জোসেফ-বিকাশদের মুক্তি এবং আইনের শাসন

রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ

বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলোর অন্যতম ‘সংবিধান’ এবং ‘আইনের শাসন’।

‘সংবিধান মানতে হবে’ ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’- কথাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির খুব পরিচিত শব্দ। আইন, আইনের শাসন, আইনের ব্যাখ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু কথা।

১. জোসেফের নাম জানেন না, এমন মানুষ বাংলাদেশে আছেন বলে মনে হয় না। জোসেফ নামে না চিনলেও ‘সন্ত্রাসী জোসেফ’ নামে সবাই চিনবেন। জোসেফ কত মানুষকে হত্যা করেছে, সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের মামলা হয়নি, হলেও তাতে জোসেফেরে নাম ছিল না। মামলা যে সব হত্যাকাণ্ডে হয়েছিল, তার একটিতে ফাঁসির রায় হয়েছিল জোসেফের। হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছিলেন। আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। বিশেষ বিবেচনায় দণ্ড মওকুফের আবেদন করা হয়েছিল। জোসেফের মায়ের আবেদনে জেল দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। ‘জোসেফ অসুস্থ’- চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যেতে চেয়েছিল। রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। গত ২৭ মে অত্যন্ত গোপনে জেল থেকে জোসেফকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া চলে যাওয়ার পর সংবাদটি গণমাধ্যম জানতে পেরেছে।

জোসেফের জেল দণ্ড মওকুফ, বিদেশে চলে যাওয়া বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব কিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে।’

এত বড় সন্ত্রাসীর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তারও কারণ আছে। বড় কোনো অসুখ ছাড়া টানা ২০ মাস কারাগার থেকে হাসপাতালে এনে এসি কেবিনে রাখা হয়েছিল জোসেফকে। গণমাধ্যম বিশেষ করে দৈনিক প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশ করে ঝামেলা করেছিল। জোসেফকে কারাগারে ফিরিয়ে নিতে হয়েছিল। জোসেফের মাসের পর মাস হাসপাতালে থাকার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছিল, ‘সব কিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে।’

সন্ত্রাসী জোসেফের বড় ভাই হারিস, জোসেফের চেয়েও বড় সন্ত্রাসী। স্বৈরাচার এরশাদের পুরো সময়কালে জাতীয় পার্টির শেল্টারে দোর্দণ্ড প্রতাপে মানুষ হত্যাসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ধারণা করা হয় সে এখন ভারতে পালিয়ে আছে। আরেক ভাই সাঈদ আহমেদ টিপুও সন্ত্রাসী ছিল। ১৯৮৯ সালে সন্ত্রাসীর গুলিতে সে নিহত হয়।

২. আরেকজন সন্ত্রাসী বিকাশের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ঘটনা, যেন সৃজনশীল গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ।

২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে কাশিমপুর কারাগারের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো এক যুবক। চোখে সানগ্লাস। ভোর থেকে তার জন্যে কারাগারের সামনে অপেক্ষা করছিল চারটি প্রাডো জিপ। ছয়টি মোটরসাইকেল। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুজন বসা। কালো গ্লাসের জিপে কে বা কারা বা কতজন ছিল, জানা যায়নি। সানগ্লাস পরিহিত যুবক একটি জিপে উঠল। চারটি জিপ, ছয়টি মোটরসাইকেল জিপগুলোর আগে-পিছে। রাস্তা থেকে আরও তিনটি গাড়ি বহরে যোগ দিল। ১৫ বছর জেল খেটে জামিনে যে বেরিয়ে গেল, তার নামই বিকাশ। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বিকাশ।

 

কয়েকটি তথ্য-

ক. দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেওয়ার আগে জেলা পুলিশকে বিষয়টি জানাতে হয়। এটাই রীতি। বিকাশের মুক্তির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।

খ. সকাল ১০টা থেকে সূর্যাস্তের আগে কারাগার থেকে বন্দি মুক্তি দেয়াটাই রীতি। বিকাশকে ছাড়া হয়েছে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে।

গ. জেল গেটের রিসিপশনে সিসি ক্যামেরা আছে। বিকাশ জেল থেকে বেরিয়েছে, কিন্তু সিসি ক্যামেরায় তা ধারণ করা নেই।

ঘ. একটি সূত্রানুযায়ী, তখন ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়েছিল। আরেকটি সূত্রানুযায়ী, বের হয়ে যাওয়ার পরপরই ওই অংশটুকু মুছে দেয়া হয়।

৩. বিকাশের মুক্তির সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, আদালত জামিন দেওয়ায় বিকাশ মুক্তি পেয়েছে।

সেই সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সঙ্গে কারাগারে পরিচয় হয়েছিল বিকাশের। কারাজীবনের কঠিন সময়ে বিকাশ নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে।

হত্যাসহ ১২টি মামলার ছয়টিতে অব্যাহতি এবং ছয়টিতে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হয় বিকাশ। চলে যায় বিদেশে। বিকাশের ভাই প্রকাশও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। প্রকাশ প্যারিসে থাকে। ধারণা করা হয় বিকাশও এখন প্যারিসে থাকে।

বিকাশের মুক্তির ব্যাখ্যাতেও বলা হয়েছিল, ‘সব কিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে।’

৪. ত্বকীর কথা মনে আছে অনেকেরই। নারায়ণগঞ্জের ত্বকী। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাফিউর রাব্বীর সন্তান ত্বকী। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয়েছিল। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া গিয়েছিল ৮ মার্চ। পুলিশি তদন্তের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেছিলেন ত্বকীর বাবা। হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব। তদন্ত করেও। র‍্যাব তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর এবং তয়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি। সুলতান-শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের পুরো বর্ণনা দেয়। ২০১৪ সালে র‍্যাবের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে আজমেরি ওসমানের নেতৃত্বে। অভিযোগপত্রও চূড়ান্ত হয়েছে। যেকোনো দিন দেওয়া হবে।

র‍্যাব অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জে আজমেরী ওসমানের একটি টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছিল। সেই টর্চার সেল থেকে রক্তমাখা শার্ট, লাঠিসহ অনেককিছু উদ্ধার করেছিল।

আজমেরি ওসমান প্রয়াত জাতীয় পার্টির এমপি নাসিম ওসমানের বড় ছেলে। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমান।

২০১৪ সালের মার্চের পর অনেকগুলো মার্চ মাস চলে গেছে। আজমেরি ওসমান কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে আবার নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসেছে। ত্বকীর বাবা-মায়ের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে। অভিযোগপত্রের দেখা মেলেনি।

সব কিছু ‘আইন অনুযায়ী চলছে’ তদন্তও।

৫. সাগর-রুনী হত্যার কত বছর হলো? একবারে উত্তর তার সহকর্মীরাও সম্ভবত দিতে পারবেন না, হিসেব করে বলতে হবে।

মাদকবিরোধী অভিযানে গত ১৬ দিনে ১২২ জন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে তারা সবাই ‘মাদক চোরাচালানি’। মারা গেছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’। এর মধ্যে আসলে কতজন ‘মাদক চোরাচালানি’ নিরপেক্ষ কোনো অনুসন্ধান এখনও হয়নি। অন্তত দুজনের তথ্য জানা গেছে, কাউন্সিলর একরামুল ও হাবিবুর রহমান মাদক চোরাচালানি ছিল না। তাদের পরিবার অভিযোগ করেছেন, একারামুল প্রতিপক্ষ এবং মোশারফকে সোর্স ভুল তথ্য দিয়ে হত্যা করিয়েছে। অন্য ১২০ জনের মধ্যে অনেকের পক্ষে কথা বলার হয়তো লোকও নেই।

অপরাধী বা মাদক চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবস্থা নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। ‘যেহেতু এদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না, সে কারণে মানুষ “বন্দুকযুদ্ধে” হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে’- কী অদ্ভুত যুক্তি।

এক্ষেত্রেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব কিছু আইন অনুযায়ী হচ্ছে’।

৬. বিএনপি সরকার সুইডেন প্রবাসী ফাঁসির আসামি জিন্টুর দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছিল। লক্ষ্মীপুরের তাহেরপুত্র বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড, জেলদণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন আগের রাষ্ট্রপতি। জিন্টুও মানুষ হত্যা করেছিল, বিপ্লবও। আদালতে তা প্রমাণ হয়েছিল।

হত্যার দায়ে দণ্ডিত অপরাধীদের ফাঁসি-জেল দণ্ড মওকুফ করে দেওয়া দেশেই তো ‘সংবিধান’ ‘আইনের শাসন’ বা ‘সব কিছু আইন অনুযায়ী হচ্ছে’- শব্দগুলো বেশি আলোচিত হওয়ার কথা!

Comments

The Daily Star  | English

No sharp rise in crime, data shows stability: govt

The interim government today said that available data does not fully support claims of a sharp rise in crimes across Bangladesh this year

1h ago