মেয়েদের ওড়ার আকাশ বিস্তৃত করবে কি বিসিবি
সামাজিক বাধা-বিপত্তি তো আছেই। আছে অর্থনৈতিক সমস্যা, হরহামেশা মেলে না খেলার সুযোগও। এত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মাঠে নেমে দুই-একটা জয়ই বাহবা পাওয়ার মতো। সেখানে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল গোটা একটা টুর্নামেন্ট জিতে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এতদিন ছেলেরাও যা পারেনি, করে দেখিয়েছে তেমন কিছু। এমন জয়ের পর মিলেছে বেশ মোটা অংকের বোনাস। বেরিয়ে এসেছে এতদিনের আর্থিক বঞ্চনার করুণ চিত্র।
বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়া কাপ জেতার পরই ফেসবুকে একটি তুলনামূলক তালিকার ছবি খুব ঘুরছে। যেখানে বিসিবির চুক্তিভুক্ত ছেলে ও মেয়ে ক্রিকেটারদের বেতন কাঠামো দেওয়া আছে। ছেলেদের থেকে মেয়েদের বেতন প্রায় ১৩ গুণ কম। তা দেখেই মানুষের প্রশ্ন, কেন এত তফাৎ? ছেলেদের ক্রিকেট থেকেই বিসিবির সব আয় আসে, সত্য। এই হিসেবে তারা বেশি পাবেন এটাও বাস্তবতা। তাই বলে মেয়েদের বেতন-ভাতা কেন এত কম?
অতি উৎসাহী কেউ কেউ অবশ্য ছেলেদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়েও ট্রল করছেন। মেয়েদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি করতে ছেলেদের নিয়ে তেতো কথা বলা অশোভন। অসংখ্য খারাপ খবরের ভিড়ে ক্রিকেটারদের সাফল্যেই বারবার দেশকে এনে দিয়েছে স্বস্তি। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের বড় বিজ্ঞাপনও তারা। খারাপ সময় এলেই হুটহাট সব বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার রীতি তাই সুখকর নয়।
২.
এশিয়া কাপ নিয়ে দেশে ফেরার পর মেয়েদের মোট দুই কোটি টাকার বোনাস দিতে যাচ্ছে বিসিবি। প্রত্যেক খেলোয়াড় পাবেন ১০ লাখ টাকা করে। সেরা পারফর্মারদের জন্য থাকছে আরও বাড়তি পাওনা। স্পন্সর রবি ধরিয়ে দিয়েছে একটি করে আইফোন। এমন সব ঘোষণা ইতিবাচক। কিন্তু এই বোনাসের পরে,অন্য সবকিছু কি আগের মতই চলবে?
১৭ জন নারী ক্রিকেটারকে চুক্তিতে রেখেছে বিসিবি। তিন ক্যাটাগরিতে তাদের সর্বোচ্চ বেতন ৩০ হাজার, সর্বনিম্ন ১০ হাজার। ভারতীয় মেয়েদের বেতন এরচেয়ে ১৮গুণ বেশি। বোনাসের ঘোষণা চটজলদি দিলেও বেতন বাড়ার ব্যাপারটি বিসিবি প্রধান পাঠিয়েছেন পর্যালোচনার টেবিলে, ‘তামিম-সাকিব-মুশফিক এদের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। তবে তারা যে সাফল্য এনেছে তাতে করে প্রচুর মেয়েরা খেলায় আসতে উৎসাহী হবে সেজন্য ওয়ার্কিং কমিটি দুই দিনের মধ্যে ঠিক করবে তাদের আরও কি কি সুবিধা বাড়ানো যায়।’
সাকিব-তামিমদের সঙ্গে তুলনা না করলেও বিসিবি প্রধান মেয়েদের তুলনা করছেন তুষার ইমরানদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে। দীর্ঘদিন জাতীয় দলের আশেপাশে না থাকা তুষার খেলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে চুক্তিভুক্ত হওয়ায় ম্যাচ ফির বাইরে কিছু মাইনে পান তুষাররা। বোর্ড প্রধানের সুর, ‘তুষার ইমরান এত দিন থেকে খেলছে, তার কি অবদান নেই। তার থেকে তো বেশি পাচ্ছে মেয়েরা।’
সাকিব-তামিমদের সঙ্গে সালমা-জাহানারার সঙ্গে তুলনা করতে কেউ বলেনি। কিন্তু তুষার ইমরানের বেতনের সঙ্গে জাতীয় দলের মেয়েদের বেতনের তুলনাও বেমানান। মেয়েদের বেতন বাড়ার কথা উঠলেই বাস্তবতার কথা শোনান বোর্ড কর্তারা। বিসিবির উইমেন উইংসের চেয়ারম্যান শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের কদিন আগে বলেছিলেন, ‘মেয়েদের খেলায় ওইভাবে স্পন্সর আসে না। স্পন্সর না এলে টাকা পাওয়া যায় না। তারপরও আমি বোর্ডে এ নিয়ে কথা উঠাচ্ছি। সামনে আমাদের সিরিজ আছে। সেখানে মেয়েরা ভালো পারফরম্যান্স করতে পারলে আমি আরও শক্তভাবে প্রস্তাবটা উঠাতে পারব।’
মেয়েরা মাঠে পারফরম্যান্স করে দেখিয়েছে। কাজটা এবার বিসিবির টেবিলে। এক লাফে আকাশচুম্বি না করুন, অন্তত বেতন আরও ভদ্রস্থ করার যথেষ্ট সামর্থ্য বিসিবির আছে।
২.
বেতন বাড়ার সঙ্গে আছে খেলা বাড়ার ব্যাপারও। এবার এশিয়া কাপের আগে মেয়েরা খেলে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তার আগে ১৪ মাস কাটিয়েছে ঝিমিয়ে, ছিল না কোন খেলা। বিসিবির একাডেমিতে সারাক্ষণ লেগে থাকা ছেলে ক্রিকেটারদের ভিড়ে অনুশীলনের সুযোগও মেলেনি অতটা। এবার অবশ্য সামনে আয়ারল্যান্ড সফর আছে, আছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইয়ের খেলা। আগামীতেও এরকম খেলা চালু না রাখলে উন্নতি ধরে রাখা মুশকিল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের মেয়েরা খেলতে শুরু করেছে এই সেদিন। ২০০৬-০৭ সালের আগে বাংলাদেশে তেমন গুরুত্ব পায়নি মেয়েদের ক্রিকেট। আইসিসি মেয়েদের খেলা নিয়ে সিরিয়াস হওয়াতেই চাপ বাড়ে বিসিবির উপর। ২০১১ সালে বাংলাদেশ নারী দল পায় ওয়ানডে স্ট্যাটাস। ২০১২ সালে শুরু টি-টোয়েন্টি খেলা। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির অভিষেকেই বাংলাদেশ হারিয়েছিল আয়ারল্যান্ডকে। কেবলমাত্র পোক্ত ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো থাকলেই মিলতে পারে টেস্ট মর্যাদাও।
৪.
মেয়েদের খেলা থেকে হয়ত এখনি আসবে না বড় আয়। তবে একটি অগ্রসর দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পারে মেয়েদের খেলাধুলা। উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রেক্ষপটটা আরও জটিল। সামাজিক ট্যাবু ভেঙে এখানে খেলতে বের হওয়া চট্টিখানি কথা নয়। শারীরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা তো আছেই, আছে অর্থনৈতিক সংকট। এতগুলো হার্ডলস পেরুনোর প্রচণ্ড মনোবলও দেখাতে হয় মেয়েদের। সব পেরিয়ে তারা যখন ডানা মেলছে, তাদের ওড়বার আকাশ আরেকটু বিস্তৃত করার দাবি খুব বড় চাওয়া নয়।
এশিয়া কাপ নিয়ে দেশে ফিরে অধিনায়ক সালমা খাতুন অবশ্য সব ছেড়ে দিয়েছেন বিসিবির উপর, ‘যেহেতু আমরা ভালো একটা ফল করেছি, এখন বোর্ড চিন্তা করবে আমাদের জন্য কি করা যায়। তারাই চিন্তা করবেন আমাদের জন্য কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়। আমাদের কিছু বলার নেই। সিদ্ধান্ত নেবে বোর্ড।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছেলে-মেয়ে মিলিয়েই বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা এটি। ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা মেয়েদের এই জয়কে দেখছেন আরেকটি বাঁক বদল হিসেবে। ৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জেতানোর সময় হাসিবুল হোসেন শান্ত যে দৌড় দিয়েছেন, ব্যাটল হাতে নিয়ে সে দৌড়েই দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন মাশরাফিরা। মাশরাফির বিশ্বাস ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ জেতার সময় সালমা-জাহানারার দৌড়ও আর থামবে না। এগিয়ে যাওয়ার এই দৌড় চলতে বিসিবির কাছে চাওয়া খুব সামান্য, কেবল পথটা মসৃণ করুন।
Comments