প্রবাসী নারী কর্মীরাও ‘রেমিটেন্স মেশিন’!
একক দেশ হিসেবে সৌদি আরবেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ থাকেন। তারাই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান। সৌদি আরবে কত বাংলাদেশি আছেন, সরকার বা কারও কাছে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা হয় ২৫ থেকে ৩৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন সৌদি আরবে। এর একটা বড় অংশ মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে থেকে যান। যারা ‘অবৈধ’ হিসেবে পরিচিত। সৌদি আরব তাদের বৈধতার সুযোগ দিচ্ছিল না। নতুন কর্মী নেওয়াও বন্ধ রেখেছিল। উল্টো ধরে ধরে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। বলছি সৌদি আরবের পুরুষ কর্মীদের কথা। সৌদি আরবের নারী গৃহকর্মীদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কিছু দেশ। ২০১৫ সালে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভারত, শ্রীলঙ্কাও তাদের নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। কেন, কী কারণে বন্ধ করে সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
১. সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীর তীব্র সংকট শুরু হয়। এই সময় বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব নারী গৃহকর্মী নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। বিনিময়ে ‘অবৈধ’ পুরুষ কর্মীদের বৈধতার সুযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বন্ধ থাকা কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে চায়। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির পর ২০১৫- ২০১৮ সালের এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে গেছেন। ২০০৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত যেখানে গিয়েছিল মাত্র ১২৬০ জন। যাওয়ার সংখ্যা বাড়ার চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে নিপীড়ন- পাশবিক নির্যাতন।
যাওয়ার পর থেকেই কিছু সংখ্যক নারী কর্মী ফিরে আসতে শুরু করেন। ফিরে আসার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়ছে।
২. ফিরে আসছেন সহায়-সম্বলহীনভাবে। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে কীভাবে বাড়িতে পৌঁছাবেন, সিএনজি অটোরিকশা বা বাস ভাড়ার সামান্য কিছু টাকাও তাদের কাছে থাকছে না। নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন। হারানোর হাহাকার আর চোখের পানি ছাড়া, আর কিছু থাকছে না তাদের কাছে। কোনো দিন ২১ জন, কোনো দিন ৪০ জন ফিরে আসছেন। অনেকের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করে তাদের সৌদি আরব পাঠিয়েছিল। ফিরে আসার সময় বিমানবন্দরে সরকারের কোনো প্রতিনিধি থাকছেন না। থাকছেন কিছু বেসরকারি সংগঠনের কর্মী। সাধ্যমতো সহায়তা করার চেষ্টা করছেন তারা।
যারা ফিরে আসছেন তাদের অভিযোগ-
ক. বাসায় আটকে রেখে কাজ করানো হয়েছে। অধিক পরিশ্রম করানো হয়েছে।
খ. ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয়নি। তরকারি ছাড়া দিনে একটি শুকনো রুটি ছাড়া আর কিছু খেতে দেওয়া হতো না।
গ. বাইরে বের হওয়া বা মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ ছিল না।
ঘ. মারধর করা হতো নিয়মিত।
ঙ. শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, বিশেষ করে পাশবিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা।
চ. পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পালাক্রমে যৌন নিপীড়ন করেছেন। বাবা-ছেলে বা অন্য পুরুষ আত্মীয় কর্তৃক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
ছ. যে পরিমাণ বেতনের কথা বলে নেওয়া হয়েছিল, যাওয়ার পরে দেখেছেন বেতন কম। যেমন ১০০০ রিয়াল পাবেন জেনে গেছে, গিয়ে জেনেছেন ৭০০ বা ৮০০ রিয়াল পাবেন।
জ. বেতন নিয়মিত দেওয়া হয় না। ফিরে আসার সময় বেতন পাননি। খালি হাতে ফিরেছেন।
৩. প্রবাসী নারী গৃহকর্মীদের এই অভিযোগ বিষয়ে বিস্ময়কর রকমের নীরবতা পালন করেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। নারী কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি মন্ত্রণালয়কে। সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার নারী কর্মীদের অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন, ‘যারা দেশে ফিরছেন, তাদের অধিকাংশই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন না। বরং দেশে ফিরে নির্যাতনের গল্প বানাচ্ছেন।’
গত ২২ মে ২১ জন নারী কর্মী সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। এ বিষয়ে সচিব নমিতা হালদার বলেছেন, ‘তাদের কোনো ধরনের নির্যাতন করা হতো না। দেশে ফিরে তারা গল্প বানায়।’
সচিবের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রবাসী নারী কর্মীদের বিষয়ে সরকারের মনোভাব পরিষ্কারভাবে বোঝা গেছে। বাংলাদেশ মনেই করছে না যে, নারী কর্মীরা সৌদি আরবে শারীরিক-মানসিক, আর্থিক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
৪. মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্যের বাইরেও সরকারের আরেকটি অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি লেখে। সৌদি আরবে যাওয়া নারী কর্মীদের নিপীড়ন-যৌন নির্যাতন বাড়ছে, সেকথা লিখে জানানো হয় মন্ত্রণালয়কে। নারী কর্মী সৌদি আরবে পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব জানায় দূতাবাস। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী কর্মীরা পালিয়ে দূতাবাসের আশ্রয় কেন্দ্রে আসছেন। আশ্রয় কেন্দ্রে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। আরও আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। পাশবিক নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তার জন্যে একজন নারী কনস্যুলর নিয়োগ দেয়ারও সুপারিশ করা হয় দূতাবাস থেকে লেখা চিঠিতে।
প্রথমত: দূতাবাসের মনোভাব উপেক্ষা করে নারী কর্মী পাঠানো অব্যাহত রাখে মন্ত্রণালয়।
দ্বিতীয়ত: সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী ‘নির্যাতনের শিকার’ হচ্ছেন না। ‘গল্প বানাচ্ছেন’- আর দূতাবাসের অবস্থান পরস্পর বিরোধী। দূতাবাস সৌদি আরবে অবস্থান করে জেনেছেন-দেখেছেন নির্যাতনের চিত্র। আর ঢাকায় বসে সচিব বলছেন, নির্যাতনের কাহিনী সত্য নয়।
৫. ফিরে আসি ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া প্রসঙ্গে। ফিলিপাইনের একটি সংসদীয় দল সৌদি আরবে যায়। এখন বাংলাদেশি কর্মীদের নির্যাতনের যে কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে। সেই সময় ফিলিপাইনের কর্মীদের নির্যাতনের এমন কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছিল। ফিলিপাইনের সংসদীয় দল দেশে ফিরে সরকারকে জানায়, নারী কর্মীদের নির্যাতন-নিপীড়ন-যৌন অত্যাচারের কাহিনী সত্য। নারী কর্মী সৌদি আরবে না পাঠানোর জন্যে তারা সুপারিশ করে। ফিলিপাইন সরকার সেই সুপারিশ মেনে ২০১৫ সালে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়। হত্যার অভিযোগে ইন্দোনেশিয়ার দুই জন নারী গৃহকর্মীর শিরশ্ছেদ করে সৌদি আরব। ইন্দোনেশিয়া তদন্ত করে দেখে, যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্যে তারা হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই শিরশ্ছেদের প্রতিবাদে ইন্দোনেশিয়া নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ আরও কিছু দেশ নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়। সেই সময় নারী গৃহকর্মী সংকটে পড়ে সৌদি আরব। তখন তারা বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী তথা গৃহকর্মী নিতে চায়।
৬. সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের জানা ছিল। দেশের ভেতর থেকে মূলত দু’একটি গণমাধ্যম নারী কর্মী পাঠানোর বিরোধিতা করেছিল। সরকার চুক্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ আরও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাস্তবে সেসব চুক্তি-সমঝোতা-নিরাপত্তা কোনোটাই মেনে চলেনি সৌদি আরব। বাংলাদেশ কখনোই সৌদি আরবের সঙ্গে নির্যাতনের এই আলোচনা বা নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেনি বা করতে পারেনি। পালিয়ে যারা দূতাবাসের আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে, তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু করেনি। বকেয়া বেতন আদায়, নির্যাতনের প্রতিবাদ কোনো কিছুই করতে পারেনি বাংলাদেশ।
৭. এখন স্বীকারই করা হচ্ছে না যে, নিপীড়ন-নির্যাতন হয়। গত কয়েক সপ্তাহে ফিরে আসা সাত আটজন কর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছি। পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছি। যা শোনা-লেখা কোনোটাই করা যায় না। অবর্ণনীয় বললেও খুব কম বলা হয়। অনেকে ফিরছেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে।
এখানেই শেষ নয়। তিনজনকে পেয়েছি একজনের স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হননি। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এই মানসিকতায়। একজনের বাবা, একজনের চাচাও তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে রাজি হননি। তাদের ভাষায় ‘নষ্ট’ হয়ে ফিরে এসেছেন। এমন সংখ্যা কম নয়। সৌদি আরবে গিয়েছিলেন নিজের এবং পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর আশায়। ফিরেছেন নিঃস্ব হয়ে। পাশে নেই পরিবার। রাষ্ট্র তো কোনো দায়িত্ব না নিয়ে, অসত্য বলছেন বলে অভিযুক্ত করছে।
সবাই যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, বিষয়টি তেমনও নয়। দেশের মানুষের পারসেপশনে এটা স্থান করে নিয়েছে। ভালো করে বাঁচার আশাটা যে কত বড় দুরাশায় পরিণত হয়েছে, যারা ফিরে এসেছেন তাদের দেখে-শুনে জেনে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছি। যারা এখনও আটকে আছেন সৌদি আরবে, নিপীড়িত-নির্যাতিত হচ্ছেন, তাদের কথা ভাবার কেউ নেই।
আর একটি কথা, বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের নিপীড়নের কাহিনী শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের এসব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।
৮. বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশের জন্যে খুব জরুরি। কিন্তু নারীর সম্মান-নিরাপত্তাও কম জরুরি নয়। স্বাধীন দেশ তাদের নাগরিকদের সম্মান-নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। প্রত্যাশা করি, অনুরোধ করি মাননীয় দেশ পরিচালকেরা, ‘গল্প বানানোর’ গল্প না বলে সত্যটা অনুধাবন করে এসব নারীদের পাশে দাঁড়ান। যত কথাই বলেন, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ সৌদি আরবের আইন সৌদিদের জন্যে, প্রবাসী বা নারী গৃহকর্মীদের জন্যে নয়। সৌদি আরবের সঙ্গে সমান সক্ষমতায় কথা বলার মত অবস্থাতেও নেই বাংলাদেশ।
ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত কেউ তার নারী কর্মীদের রক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশ তার নারী গৃহকর্মীদের রক্ষা করতে না পারলেও, ফিলিপাইন- ইন্দোনেশিয়াকে অনুসরণ করতে পারে।
মাননীয় নীতি- নির্ধারকেরা, প্রবাসী বা নারী কর্মীদের টাকার মেশিন হিসেবে বিবেচনা করবেন না। আর কিছু না পারেন, তাদের প্রতি একটু মানবিক হন, একটু সংবেদনশীলতা দেখান দায়িত্বশীল পদে বসে। সৌদি আরবে তারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, নিজের দেশের মানুষকে-নারীকে আপনারাও অসম্মান করবেন না। প্রবাসীদের মানুষ হিসেবে দেখুন, রেমিটেন্স মেশিন হিসেবে নয়।
Comments