৫,১৩০ কোটি টাকা মাত্র ও শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাত

হাজার কোটি টাকার নিচের দুর্নীতি বা জালিয়াতি, সংবাদ হিসেবে খুব একটা গুরুত্ব পায় না। সর্বশেষ জানা গেল জনতা ব্যাংক ও সরকারি খাত থেকে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে গেছে ৫,১৩০ কোটি টাকা। সরকার যে এই বিষয়টি নিয়ে বিব্রত বা চিন্তিত, তেমন কোনো বক্তব্য কারও থেকে পাওয়া যায়নি। জনতা ব্যাংকের মোট আমানতের দ্বিগুণ ৫ হাজার কোটি টাকার উপরে, একজনকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা জানা গিয়েছিল কিছুদিন আগে। এই ঋণ ফেরত পাওয়া যাবে কিনা, গবেষণা না করেও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। যে দেশের আর্থিক খাতের অনিয়মের পরিমাণ এত বড়, সেই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কিছু কথা।

১. সবাই জানি-বলি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই দুটি খাত যদি অবহেলিত থাকে, আর যাই হোক সেই দেশ এগুতে পারে না বা এগোয় না। শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতের বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। অর্থ বরাদ্দ বা বাজেট প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকব।

জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ ২%। আমরা শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে চাই। শিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে চাই। চাই মানবসম্পদ উন্নয়ন। এসবই আমাদের রাজনৈতিক বক্তৃতার বিষয়। বাস্তবে শিক্ষা খাতের উন্নয়ন চাইলে, অর্থ বরাদ্দ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সেই দেশের শিক্ষা খাতের বাজেট এত কম কেন? উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করে বলছি না। বলছি নেপালের সঙ্গে তুলনা করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে নেপালের বরাদ্দ ৩.৭%। বাংলাদেশের চেয়ে ১.৭% বেশি। পাকিস্তানের বরাদ্দও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ২.৬ %। মালদ্বীপ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে ৫.২%, ভারত ৩.৮%, শ্রীলঙ্কা ২.২%, ভিয়েতনাম ৫.৭%। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দই সবচেয়ে কম। ২০১৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট কমানো হয়েছে।

২. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা বলতে কিছু আছে, তা বলা বেশ মুশকিল। গবেষণার জন্যে শিক্ষার পরিবেশ তো বটেই, অর্থও প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই দুটি বিষয়েরই অনুপস্থিতি বড়ভাবে চোখে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ৬৬৪.৩৭ কোটি টাকা। প্রায় ২১০০ শিক্ষক, ৩৫০০০ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর বাইরে কর্মকর্তা কর্মচারী তো আছেই। গবেষণার বাজেট ১৪ কোটি টাকা। ফলে দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার অবস্থা কেমন, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। মোট বাজেটের বড় অংশটাই খরচ হয়ে যায় বেতন-ভাতা খাতে। শিক্ষার্থীদের হলে থাকা-খাওয়ার জীবন যাপনঅযোগ্য। প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা এর চেয়ে আলাদা নয়। কোনো কোনোটার অবস্থা আরও করুণ।

শিক্ষায়- গবেষণায় বরাদ্দ কমের কারণ যদি হতো অর্থের সীমাবদ্ধতা, তাহলে হয়ত মেনে নেওয়া যেত। বাস্তবে তা নয়। সুশাসনহীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে সবচেয়ে নিম্নমানের সড়ক- সেতু নির্মাণ করছি। সর্বশেষ জনতা ব্যাংকের দুর্নীতির টাকা দিয়েও ছয় বছর চলতে পারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সমস্যাটা অব্যবস্থাপনার, সমস্যাটা মানসিকতার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ভবন বানিয়ে তা উচ্চ শিক্ষার উন্নয়ন হিসেবে দেখছি।

৩. এবার আসি দেশের স্বাস্থ্য খাতে। নেপালের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কত জানেন? ২.৩%, পরিমাণে যা খুব বেশি নয়। তবে নেপালের অর্থনীতির চেয়ে তা কমও নয়। আলাদা করে নেপালের কথা বলছি, কারণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ০.৯%। নেপালের চেয়ে ১.৪% কম। মালদ্বীপ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে ১০.৮%। শ্রীলঙ্কা ২%, ভিয়েতনাম ৩.৮ %। দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্য খাতের বাংলাদেশের সমান বরাদ্দ শুধু পাকিস্তানের।

মালদ্বীপের এগিয়ে যাওয়ার রহস্য গবেষণা না করেও বোঝা যায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দেওয়া দেখে। নেপাল যে এগিয়ে যাওয়ার ধারায় রয়েছে, তাও বোঝা যায় এই দুটি খাত থেকে।

৪. এক সময় মানে বছর কুড়ি আগেও মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থী পড়তে আসত বাংলাদেশে। বাংলাদেশের লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এখন মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করে। ১৯৮৯ সালেও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল না মালয়েশিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা। এখন মালয়েশিয়া মেডিকেল ট্যুরিজমের বিজ্ঞাপন করে জানান দেয়, চিকিৎসা সেবায় তারা পৃথিবীতে তৃতীয়।

মালদ্বীপ থেকে এখন আর শিক্ষার্থী আসে না বললেই চলে। মেডিকেলের কিছু শিক্ষার্থী এখনও আসে নেপাল থেকে।

৫. বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমশ বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সবারই জানা আছে, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। সমস্যাটা যতটা ডাক্তারদের, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ব্যবস্থাপনার। এই ব্যবস্থাপনাটা নিয়ন্ত্রিত হয় দলীয় রাজনীতি দ্বারা, ডাক্তারদের দ্বারা নয়। সামর্থ্যরে চেয়েও বেশি সেবা ডাক্তাররা দেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে। কয়েক গুণ বেশি রোগী এবং ব্যবস্থাপনার নৈরাজ্যের কারণে ডাক্তারদের ‘কসাই’ হিসেবে পরিচিত করা হচ্ছে। গণমাধ্যম-ডাক্তার মুখোমুখি অবস্থানে। একটি দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামগ্রিক মূল্যায়ন করে ফেলা হচ্ছে।

সরকারি খাতে চরম নৈরাজ্য, বেসরকারি খাত স্বেচ্ছাচারী। সরকারের কোনো সুস্থ মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। ‘ডাক্তাররা খারাপ’ যত জোর দিয়ে বলা হয়, ব্যবস্থাপনা নিয়ে সেভাবে প্রশ্ন তোলা হয় না। বরাদ্দ অপ্রতুল, নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি। যার খুব কম অংশের সঙ্গে ডাক্তাররা জড়িত। ‘দেশে  চিকিৎসা নেই’- আওয়াজটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। ক্ষমতার দল, বিরোধীদল কারোরই আস্থা নেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর।

সাধারণ মানুষও এখন ছুটছেন ভারতে। ভারতের পর্যটনমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভারতে যান। এর মধ্যে বড় অংশটিই যান মেডিকেল ট্যুরিজমে।

৬. শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব না দিয়ে কোনো দেশ এগিয়ে গেছে, এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। পাশের নেপাল থেকে আফ্রিকার দরিদ্র দেশটিও শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। আমরা এগিয়ে যাওয়ার যে স্লোগান মুখে দিচ্ছি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য অবহেলিত রেখে, তা কি সম্ভব?

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

8h ago