গাজীপুরে সুষ্ঠু না ‘চমৎকার নির্বাচন’?

নির্বাচনের আগে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা। ছবিটি টঙ্গীর মধুমিতা সড়কের। ছবি: আনিসুর রহমান

গাজীপুর নির্বাচন নাটকীয়ভাবে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর, নির্বাচন কমিশন নিজেরাই নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। সেই নির্বাচন আবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে, আর একদিন পর ২৬ জুন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা।

১. বাংলাদেশে কিছু ‘মার্কা’ খ্যাত নির্বাচন আছে। (সামরিক সরকারগুলোর সময়ের কোনো নির্বাচন হিসেবে ধরছি না)

তার মধ্যে বহু বছর ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে ‘মাগুরা মার্কা’ নির্বাচন। বিএনপি সরকারের এই ‘মাগুরা কলঙ্ক’ সম্ভবত সারা জীবন বহন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও বলেছেন ‘মাগুরা মার্কা’ নির্বাচন চাই না। তিনি বিএনপি সরকারের বিতর্কিত ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের নির্বাচনে মাগুরা ছাড়াও বিএনপি সরকারের সময়ের ঢাকা-১০, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের টাঙ্গাইল-৪ কাদের সিদ্দিকীর আসনের নির্বাচনও ‘মার্কা’ খ্যাত। হুবহু একই রকম ‘মার্কা’ খ্যাত না হলেও, বিগত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ। টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর পরাজিত হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন।

দলীয় নেতা-কর্মী এবং প্রশাসনের দেওয়া ভোটে বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন ফালু বিজয়ী হয়েছিলেন।

বিএনপি আমলের ‘মাগুরা’র সঙ্গে টাঙ্গাইলের এই নির্বাচনটির গুণগত তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। বিগত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দুপুরের আগে থেকেই আর ভোটারদের ভোট দিতে যেতে হয়নি। দলীয় কর্মী ও প্রশাসন কাজটি সম্পন্ন করে দিয়েছিল। ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিরোধে ভয়াবহ সহিংসতা হয়েছিল, এই তথ্য পুরোপুরি সত্য। সেই নির্বাচনে জনগণকে ভোট দিতে যেতে হয়নি, কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য হিসেবে এটাও সত্য।

বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয় ‘মাগুরা মার্কা’ বা ‘ঢাকা-১০ মার্কা’ নির্বাচন চান না। অর্থাৎ তারা নিজেদের ভোট পছন্দের প্রার্থীকে নিজেরা দিতে চান। বাংলাদেশের মানুষ টাঙ্গাইল-৪ কাদের সিদ্দিকীর আসনের মতো, সেই রকম নির্বাচনও চান না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন চান, একথা কারও বিশ্বাস করার কথা না।

২. এই যে মানুষের ‘চওয়া’ বা ‘না চাওয়া’ তা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গাজীপুর নির্বাচন খুলনার মতো হবে না। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, খুলনা সিটি নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়নি। অনিয়মের পরিমাণ অনেক কম মনে করলেও, অনিয়ম যে হয়েছিল তা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

নির্বাচনের পরপরই অনিয়মের অভিযোগ বিষয়ে কোনো তদন্ত না করে, নির্বাচন কমিশন বলেছিল ‘চমৎকার নির্বাচন’। নির্বাচন কমিশনের ওই বক্তব্যের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য সাংঘর্ষিক।

গাজীপুর সিটি নির্বাচন বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই। এ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ (সমকাল, ২১ জুন ২০১৮)।

খুলনার ঘটনা গাজীপুরে ঘটতে দিতে চান না প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু খুলনায় ঘটনা ঘটানো ‘দায়ী ব্যক্তি’র বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গাজীপুরের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

গাজীপুর নির্বাচন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএনপির স্থানীয় নেতাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। বাড়িতে বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গাজীপুরে গিয়ে বলে এসেছেন, কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিএনপি সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ করেছে। গণমাধ্যমেও প্রতিদিন গ্রেপ্তার অভিযানের তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। গাজীপুর থেকে বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার করে, অন্য জেলায় গ্রেপ্তার দেখানোর মতো অভিনব কৌশলের প্রয়োগ করছে পুলিশ।

নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা গ্রেপ্তার বিষয়ে গাজীপুর প্রশাসনের কাছে চিঠি লিখেছে। গ্রেপ্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়েছে। এই হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের ‘কঠোর ব্যবস্থা’!

খুলনার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রায় হুবহু একই ঘটনা ঘটেছিল। গ্রেপ্তার অভিযানে স্থানীয় বিএনপি নেতারা প্রায় কেউই নির্বাচনী কাজে অংশ নিতে পারেননি। গাজীপুরের ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দৃশ্যমান হচ্ছে। আর নির্বাচন কমিশন চিঠি লিখে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নিচ্ছে। নির্বাচন পরশুদিন, নির্বাচন কমিশন চিঠির উত্তর পাবে, তারপর ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেবে।

নির্বাচন সুষ্ঠু না হলেও ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে, মর্মে হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে, নির্বাচন কমিশন চিঠি লিখে জানতে চাইবে ‘কেন সুষ্ঠু হলো না’? দু’একজনকে হয়তো বদলি করবে। নির্বাচন ফলাফল সবই নির্ধারিত হয়ে যাবে। যার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ‘কঠোর ব্যবস্থা’র কোনো সম্পর্কই থাকবে না।

৩. গাজীপুরের পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে বিএনপি বহুদিন ধরে পক্ষপাতের অভিযোগ করে আসছে। একবার তাকে বদলি করা হলেও, আবারও ফিরে এসেছেন গাজীপুরে। পুলিশের গাড়িতে আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন, এমন ছবি প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। ‘কঠোর ব্যবস্থা’র হুশিয়ারি দেওয়া নির্বাচন কমিশনের নজরে তা পড়ার কথা নয়, পড়েওনি।

গাজীপুর পুলিশ প্রশাসনের একটি ঘটনা বলে লেখা শেষ করি।

গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়ি ঘেরাও করে। বাড়ির আশেপাশে অভিযান চালিয়ে কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ জনকে আটক করে। পাঁচ ছয় ঘণ্টা পর নোমানসহ ১২ জনকে ছেড়ে দেয়। সে রাতে গাজীপুরের এসপি একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলকে বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর করছিল। আবদুল্লাহ আল নোমানকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তার নিরাপত্তার জন্যে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ সেদিনের গাড়ি ভাঙচুর বিষয়ে গত ৯ মে দৈনিক প্রথম আলো একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে-

ক. গাড়ি ভাঙচুর মামলায় একটি লেগুনা জব্দ করা হয়েছিল। থানায় গিয়ে দেখা যায়, জব্দ করা লেগুনাটি অক্ষত। পুলিশ বলেছিল, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছিল।

খ. লেগুনার মালিক-চালক বলেছেন, কিছুই হয়নি।

গ. ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার জন্যে ১০৩ জনের নামে মামলা দেওয়া হয়েছিল। এই ১০৩ জনের মধ্যে ৪৮ জন ছিলেন বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির সদস্য।

৪. পুলিশ বলছে, যারা দাগি অপরাধী- যাদের নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, শুধু তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নয় জন বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে গাজীপুরের পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দুই জন গ্রেপ্তারের তথ্য তিনি জানেন। বাকিটা তার জানা নেই। কাদের নামে, কী ধরণের মামলা, গ্রেপ্তার- গাড়ি ভাঙচুর বিষয়ক মামলাটি থেকে অনেক কিছুই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

খুলনার নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে, নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি বিএনপি। নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্তরা গ্রেপ্তার হলে বা এলাকায় থাকতে না পারলে, তাদের পরিবর্তে কারা দায়িত্ব পালন করবেন, বিএনপির কোনো পরিকল্পনা ছিল না। অনেক কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারেনি। অনেক এজেন্ট প্রলোভনে পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। এই সব প্রতিকূলতা গাজীপুরেও আছে। বিএনপির কোনো কৌশল বা পরিকল্পনা আছে কি না, তা বোঝা যাবে ২৬ জুন।

সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। নিজের অর্থ-বিত্ত এবং প্রশাসনিক পূর্ণ সমর্থনই শুধু নয়, পুলিশের গাড়িতে উঠেও তিনি নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আশঙ্কা বা শঙ্কা যাই বলি না কেন, গাজীপুরেও আরেকটি ‘চমৎকার নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কি না, জনমনে সেই প্রশ্ন জেরালোভাবেই আছে।

ভোটার তার ভোট নিজে দিতে পারেন কি না, নির্বাচনটির পরিচিতি কি নারায়ণগঞ্জ বা কুমিল্লা মতো, না ‘মাগুরা মার্কা- ঢাকা-১০ মার্কা, টাঙ্গাইল-৪ মার্কা’ হবে, দেখা- জানার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র একদিন।

Comments

The Daily Star  | English
consensus commission bicameral parliament proposal

Consensus commission: Talks stall over women’s seats, upper house

The National Consensus Commission proposed establishing an upper house comprising elected representatives from each district and city corporation, and suggested abolishing the current system of reserved seats for women in parliament.

4h ago