মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ শ্রমিক থেকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার
জীবন কখনো কখনো ভোজবাজির মতো পাল্টে যায়। ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ তৈরি করেন কেউ কেউ। তবে সালাউদ্দিন শাকিলের গল্পটা শোনলে চোখ কপালে তোলে অনেকে বলতে পারেন, তাই বলে এতটা? মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছিলেন শ্রমিক। মরু ঝড় কিংবা রুক্ষ দুর্গম পাহাড়ের মধ্যেও করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম। বছর চারেক প্রবাসে কাটিয়ে দেশে ফিরে হয়ে গেলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার। সালাউদ্দিন এখন খেলছেন দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
চলতি বিসিএলে ২৮ বছর বয়সে অভিষেক হয় সালাউদ্দিনের। এর আগে খেলেছেন এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগেও। এক দশক আগেও তার কাছে যা ছিল অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতন।
বাঁহাতি এই পেসার প্রথম শ্রেণির অভিষেকে পান ২ উইকেট। তার আগে প্রিমিয়ার লিগে ৫ ম্যাচে ৬ উইকেট। খুব একটা আহামরি কোন পারফরম্যান্স নয়। তবে শারীরিক গড়ন আর ম্যাচে প্রভাব রাখার মতো বল করে এরমধ্যেই নজর কেড়েছেন দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোচদের।
রাজশাহীতে বিসিএলের শেষ রাউন্ডের প্রথম দিনের খেলা শেষে মুঠোফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে সালাউদ্দিন শুনিয়েছেন নিজের গল্প।
দুবাই, আজমাইন, আলাইন, রাস-আল –কিমাহ। আরব আমিরাতের এসব এলাকায় ঘুরে ঘুরে চার বছর কাজ করেছেন তিনি। রড ঝালাই দিয়ে ফ্যাক্টরির জন্যে ছাপরা ঘর বানাতে হত। কষ্টের সেই কাজের পরিবেশও ছিল ভীষণ প্রতিকূল। নিচে তপ্ত বালি, মাঝে লোহা উপরে প্রতাপশালী সূর্য, ‘শিপ ইয়ার্ড থেকে মজবুত লোহা নিয়ে আসা হত। আমাদের এসব ঝালাই দিতে হত ছাপরা ঘরের জন্যে। কাজটা ছিল খুব কঠিন। মরু ঝড় উঠত, গরমে খাবার পচে যেত। আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম এই কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার।’
মরু এলাকায় ভোর চারটায় কাজে বেরুতেন। পলিথিন ব্যাগে নিয়ে যেতেন ভাত। মরু ঝড় শুরু হলে তাও যেত উড়ে। কখনো কখনো তাপমাত্রা চড়ত ৫০ ডিগ্রিতে। খাবার নষ্ট হয়ে গেলেও ওটাই গেলা ছাড়া উপায় থাকত না।
সালাউদ্দিনের বিদেশ যাত্রা ২০০৫ সালে। তখন সবে দশম শ্রেণিতে উঠেছেন। এসএসসি পরীক্ষার আগেই মধ্যপ্রাচ্যে ভাগ্য বদলে পাড়ি দেওয়া শ্রমিক বনে যান তিনি, ‘ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় ঝোঁক থাকায় পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলাম না। পরিবার ভাবল বিদেশ গেলেই হয়ত ভালো হবে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হলো।’
দেশে থাকতে টেপ টেনিসে খেলতেন। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পর এসব কিছুই শিকেয় উঠে, ‘আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু পরিবারের কথা চিন্তা করে যেতেই হয়।’
দুবাইয়ে চার বছরের শ্রমিক জীবনের কঠিন লড়াইয়ের দিনে ক্রিকেট ব্যাট বল স্পর্শ করার সুযোগ পাওয়ার কথা নয়, সেটা হয়ওনি। তবু ওই আবদ্ধ জীবনেও মনের গহিনে ছিল ক্রিকেট, মুক্তির জন্য মন করত ছটফট, ‘ওখানে তো অনেক কাজ করতে হয়, খেলার তো প্রশ্নই উঠে না। তবে তখনো মনের ভেতর স্বপ্ন ছিল একদিন ক্রিকেটার হবোই।’
মনের গহিনের সেই স্বপ্নই হয়ত তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে তাকে। ২০০৯ সালে খরচ বাঁচাতে কোম্পানি ছুটিতে দেশে পাঠিয়ে দিলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন তিনি, ‘দেশে ফেরার পর বাবা মারা যান। পরিবারের বিপদ, তখন বড় ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হলে আমাকে দেশেই থাকতে বলা হয়। ওই সময় খেলার প্রতি আবার আগ্রহ শুরু। ’
দেশে দুই তিন বছর বেকার থাকার পর ২০১২ সালে ফের টেপ টেনিস খেলা শুরু করেন। ‘খ্যাপ’ খেলে দুই-তিন হাজার টাকা পেতেন। পরিবারকে বুঝিয়ে ক্রিকেটে কিছু একটা করার দিকে মন দেন, তখনই প্রথম হাতে নেন ক্রিকেট বল, ‘প্রথমে তৃতীয় বিভাগ দিয়ে শুরু। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগ খেলি নারায়ণগঞ্জ একাডেমির হয়ে। ২০১৪ সালে ইনজুরির কারণে খেলতে পারিনি। ২০১৫ সালে ইন্দিরা রোডের হয়ে প্রথম বিভাগ খেলি, আমার বন্ধু মেহেরাব হোসেন জোসি তখন প্রিমিয়ারে খেলে। সে-ই আমাকে ব্যবস্থা করে দেয়। ওই বছর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের লিগে আমি সেরা বোলার হই গত বছরও ইন্দিরা রোডে খেলেছি।’
সালাউদ্দিন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে এসেছেন কোচ মিজানুর রহমান বাবুলের হাত ধরে। গত প্রিমিয়ার লিগে ফতুল্লায় প্রাইম দোলেশ্বরের নেটে বল করছিলেন তিনি। দোলেশ্বর কোচ মিজানুর খেলোয়াড়ি জীবনে নিজেও ছিলেন পেসার। বাঁহাতি সালাউদ্দিনের কদর বুঝতে তাই দেরি করেননি, ‘সে নেট বোলার হিসেবে এসেছিল। তার শারীরিক গড়ন আর গতি দেখে আমার মনে ধরে যায়। যদিও এখনো নিখুঁত নয় তবে আমার মতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ সে।’
‘তার পেছনের কথা আমি জানি। আমার বিশ্বাস কঠোর পরিশ্রম করার সামর্থ্য তার আছে।’
প্রিমিয়ার লিগে খেলানোর পর বিসিএলেও তার খেলার ব্যবস্থা করে দেন মিজানুর। মধ্যাঞ্চলের কোচ ওয়াহিদুল গনিকে বলে পঞ্চম রাউন্ডের ম্যাচ খেলতে সালাউদ্দিনকে পাঠিয়ে দেন রাজশাহীতে।
কোচদের আনুকূল্য পাচ্ছেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে টিকতে হলে এখন দরকার নিবিড় অনুশীলন। এতে সালাউদ্দিনের একাগ্রতার কমতি নেই। বাড়তি যে মনোবলটুকু দরকার তা খুঁজেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দেখে। সময়টা হয়ত পেরিয়ে গেছে অনেক। তবু নিজের সেরাটা ঢেলে আরেকটু উঁচুতে যাওয়ার ইচ্ছেটা তার প্রবল।
Comments