চিকিৎসকদের কর্মবিরতি সমাধান নয়, ভিন্নপথের প্রস্তাব 

বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জরুরি টিকিট কাউন্টার। ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রশ্নে একতরফা দোষারোপ করার আগে খতিয়ে দেখার রয়েছে অনেকগুলো বিষয়। বিদ্যামান সমস্যারগুলোর উপযুক্ত সমধান বের করতে পারলে তবেই আমরা দীর্ঘমেয়াদী সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারব, নচেৎ সমহু অন্ধকার।  বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু চিকিৎসকদের প্রতি একরকম নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। ওদিকে দেশের দূরন্ত মেধাবীদের মূল লক্ষ্য থাকে ডাক্তার হওয়া। উচ্চ মাধ্যমিকের বৈতরণী পার হওয়ার পর  ডাক্তারির জন্য  ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় সবাইকে। সবার পক্ষে চিকিৎসা বিষয়ে পড়ালেখার সুযোগ মেলে না।

অল্প কিছু মানুষ প্রচুর অর্থযোগের হেতু তাদের সীমাবদ্ধতা থেকে উৎরে গিয়ে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পড়ার সুযোগ পায়। তবে সেখানেও চিকিৎসক হিসেবে তাদের গড়ে তোলার প্রক্রিয়া নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষার্থীর বিপরীতে উপযুক্ত হাসপাতাল পরিবেশ থাকা যেমন জরুরি, তেমনি পরীক্ষাগার ও যোগ্যদক্ষ শিক্ষক থাকাটাও বাঞ্চনীয়। কিন্ত এই দুটি ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়।

অবকাঠামোগত সংকট ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার হেতু পরবর্তীকালে পেশা হিসেবে ডাক্তারিতে নামার পর নানা সীমাবদ্ধতাকে নিত্যসঙ্গী করেই তাদের এগিয়ে যেতে হয়। ওদিকে বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালে কম্বলের নিচে কাঁপতে থাকা রোগীরা যেমন নানা কারণে বিরক্ত। তেমনি সেখানে সাদা অ্যাপ্রোনগায়ে জড়িয়ে স্টেথোস্কোপ কাঁধে হাঁটতে থাকা ডাক্তাররাও জানেন এই হিমশীতল বাতাসের বাইরে প্রচুর অপ্রকাশযোগ্য উষ্ণতা রয়েছে, যা সহ্য করাও কঠিন।

ছুটিবিহীন শ্রম বা লাগাতার কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার শঙ্কা যেমন রয়েছে তেমনি রোগীদের স্বজন কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবার ক্ষেত্রে অভিন্ন শত্রু ডাক্তাররাই। হাসপাতালের মলিক পক্ষ মনে করছে ডাক্তারদের দুর্বলতায় তার হাসপাতালের আকাশচুম্বী আয় কমে যাচ্ছে। ওদিকে রোগী এবং তার আত্মীয়স্বজন ভাবছে তাদের লুটে নিয়ে ফকির করে দিচ্ছে ডাক্তার কিন্ত ন্যূনতম সেবা দিচ্ছে না।

ফলাফল হিসেবে যখন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বলতে গেলে মধ্যযুগের ইউরোপের সেই ডাইনিশিকারের মতো প্রসঙ্গ আসে। রোগীরা তাদের অতৃপ্তি ও অসন্তুষ্টির কথা জানালেই সেটাকে সুযোগ হিসেবে নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেটাকে উল্টো তাদের আয় বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায়। মাঝখান থেকে রাতদিন শ্রম দেওয়া ডাক্তাররা নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত হতে থাকে নতুন ভাবে।

রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ডাক্তার এবং ইউটিউব ভিডিও দেখে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ভূমিকায় বসে যাওয়া রোগীরাও বাংলাদেশের বড় একটা সর্বনাশ করেছেন। তারা একাধারে রোগীদের কথাবার্তাকে ডাক্তারদের কাছে বিরক্তিকর করে তুলেছেন। তারা মানুষকে বলতে বাধ্য করেছেন যে ডাক্তারগণ রোগীদের কথা শোনে না। তারা ডায়গনস্টিক সেন্টারের পিআর হাউসে পরিণত হয়েছে। তারা চিকিৎসা করেন কম। এর বেশি ধান্দায় থাকেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ বিশেষত দামী অ্যান্টিবায়োটিক লিখে ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা ফার্মেসি থেকে অর্থ কামানো যায়।

সামান্য সুবিধাজনক পোস্টিং এর জন্য তাদের বিভিন্ন কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয়। ওদিকে দীর্ঘদিনের চিকিৎসাসেবা আর পড়ালেখা করার পর শুধু দুই একট পদ-পদবি প্রাপ্তির বাইরে তাদের প্রমোশনের সুযোগ নাই বললে চলে। পক্ষান্তরে ডাক্তারদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুবিধাও যাচ্ছেতাই।

বিপরীতে রোগীদের কাছে ডাক্তারদের অসৎ ও অবিশ্বাসী হিসেবে তুলে ধরেছে কিছু ইউটিউব চ্যানেল। হাতুড়ে চিকিৎসা নির্ভর ভিডিও ব্লগার তথা ইউটিউবার শুরুতে ভেবেছে তাদের কবিরাজি ব্যবসার প্রসার ঘটাতে গেলে সবার আগে ডাক্তারদের জনগণের চোখে শত্রু হিসেবে প্রচার করতে হবে। দীর্ঘদিনের চেষ্টাতে ডাক্তারদের একটা অবয়ব দাঁড় করাতে চেয়েছে জনগণের সামনে। প্রচারিত বয়ানে 'ডাক্তার হচ্ছে গণশত্রু যারা শুধু বিভিন্ন টেস্ট করিয়ে রোগীকে ফতুর করে, দামি দামি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে আর অপ্রয়োজনীয় সার্জারি করে টাকা কামায়'। ফলে বেশিরভাগ ডাক্তার আর রোগী মুখোমুখি অবস্থানে গিয়েছেন। উত্তেজিত রোগীর পরিবার ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে ওঠেন মারমুখী। কিন্ত তাতে ক্ষতি হয়েছে ডাক্তার, রোগী, দেশেরও।

আমরা জানি দেশের দূরন্ত মেধাবীরাই ডাক্তার হয়। তারপর তারা উপযুক্ত নিয়ম মেনে পড়ালেখা করে বিসিএস দিয়ে তবে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তবে নিয়োগের পর তাদের প্রথম সংকট থাকে পোস্টিং। সামান্য সুবিধাজনক পোস্টিং এর জন্য তাদের বিভিন্ন কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয়। ওদিকে দীর্ঘদিনের চিকিৎসাসেবা আর পড়ালেখা করার পর শুধু দুই একট পদ-পদবি প্রাপ্তির বাইরে তাদের প্রমোশনের সুযোগ নাই বললে চলে। পক্ষান্তরে ডাক্তারদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুবিধাও যাচ্ছেতাই।

চাকরিক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেও অনেক ডাক্তার আপ্রাণ চেষ্টা করেন রোগীদের সেবা দিতে। তখন তাদের মুখোমুখি হতে হয় স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা ফার্মেসি মালিকদের যারা আবার স্থানীয় রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় চরম ক্ষমতাবান। ওদিক থেকে দেখতে গেলে ভারতের নন্দিত অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের 'জীবন নিয়ে খেলা' চলচ্চিত্র রূপালি পর্দায় যা দেখিয়েছে বাস্তবতা তার থেকে খুব একটা উন্নত হতে পারেনি এখনও।

আমৃত্যু মানব সেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসা পেশায় আসা অনেক দক্ষ ও মেধাবী ডাক্তার আছেন। তাঁরা এই দুই চক্রের মধ্যে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি করছেন। ওদিকে টুকটাক টাকা পয়সা আছে এমন রোগীরা সর্দিকাশি থেকে পাইলস সব রোগের জন্য দীর্ঘদিন ভারতে কিংবা সিঙ্গাপুর-ব্যাংককে ছুটেছেন। তাদের চরম নেতিবাচক প্রচারণা একদিনে ডাক্তারদের মন ভেঙ্গে দিয়েছে অন্যদিকে দেশীয় রোগীদের করেছে চরম হতাশ। এতে করেও ডাক্তার আর রোগীদের বিদ্যমান সম্পর্ক ধ্বংসের দিকে গেছে।

সেবামূলক কাজে যাঁরা নিয়োজিত তাদের মধ্যে ভাঙ্গাচোরা চেম্বার আর ধুলিধূসর হাসপাতালে টেবিল পেতে বসা ডাক্তারদের অবস্থা নিতান্ত নাজুক। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে ডাক্তারগণ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। কিন্ত তারা স্বাচিপের নেতাদের বিরুদ্ধে নিজেদের দাবি নিয়ে হাজির হতে পারেন নাই। সমস্যা নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা বলতে গেলেই বদলি ও মারধোরের পাশাপাশি নানাবিধ হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

ডিজিটাল সিকুরিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন চিকিৎসকদের কণ্ঠরোধ করে রেখেছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁরা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত তাদের পদ পদবি নির্ধারণ করা হতো স্বাচিপের থেকে। যোগ্যতা, শ্রম ও চিকিৎসক হিসেবে সক্ষমতার কোনো দাম ছিল না সেখানে। অনেক চিকিৎসককে শায়েস্তা করার জন্য এমন সব হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে যেখানে তাঁর দক্ষতা দেখানোর বিভাগই নাই। ফলাফল হিসেবে কর্মস্থলের জটিলতা তাঁকে উপযুক্ত চিকিৎসক হয়েও নিধিরাম সর্দার হিসেবে বসে থাকতে বাধ্য করেছে।

স্থানীয় জনগণের সরকারি ডাক্তারদের প্রতি বিরক্তি ও অবজ্ঞার বিভিন্ন কারণের মধ্যে মুল কারণ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের জেনারেল হাসপাতালের তত্তাবধায়ক রতন কুমার রায়ের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে মাছরাঙ্গা টেলিভিশন একটি সংবাদ প্রকাশ করে 'প্যান্টের চেইন খুলে শিক্ষার্থীদেরকে অশ্লীল ভাবে হুমকি দিলেন ডাক্তার' শিরোনামে। এখানে একজন ডাক্তার হিসেবে যতটা নয় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবেই রতন কুমার রায় শিক্ষার্থীদের দিকে তেড়ে মারতে গিয়েছেন। পাশাপাশি বিপ্লব পরবর্তী উত্তাল পরিস্থিতিতেও তাদের হুমকি ধামকি দিয়েছেন।

সিরাজগঞ্জের ঐ হাসপাতালের মতো অন্তত শতাধিক ঘটনা পাওয়া যাবে গুগলে খুঁজলে যেখানে 'ডাক্তারের তুলনায় সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে একালাবাসীর কাছে পরিচিত কিছু ব্যক্তি'। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণগত অযোগ্যতাকে অতিক্রম করে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবই তাদের বেশিরভাগ নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই ডাক্তার হিসেবে রোগীদের সেবাদানের ক্ষেত্রে তারা কোনোরকম আন্তরিকতা দেখাতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবে রোগীরাও তাঁদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। তবে সব চিকিৎসককে এই অপরাধীদের কাতারে ফেলে ঢালাও সমালোচনার সুযোগ নেই।

দীর্ঘদিনের বৈষম্য পেরিয়ে দেশের বর্তমান উত্তাল পরিস্থিতিতে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে বড় জটিলতা সৃষ্টি হওয়া কোনো অমূলক বিষয় নয়। সংকট নিরসনে মূল সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় রদবদল কিংবা অভিযোগের ভিত্তিতে দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা যেতে পারে। তবে যাই হোক চিকিৎসার মতো সেবামূলক খাতে কর্মবিরতি কোনো সমাধান হতে পারে না। এবং অবশ্যই রোগীদের পাশাপাশি তাদের আত্মীয় স্বজনের উপযুক্ত সহনশীল আচরণ দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য জরুরি।

সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। 

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago