‘হাতুড়ির নিচে জীবন’

Rajshahi attack
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতুড়ি নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে হামলাকারীরা। ছবি: স্টার

কবি বা কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় নয় এটা। আবার কবির কবিতাই তো সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এরশাদের সামরিক নিপীড়নের কালে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’। মাত্র তিন শব্দের বাক্য দিয়ে কবি যা বুঝিয়েছেন, লক্ষ শব্দ লিখেও তা বোঝানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। যখনই লেখা হোক, বহু বছর বা যুগ পরেও তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বারবার।

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গেও পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’।

কোটা সংস্কার বিষয়ে বহুদিন ধরে কিছু তর্ক চলছে। কিছু প্রশ্ন সামনে আনা হচ্ছে। আজকের লেখায় সেই সব সাধারণ কিছু প্রসঙ্গ- প্রশ্ন বিষয়ে দু’একটি কথা দিয়ে শুরু করি।

১. ‘কোটা বাতিল করা যাবে না। আমি কোটার পক্ষে। কোটা থাকতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে কোটা থাকতে হবে’- একথা বলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।

প্রথমত, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কোটা সংস্কারের দাবিকে যৌক্তিক মনে করার অধিকার যেমন আছে, অযৌক্তিক মনে করারও অধিকার আছে।

দ্বিতীয়ত, কোটা থাকবে না, বাতিল করতে হবে- এ কথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতরা কখনো বলেননি। যৌক্তিক শতাংশে কোটা থাকার কথাই তারা সব সময় বলে এসেছেন। কোটা বাতিলের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী কোটা থাকার কথাও তিনি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংসদে এবং সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য যদি কার্যকর হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, জেলা কোটা থাকবে না।

সুতরাং যারা বলছেন ‘কোটা থাকতে হবে, বাতিল করা যাবে না’- তাদের দাবি করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আন্দোলনকারীদের অবস্থান আর আপনাদের অবস্থানে কোনো পার্থক্য নেই, নেই সমালোচনারও কিছু।

২. ‘যারা আন্দোলন করছেন, তারাই শুধু মেধাবী? যারা কোটায় চাকরি পাচ্ছেন, তারা কি মেধাবী নয়? তারাও তো বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই চাকরি পাচ্ছেন। সুতরাং তারাও মেধাবী।’

প্রথমত, বিতর্কটা কে মেধাবী, কে মেধাবী নয়- তা নিয়ে নয়। যিনি কোটায় চাকরি পাচ্ছেন তিনি মেধাবী নন, সে কথাও কেউ বলছেন না। মেধার ভিত্তিতে চাকরি আর মেধাবী, এই দুটি বিষয় সচেতন বা অসচেতনভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হবেন, তাদের ভেতর থেকে মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করা হোক। একথা সত্যি যে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন সবাই (কোটা সুবিধা প্রাপ্তরাও) । পাশাপাশি আরও বড় সত্যি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একজন হয়তো ৩০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন না। আর কোটা প্রাপ্তজন হয়তো ৭০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন। শুধু বিসিএস পরীক্ষায় ৫৬ শতাংশ চাকরি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। এখানেই ‘মেধার ভিত্তিতে’ প্রসঙ্গ আসছে। কোটা প্রাপ্তজন মেধাবী নন, সেটা বলা হচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ৩০০তম জন অবশ্যই ৭০০তম জনের তুলনায় মেধাবী এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তারই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। যেহেতু সেটা ঘটছে না, সেহেতু দাবি তোলা হয়েছে ৫৬ শতাংশ নয়, কোটা ১০ বা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। এতে বৈষম্য কমে আসবে। আরও একটি তথ্য সবার জানা থাকা দরকার, ৫৬ শতাংশ কোটা শুধু বিসিএসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্ষেত্রে কোটা অনেক বেশি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন ক্যাডার চাকরিতে কোটা ৬১ শতাংশ। ৭০ শতাংশ কোটা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে। রেলওয়েতে কোটা ৮২ শতাংশ। ৯৬ শতাংশ কোটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।

৩. ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন তারা বিএনপি-জামায়াত। তারা সরকারবিরোধী। তারা শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।’- এই অভিযোগ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রীদের।

প্রথমত, গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা গত তিন মাস অনুসন্ধান করে কোটা  আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দের কারও বিএনপি বা জামায়াত সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। সুতরাং আন্দোলনকারীরা সবাই বিএনপি বা জামায়াত এই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, যে কোনো দাবি সরকারের কাছেই করতে হয়। সরকারের কাছে দাবি তোলা মানে সরকার বিরোধিতা নয়।

তৃতীয়ত, সরকারের বা সরকারের কাজের প্রতিবাদ করার অধিকার দেশের সব নাগরিকের আছে। একইভাবে সমর্থন করার অধিকারও আছে। সরকারের কাজের বিরোধিতা করা মানে দেশের বিরোধিতা করা নয়, সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাও নয়। সরকার আর দেশ বা রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

চতুর্থত, অস্থিতিশীল যে পরিবেশ তৈরি করা হলো, তার দায় কার? কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নেওয়ার তিন মাস পরও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। কবে হবে সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রজ্ঞাপন জারির কোনো অগ্রগতি নেই।

আন্দোলনকারীরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান জানান দিতে চেয়েছিলেন। তারা রাস্তায় নেমে আসেননি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকেননি, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেননি। সংবাদ সম্মেলনকারীদের উপর আক্রমণ করার অধিকার কারো নেই। যে অধিকার নেই, সেই অধিকার প্রয়োগ করে ছাত্রলীগ নুরুলদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এখানে ‘মারামারি’ হয়নি। শুধু ‘মারা’ হয়েছে। লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েছে। ছাত্রীদের সাথে অশালীন ব্যাবহার ও নির্যাতন করেছে।

আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে তার পক্ষে একটিও তথ্য বা প্রমাণ নেই।

প্রথমত, যে কোনো দাবি বা আন্দোলনের সঠিক প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা না করলে,বিরোধী দল সুযোগ নিতে চাইবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এই সুযোগ নিতে চাওয়ার দায় আন্দোলনকারীদের নয়। যদি বিরোধী দল কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেটা নিয়েছে সরকারের ভুল নীতির কারণে।

৪. শিক্ষার্থীদের জীবন চলে গেল হাতুড়ির নিচে, দেখার কেউ থাকল না। ছাত্রলীগ নেতা লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোটা আন্দোলনের নেতা তরিকুলের জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে। ভিডিওচিত্রে দানবীয়তা ধারণ করা আছে, এক্সরে রিপোর্টে আছে তরিকুলের টুকরো হয়ে যাওয়া পায়ের ছবি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মেরুদণ্ড।

‘হাতুড়ির নিচে জীবন’র কিছু খণ্ড চিত্র-

ক. তরিকুলকে রাজশাহী সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়নি। তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন তরিকুলের ভাই-বোন- বন্ধুরা।

খ. নুরুলকে ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা করা হয়নি। আনোয়ার খান মেডিকেলে আনা হয়েছে। মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নুরুল নিজেই গণমাধ্যমকে সেকথা বলেছেন।

গাজীপুরের কোনো একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। দরিদ্র বাবা জমি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় এসেছেন।

গ. সবাই গাজীপুর থেকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসেন। নুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। কোনো অপরাধ ছাড়া তাকে পিটিয়ে আহত করেছে। তার চিকিৎসার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিলো না। ঢাকা মেডিকেল বা বেসরকারি মেডিকেলে করতেও দিল না। তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে গাজীপুরে।

ঘ. ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন ও নিপীড়নের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ঙ. কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুককে শহীদ মিনারে লাথি- ঘুষি- পিটিয়ে অজ্ঞান করে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে গেছে। ভিডিওচিত্রে তা দেখা গেছে। একদিন পর জানা গেল ডিবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তুলে নিলো ছাত্রলীগ, পাওয়া গেল ডিবির কাছে!

চ. ‘আপনি কুলাঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়েছেন। আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে’- রাশেদের বাবাকে ফোন করে একথা বলা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেছেন রাশেদের বাবা।

জ. সাপ মারার মতো একজনকে দশ বারোজন মিলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত এবং লোহার হাতুড়ি দিয়ে রড সোজা করার মতো আঘাত করে পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রশাসন একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সহস্রাধিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৪ জন তরিকুলদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন। ভিসি এই ১৪ জনকে বলেছেন ‘সরকারবিরোধী’। তিনি বলেছেন, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষকরা সরকারের বিরোধিতা করছেন।

শিক্ষকরা যে মুক্তচিন্তা, মুক্ত কথা বলার অধিকার রাখেন, ৭৩’র অধ্যাদেশ তাদের সেই অধিকার দিয়েছে, ভিসি মহোদয় তা ভুলে গেছেন।

ঝ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিপীড়ন বা হামলা বিষয়ে প্রথম তিন দিনে কিছু জানেনইনি। ভিসি বলেছেন, গ্রেপ্তার ছাত্রদের দায় বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। ‘শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা’- বলেছেন শিক্ষক নেতা। বলেননি যে, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা বা তারা নিপীড়িত হলে তাদের দেখা শিক্ষকদের দায়িত্ব নয়। এমন বাক্য না বলেও তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দুই হাজারের অধিক শিক্ষকের মধ্যে নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন অল্প কয়েকজন শিক্ষক। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের পক্ষে শিক্ষক-আইনজীবী- সমাজকর্মীরা প্রতিবাদ করছেন।

৫. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম মানুষের সাংখ্য প্রায় ১১ কোটি। এর মধ্যে কাজ নেই প্রায় সাড়ে চার কোটি কর্মক্ষম মানুষের। অর্থনীতির অবস্থা ভালো, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’- এই চিত্রের মাঝেও কর্মক্ষম কোটি মানুষ বেকার।

যারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছেন, তারা এই  কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীরই অংশ। আন্দোলনকারীদের উপর হামলা যারা করছে, তারাও এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। মূল সমস্যা কাজের নিশ্চয়তার অভাব। বিনিয়োগ বা কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, কোটা বৈষম্য দূর না করে, হাতুড়ি পেটা করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দমন করা যাবে বলে মনে হয় না।

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram’s garment factories fear fallout from US tariffs

Owners of Chattogram-based readymade garment factories, many of which do business with buyers in the United States, are worried about a US tariff hike to 35 percent set to take effect on August 1.

11h ago