ইমরুলের বীরত্বে অনায়াসে জিতল বাংলাদেশ
এর আগে ওয়ানডেতে দুটি সেঞ্চুরি ছিল ইমরুল কায়েসের। তার একটাতেও জেতেনি দল। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইশ্চার্চে জেতার আশা ছিল বাড়াবাড়ি। তবে ২০১৬ সালে মিরপুরে ইমরুলের দারুণ সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ডকে না হারাতে পারা চরম হতাশার হয়ে আছে। ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরিতে আর হতাশ হলেন না ইমরুল। তার দারুণ সেঞ্চুরির দিনে সহজ জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।
রোববার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে ২৭১ রান করেছিল মাশরাফি মর্তুজার দল। যার ১৪৪ রানই ইমরুলের। ওই রান তাড়ায় শুরুটা ভালো হলেও কখনই জেতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি সফরকারীরা। পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে তারা করতে পেরেছেন ২৪৩ রান।
এই ম্যাচে বাংলাদেশের হিরো একজনই। ইমরুল কায়েস। তার ব্যাটিংয় কখনোই জনপ্রিয় ধারার নয়। ক্রিজে গিয়ে আলোর রোশনাই ছড়াতে পারেন না খুব একটা। তবে মাঝে মাঝেই বিপদে কাণ্ডারি হয়ে যান। এরমধ্যে কোন কোন ম্যাচ দল জেতে না বলে তার ইনিংস প্রভাব বিস্তারি হয়নি কোনদিন। আবার কখনো ভালো খেলেও আড়ালে পড়ে গেছেন অন্যকারো আরও বেশি ‘হিরো’ হয়ে উঠায়।
বরাবরের পার্শ্ব নায়ক ইমরুলের মাঠের বাইরের চলাফেরাতেও বেশি ঠাটবাট নেই। বারবার দল থেকে বাদ পড়েন, নানান ঘোরানো প্যাঁচানো পথ গলে বারবার আবার ফেরেনও। ইমরুলের পুরো ক্যারিয়ারই যেন যাওয়া-আসার খেলা। তার দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে প্রায়ই উঠে তাই প্রশ্ন।
এইতো কদিন আগে হুট করে এশিয়া কাপের দলে যোগ দিয়েই করে ফেলেছিলেন ম্যাচ জেতানো ফিফটি। পরের দুই ম্যাচে আবার রান পাননি। তাই দলে জায়গা হয়ে পড়েছিল নড়বড়ে। ক্যারিয়ার সেরা ব্যাটিং করে সেসব প্রশ্ন এবার মোটামুটি চাপা দিলেন তিনি। এটি যে কেবল তার সেরা ব্যাটিংই নয়, ওয়ানডেতেই বাংলাদেশের হয়ে এটি যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংসও।
সহজ প্রতিপক্ষ, ঘরের মাঠ। এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে আসা বাংলাদেশের জন্য মোটামুটি ‘ডালভাত’ সিরিজ। মাথার উপর নেই কোন চাপ। আগের দিনই অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা বলেছিলেন, এই সিরিজে ভালো করতে সবাই খেলুক ব্যক্তিগত লক্ষ্য ঠিক করে।
ইমরুল অবশ্য কেবল ব্যক্তিগত লক্ষ্যেই ছুটেননি। মিরপুরের ভরা গ্যালারির সামনে তার ব্যাটেই বিপর্যয়ে পড়া দল পায় দিশা। ইনিংসের মধ্যে দুবার পথ হারিয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাটের মুন্সিয়ানায় দুবারই পথ দেখিয়েছেন ইমরুল। ১৭ রানে দুই উইকেট পড়ার পর মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ৪৯ রানের জুটি। মুশফিক ফেরার পর মোহাম্মদ মিঠুনের সঙ্গে ৭১ রানের জুটি। এরপর ২ রানের মধ্যেই পড়ে যায় ৩ উইকেট। সপ্তম উইকেটে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনকে নিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ ১২৭ রানের জুটিতেই ইমরুল ম্যাচ নিয়ে আসেন বাংলাদেশের মুঠোয়। জুটিতে তারা পেছনে ফেলেন ২০১০ সালে মুশফিকুর রহিম, নাঈম ইসলামের ১০১ রানের জুটিকে।
ইমরুলের ১৪৪ রানের ইনিংসটা প্রায় নিখুঁত, সেইসঙ্গে চোখ ধাঁধানোও। ৭ রানে একবার জীবন পেয়েছিলেন, পরে টুকটুক করে এগোননি, ছিলেন সাবলীল, এগিয়েছেন দাপটের সঙ্গে। ছয়টি ছক্কা দিচ্ছে তারই প্রমাণ।
ইমরুল ছাড়া রান পেয়েছেন দলে ফেরা সাইফুদ্দিন আর মিঠুন। ঠিক ৫০ রান করেন সাইফুদ্দিন, দারুণ ব্যাট করতে থাকা মিঠুন থামেন ৩৭ রানে। দলের প্রতিষ্ঠিত বাকি ব্যাটসম্যানরা করেছেন হতাশ। এশিয়া কাপের ফাইনালে বীরোচিত সেঞ্চুরি করা লিটন দাসকে এদিন খুঁজেও পাওয়া যায়নি। নামার পরই ছিলেন নড়বড়ে, একবার ক্যাচ দিয়ে বেঁচেছেন, রান আউট হতে হতে হননি আরেকবার। তার অস্থিরতা থেমে ৪ রান আউট হয়ে। অভিষিক্ত ফজলে মাহমুদ রাব্বি জীবণের স্মরণীয় দিনটি রাঙাতে পারেননি। রানের খাতা খোলার আগেই টেন্ডাই চাতারার লাফানো বলে কুপোকাত হয়েছেন। ১৫ করে লেগ স্পিনার ব্র্যান্ডন মাভুটাকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন মুশফিক। মাহমুদউল্লাহ শূন্য রানেই কাইল জার্ভিসকে ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে। একইভাবে ফেরেন মেহেদী হাসান মিরাজও।
ইনিংসের শেষের ঝড়টাও এসেছে ইমরুলের ব্যাটে। ১১৮ বলে তিন অঙ্ক পৌঁছেছিলেন। পরের ২২ বলে করেছেন আরও ৪৪ রান। চার-ছয়ের ঝড়ে মাত করেছেন গ্যালারি। তার দুর্দান্ত দিনে দলও তখন পৌঁছে যায় নিরাপদ জায়গায়।
২৭২ রানের লক্ষ্যে মারকাটারি শুরু পেয়েছিল জিম্বাবুয়ে। তরুণ সিফাস জুয়াও শুরু করেন আগ্রাসী ব্যাটিং। মিরাজকে দুই ছক্কায় উড়িয়ে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আক্রমণে এসেই থাকে থামান মোস্তাফিজুর রহমান। অভিজ্ঞ ব্র্যান্ডন টেইলর আবার হতাশ করেন সফরকারীদের। নাজমুল ইসলাম অপুর বাঁহাতি স্পিনে ৫ রানেই কুপোকাত তিনি।
অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজা নিয়েছিলেন দায়িত্ব। রয়েসয়ে খেলছিলেন। ৩৪ বলের ইনিংসে মেরেছেন একটাই মাত্র চার। ক্রেইগ আরভিনের সঙ্গে ভুলবোঝাবুঝিতে থামে তার ২১ রানের ইনিংস।
জিম্বাবুয়েকে আশা দেখাতে পারেননি দলে ফেরা সিকান্দার রাজা। ধুকতে ধুকতে ২২ বলে ৭ রান করেছেন। দারুণ এক বলে তাকে বোল্ড করেন নাজমুল। এরপর আর কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি জিম্বাবুয়ের ইনিংস। শুরুতে মার খাওয়া মিরাজ পরের স্পিলে এসে পান তাল। ৩ উইকেট নিয়ে মাসাকাদজাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন তিনি। এরপর হারের ব্যবধান কমানো ছাড়া জিম্বাবুয়ের করার ছিল না কিছুই।
নবম উইকেটে কাইল জার্ভিসকে নিয়ে ইনিংস সর্বোচ্চ জুটি গড়ে খেলা লম্বা করেছেন শেন উইলিয়ামস। ৬৭ রানের জুটিতে নবম ব্যাটসম্যান জার্ভিসের অবদান ৩৬ রান। উইলিয়ামস শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৫০ রানে। তবে তাতে ম্যাচের ফলে কোন ভূমিকাই নেই।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ : ২৭১/৮ (৫০) (লিটন ৪, ইমরুল ১৪৪, ফজলে ০, মুশফিক ১৫, মিঠুন ৩৭, মাহমুদউল্লাহ ০, মিরাজ ১, সাইফুদ্দিন ৫০, মাশরাফি ২*, মোস্তাফিজ ১; জার্ভিস ৪/৩৭, চাতারা ৩/৫৫, ত্রিপানো ০/৬০, মাভুটা ১/৪৮, সিকান্দার ০/৩৭, উইলিয়ামস ০/৩২)
জিম্বাবুয়ে: ২৪৩/৯ (৫০) (মাসাকাদজা ২১, জুয়াও ৩৫ , টেইলর ৫, আরভিন ২৪, রাজা ৭ , উইলিয়ামস ৫০ , মুর ২৬, ত্রিপানো ২, মাভুটা ২০, জার্ভিস ৩৭, চাতারা ২* ; মাশরাফি ০/৫৫, মিরাজ ৩/৪৩, মোস্তাফিজ ১/২৯, নাজমুল ২/৩৮, সাইফুদ্দিন, মাহমুদউল্লাহ ১/২৪, রাব্বি ০/১৬)
ফল: বাংলাদেশ ২৮ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: ইমরুল কায়েস।
Comments