বিবি’র ওপর ‘আস্থা’ রাখুন!
‘জার্মানি থেকে কিনে আনা মেশিন পিতলকেও স্বর্ণ হিসেবে দেখায়’- বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য।
বেয়াড়া মেশিনের ওপর নির্ভর না করে, প্রস্তর যুগে ফিরে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাথরে ঘর্ষণ দিয়ে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পাথর ঘষে স্বর্ণের মান যাচাই করছে। প্রকৃতির শিক্ষাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। মানুষের তৈরি মেশিনের ওপর আর নির্ভরশীলতা নয়।
এ জন্যে তারা ‘বিশ্বস্ত’ একজন স্বর্ণকার ঠিক করেছেন। যিনি কষ্টি পাথরে ঘষে স্বর্ণের ক্যারেট পরিমাপ করেন। এক কর্তা তা লেখেন। যাচাই-বাছাই করারও কেউ নেই বা রাখা হয়নি। ‘ছয় স্তরের’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে কথা। যত কম লোককে সম্পৃক্ত করা যাবে, ততো ভালো। যা কিছু ঘটবে ‘কেরানির ভুল’।
ডিজিটাল মেশিন নয়, স্বর্ণকারই ‘বিশ্বস্ত’! মেশিন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পক্ষে সাক্ষী দিতে পারত না। ‘বিশ্বস্ত’ স্বর্ণকার ঠিকই সাক্ষী দিয়ে বলছেন, স্বর্ণ ঠিকই আছে। ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ ১৮ ক্যারেট হিসেবে জমা রাখা হয়। এতে হয়ত নিলামে বিক্রির সময় কর্তাদের সুবিধা হয়।
কষ্টি পাথরে ঘষা দিয়ে স্বর্ণ রাখলে, যা রাখা হয় কখনো কখনো তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়- সাক্ষী দিয়ে বলেছেন ‘বিশ্বস্ত’ স্বর্ণকার!
২.
স্বর্ণ রাখার ভল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছয় স্তর বিশিষ্ট। টাকা রাখার ভল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থার স্তর নিশ্চয়ই আরও বেশি। বেশি যে তার প্রমাণ, টাকা চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা জানা গিয়েছিল ২০১৫ সালে। ভল্ট এলাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা চুরি করে ভেগে যাচ্ছিলেন দীপক চন্দ্র দাস। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছিলেন ইন্ডিয়ান স্টেট ব্যাংক থেকে। এত কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসি টিভির ফুটেজে ঠিকই তিনি ধরা পড়ে যান। এই প্রশ্ন এখানে মোটেই প্রাসঙ্গিক নয় যে, তিনি কী করে ভল্ট এলাকা থেকে টাকা চুরি করলেন! প্রাসঙ্গিক যে তিনি চুরি করে ধরা পড়েছেন। তাকে পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল কেন- সেই প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক খুব বড় মুখে বলা যে, ইন্ডিয়ান স্টেট ব্যাংক তাকে বহিষ্কার করেছিল বলে জানিয়েছিল। থানা-পুলিশ এগুলো ভালো কাজ নয়। ‘যাহা ভালো নয়, তাহা বাংলাদেশ ব্যাংক করিতে পারে না।’
তাছাড়া পুলিশের ব্যাপার আসলে, নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ-প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। সব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন নয়, বিশ্বস্ততা বা বিশ্বাসই মূল বিষয়- বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই এই নীতি অনুসরণ করে।
৩.
শুধু শুধু প্রশ্ন তোলা কিছু মানুষের বাতিক। বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রস্তর যুগে ফিরে গিয়ে কত ভালো কাজ করেছে, তা কিন্তু প্রমাণও হয়েছে। চিন্তা করে দেখেন ডিজিটাল ‘সুইফট’র ওপর নির্ভর করার কারণেই কিন্তু রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়ে গেছে। স্বর্ণের মতো টাকাও যদি ম্যানুয়ালি হ্যান্ডেল করা হতো, তাহলে এই চুরির সম্ভাবনা ছিল না। টাকা বস্তায় ভরে জাহাজে করে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে ‘হ্যাকার’রা চুরির সুযোগ পেত না। টাকা গণনার জন্যে মেশিনের ওপর নির্ভর না করে, মানুষের ওপর নির্ভর করার নীতির কথাও বাংলাদেশ ব্যাংক ভেবে দেখতে পারে। তাহলে কয়েকশ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
৪.
আস্থা এবং অনাস্থা- দুটি শব্দের অবস্থান পাশাপাশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ‘অনাস্থা’ শব্দটি উচ্চারণ করা ঠিক হবে না। আর শুধু ‘আস্থা’ নয়, যা কিছুই ঘটুক না কেন ‘বিশ্বাস’ও রাখতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি। শুল্ক ও গোয়েন্দা দপ্তর এক বছর ধরে অনুসন্ধান-তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে ছয় মাস আগে। একটি চিঠির উত্তর দেড় মাসেও দিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে কিছু যায় আসে না, শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের তদন্তকেও এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, বাংলা-ইংরেজির ভুল, কেরানির ভুল- তা বিশ্বাস করতে হবে। ‘পরিমাপক স্বর্ণকার ৪ কে ৮ লিখে ফেলেছে’- এটাই বিশ্বাস করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো এক কর্তা লিখেছেন, আমি নই- স্বর্ণকারের এই কথার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে বেশি বিশ্বাস রাখতে হবে। আস্থা এবং বিশ্বাসই শেষ কথা, তার প্রমাণ অর্থ প্রতিমন্ত্রীও দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের স্বর্ণ ঠিকই আছে’। যেখানে ‘বিশ্বাস’ থাকে সেখানে তদন্ত-অনুসন্ধান-যাচাই-বাছাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘বিশ্বাস’ না থাকলে কি সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলতে পারতেন ‘সোনা গায়েবের কোনো ঘটনা ঘটেনি’!
৫.
কোন দেশ কোন পদ্ধতিতে স্বর্ণ পরিমাপ করে, তাও বিবেচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করতে পছন্দ করে। এখন কেউ কষ্টি পাথর ব্যবহার করে না, আধুনিক মেশিনের ওপর নির্ভর করে- তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু যায় আসে না। প্রকৃতির পাথরই সবচেয়ে বেশি ‘বিশ্বস্ত’। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি ‘আস্থা-বিশ্বাস’ আরও মজবুত করার জন্যে ‘অনুসন্ধান-তদন্ত’ ‘যাচাই-বাছাই’ শব্দগুলো আগামী কয়েকদিন আলোচিত হবে। তৃতীয় পক্ষ বা তৃতীয় কোনো দেশ থেকেও তদন্তকারী আনার কথা ভাবা শুরু হয়েছে। রিজার্ভ চুরির পরেও আনা হয়েছিল। যাকে বা যে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ করানো হয়েছিল, সন্দেহের তালিকায় তিনি বা তার প্রতিষ্ঠানও ছিল। চুরির পর আবার গোপনে তাকেই আনা হয়েছিল। তারপর কী হলো? ‘বিশ্বাস’ যেখানে প্রধান, সেখানে এ প্রশ্ন অবান্তর। ড. ফরাসউদ্দিন আহমদ ও ড. কায়কোবাদের করা তদন্ত রিপোর্ট, কয়েকবার দিন তারিখ দিয়েও প্রকাশ করা হয়নি। কারণ রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও ‘প্রশ্ন’ সামনে আসবে।
‘আস্থা এবং বিশ্বাস’র প্রতি ‘বিশ্বস্ত’ থাকার নীতিতে ‘প্রশ্ন’ পরিত্যাজ্য।
Comments