। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং কোনো সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত না হোক। 'আমরা আর মামুরা' হলে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যগণের ভাষ্যে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকাটা জরুরি। এমন কিছু ওনাদের না বলাই ভালো—যার ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়টিও অপরিহার্য হয়। শত্রুপক্ষ মুখিয়ে আছে ভুল বার্তা ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য। ছাত্রদের উন্মাতাল আন্দোলনের ফলে যে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে তার শক্তিকে একতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে যথাযথভাবে ব্যবহার করে উদার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিশ্চিত করাটা অপরিহার্য। ৫৩ বছরের অসারতার স্তূপে অধিষ্ঠিত থাকা একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টির বিষয়টি উপেক্ষিত থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। আত্মতুষ্টির সামান্য উদাসীনতার সুযোগ গ্রহণে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস শহীদদের পরিবারের উদ্দেশে বলেছেন, 'আমি তাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা কখনোই শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।'

আমরাও ড. ইউনূসের বয়ানের সঙ্গে অনুরণিত হয়ে বলতে চাই—শহীদদের রক্ত ও আহত ব্যক্তিদের আত্মত্যাগকে কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। মনে পড়ছে স্যামুয়েল বেকিট'র 'ওয়েটিং ফর গোডো' নাটকের কথা। এদেশের মানুষ ৫৩ বছর ধরে গোডোর জন্য প্রতীক্ষা করছে। এবার জনগণ নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্র রচনার ফলাফল হিসেবে 'গোডো'র সাক্ষাৎ পেতে একান্ত আগ্রহী। ফ্যাসিবাদি সরকারের দুঃশাসনের ঘনঘটা দূর হওয়ার প্রত্যয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে হয়—'তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ'য়ে/আমরা কি তিমিরবিলাসী?/আমরা তো তিমিরবিনাশী/হ'তে চাই।/আমরা তো তিমিরবিনাশী।'

 

লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট

Comments

The Daily Star  | English

Govt forms new Election Commission

The new EC will be led by former secretary AMM Nasir Uddin

42m ago