গেইল ঝড়ে ঢাকাকে গুড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন রংপুর
শেষ ওভার। ঢাকার যা রান দরকার তা উল্লেখ্য করাও অপ্রয়োজনীয়। উইকেটে শেষ দুই ব্যাটসম্যান। নিশ্চিতভাবেই ম্যাচ জিতে গেছে রংপুর। মাশরাফি তাই বল তুলে দিলেন ব্যাটিং হিরো ক্রিস গেইলকে।বল করতে জানেন তিনি। তবে অনেকদিন তা করা হয় না। মুক্ষোম সুযোগ পেয়ে হাত ঘুরিয়ে দিলেন ২ রান। শেষ বলটি করে স্টাম্প তুলে দুহাত উঁচিয়ে ধরেন গেইল, দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন মাশরাফি। ৫৭ রানের জয়, চ্যাম্পিয়ন গেইলে চ্যাম্পিয়ন রংপুর রাইডার্স, ফুটছে বাজি।
মঙ্গলবার রাতে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে রংপুরের ২০৬ রানের পাহাড়ের নিচে ঢাকা ডায়নামাইটসের দৌঁড় থেমেছে ১৪৯ রানে। প্রথমবারের মতো বিপিএলের শিরোপা জিতে নিয়েছে রংপুর রাইডার্স।
ফাইনালে কোন টানটান উত্তাপ নেই, নেই স্নায়ুচাপ। তবে আবার ম্যাড়ম্যাড়েও বলা যাবে না। হাজার হাজার দর্শকদের যে একাই বিপুল আনন্দ দিয়েছেন বিনোদনের ফেরিওয়ালা ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল।
২০১২, ২০১৩, ২০১৫, মাঝে ২০১৬ কেবল বাদ। ২০১৭ তে আবার। বিপিএলের পাঁচ আসরের চারবারই শিরোপাজয়ী অধিনায়কের নাম মাশরাফি মর্তুজা। আলাদা তিন দলকে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসরের সেরার মুকুট জিতিয়ে সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি নিজেকে তুললেন আরও উপরে।
রংপুরকে কাপ জেতাতে নক আউট পর্বের জন্যই বোধহয় সব জমা করে রেখেছিলেন গেইল-ম্যাককালাম। এলিমিনেটর ম্যাচ দিয়ে শুরু গেইল ঝড়ের। মাঝের কোয়ালিফায়ার ম্যাচে ঝড় তুলেছিলেন চার্লস-ম্যাককালাম। ফাইনালে রংপুরের সবচেয়ে দামি দুই তারকা একসঙ্গে দেখা দিলেন স্বরূপে। ম্যাককালাম রয়েসয়ে খেললেও বোলারদের উপর দয়ামায়াহীন তাণ্ডব চালিয়েছেন ক্রিস গেইল। টস হেরে আগে ব্যাটিং পেয়ে যেন পোয়াবারো মাশরাফিদের। তুরুপের সেরা দুই তাস তাদের এনে দেয় দুশো ছাড়ানো সংগ্রহ। গেইল অপরাজিত থেকেছেন ১৪৬ রানে। সঙ্গী ম্যাককালামের ব্যাট থেকে আসে ৫১ রান।
গেইল ঝড়ের পর শিরোপা উৎসবের জন্য তৈরি হয়েই ছিল রংপুর। ঢাকা কেমন জবাব দেয়, দেখার বাকি ছিল ওটুকুই। হয়নি কিছুই। বিশাল রানের নিচে চাপা পড়ে সারাক্ষণ হাঁসফাঁস করেছে ঢাকার ইনিংস। বোর্ডে বিশাল রান নিয়ে তেতে থাকা রংপুরের বোলাররা শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে রীতিমতো গুড়িয়ে দিয়েছে। একশো রানের মধ্যে ৭ উইকেট হারানোর পর কেবল পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়েছেন জহুরুল ইসলাম। আউট হয়েছেন ঠিক ৫০ রান করে।
টস হেরে আগে ব্যাটিং পেয়ে শুরুটা ভাল ছিল না রংপুরের। আগের দিনের সেঞ্চুরিয়ান জনসন চার্লস এদিন শুরু থেকেই ছিলেন নড়বড়ে। সাকিবের বল চালাতে গিয়ে লাইন মিস করছিলেন। টানা চার বলে পরাস্ত হওয়ার পর পঞ্চম বলে ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে সোজা ক্যাচ তুলে দেন সাকিবেরই হাতে। দ্বিতীয় ওভার মেডেন উইকেট নেন ঢাকা অধিনায়ক। পুরো ইনিংসে এই একটাই সাফল্য ঢাকার।
পরের ওভার থেকেই গা ঝাড়া দিতে থাকেন ক্রিস গেইল। তার ব্যাট থেকে আসছিল বাউন্ডারি। তবে আউট হতে পারতেন দ্রুতই। মোসাদ্দেকের বলে প্রথম ছক্কা মারার পরই দিয়েছিলেন সহজ ক্যাচ। ২২ রানে গেইলের এক্সট্রা কাভারে দেওয়া ওই ক্যাচ ফেলে দেন অধিনায়ক সাকিব। পরের বলেই আরেক ছক্কায় নতুন জীবণ উদযাপন করেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং দানব। স্ট্রাইক পেয়ে ম্যাককালামও ওই ওভারে মারেন আরেক ছক্কা। ৬ষ্ঠ ওভারে ১৯ রান নিয়ে রানের চাকায় প্রথম গতি সঞ্চার রংপুরের। তবু এই দুজন ক্রিজে থেকেও প্রথম ১০ ওভার থেকে আসে মাত্র ৬৩ রান। কিন্তু এরা থিতু হলে কি হতে পারে শেষের ১০ ওভার দেখেছে মিরপুর। শেষ ৬০ বলে ১৪৩ রান করে দলকে তারা নিয়ে যান ২০৬ রানের চূড়ায়।
মূলত তান্ডব চালিয়েছেন গেইলই। চার মারায় কখনোই মন নেই তার। এদিনও তাই। পুরো ইনিংসে মেরেছেন মাত্র ৫টি চার। ছক্কা তিনগুণেরও বেশি, মোট ১৮টি। টি-টোয়েন্টির এক ইনিংসে এত ছক্কার রেকর্ড আর নেই। অবস্থা এমন যে, গেইলের ছক্কা বৃষ্টিতে মাথা বাঁচাতে ছাতা দরকার ছিল গ্যালারিতে। কে রংপুরের সমর্থক, কে ঢাকার, গেইল ঝড়ে ফারাক করার উপায় নেই, উচ্ছ্বাস গ্যালারিজুড়ে। নির্ভেজাল দর্শক হয়ে অমন ইনিংস চাক্ষুস করাও ত বিরাট ব্যাপার।
গেইলকে আর থামানো যায়নি। ৫৭ বলে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে বাকি ১২ বলে করে ফেলেন আরও ৪৬ রান। ইনিংসের শেষ বলটিও পাঠিয়েছেন সীমানার বাইরে।
ওদিকে ছক্কা পেটানো গেইলের পাশে ম্যাককালামকে মনে হচ্ছিল ম্লান। গেইলকে সঙ্গ দিয়ে ব্যাট করে তিনিও পেয়ে টানা দ্বিতীয় ফিফটি। ৫ রানে উইকেট খুয়ানোর পর আর বিচ্ছিন্নই হননি তারা। গড়েন বিপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের জুটি। সর্বোচ্চ জুটির আগের জুটিটি হয়েছিল একদিন আগে। সেখানেও ছিলেন ম্যাককালাম। চার্লসের সঙ্গে গড়েছিলেন ১৫১ রানের জুটি। এবার গেইল-ম্যাককালাম জুটিতে এল ২০১ রান। তাতে ম্যাককালামের অবদান মাত্র ৫১।
২০৭ রান তাড়ায় তাগদ দেখানোর মতো রসদ জমা ছিল ঢাকার ডাগআউটে। তবে গেইল ঝড়েই কিনা হকচকিয়ে গেল সব। রান তাড়া দূরে থাক প্রথম পাঁচ ওভারেই ঢাকার ইনিংস যেন ধংস্বস্তুপ। একে একে ফিরলেন মেহেদী মারুফ, জো ডেনলি, এভিন লুইস আর কাইরন পোলার্ড। ২৯ রানেই নেই চার উইকেট। তাতে জোড়া আঘাত সোহাগ গাজীর। বাকি দুটি মাশরাফি আর রুবেলের পকেটে।
জহুরুল ইসলাম অমিকে নিয়ে ইনিংস মেরামতে নেমেছিলেন সাকিব। তাতে রানের চাকাও থাকছিল সচল। তাদের ৪২ রানের জুটি থামিয়েছেন নাজমুল ইসলাম অপু। ২৬ রান করা সাকিব বোল্ড হয়েছেন অপুর বলে। খানিকপরই মোসাদ্দেকের হতাশার টুর্নামেন্ট শেষ হয়েছে বোপারার বলে। এমন ম্যাচে শহিদ আফ্রিদির দিকে চোখ থাকে কারো কারো। আফ্রিদি করতে পারেননি কিছুই। অপুর বাঁহাতি স্পিনে খাবি খেয়ে ৮ রানেই বিদায় নেন তিনি। ৮৭ রানে ৭ উইকেট নেই ঢাকার। খেলার তখনো প্রায় ১০ ওভার বাকি। কিন্তু ফল নিয়ে সামান্য দ্বিধাও তখনই উধাও।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
রংপুর রাইডার্স: ২০৬/১ ( চার্লস ৩, গেইল ১৪৬*, ম্যাককালাম ৫১* ; মোসাদ্দেক ০/৩২ , সাকিব ১/২৬ , নারিন ০/১৮, আফ্রিদি ০/২৮, আবু হায়দার ০/২৬, খালেদ ০/৩৯, ০/৩৩)
ঢাকা ডায়নামাইটস:.১৪৯/৯ ( মারুফ ০, লুইস ১৫ , ডেনলি ০, সাকিব ২৬,পোলার্ড ৫,জহুরুল ৫০, মোসাদ্দেক ১,আফ্রিদি ৮,নারিন ১৪,আবু হায়দার ৯*,খালেদ ৮* ; মাশরাফি ১/২৫, গাজী ০/৩২, রুবেল ১/২৮, বোপারা ১/২১, উদানা ২/২৫, নাজমুল ২/৮ গেইল ০/২)
টস: ঢাকা ডায়নামাইটস
ফল: রংপুর রাইডার্স ৫৭ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ফাইনাল: ক্রিস গেইল।
Comments