মোগলাই ঈদ
মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় এবং প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। পৃথিবীর সব মুসলমান সারা বছর ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন এই দিনটির জন্য। পুরো রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ঈদের পবিত্রতাকে ধরে রাখেন পৃথিবীর সব মুসলমান। ঈদ মানেই আনন্দ আর উৎসব। পৃথিবীর সব দেশেই ঈদের দিনটি আনন্দের সঙ্গে পালন করেন মুসলমানরা। মুসলিমপ্রধান দেশ ছাড়াও বিশ্বের নানা দেশে বসবাসকারী মুসলমানরাও এই ঈদুল ফিতরের উৎসব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেন। বিশ্বের কোথাও কোথাও নারী-পুরুষ একত্রে ঈদ উৎসব পালন করে থাকেন। এসব দেশের ঈদ উৎসবের ছবি দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে উৎসব কতটা বিস্তৃত হতে পারে।
বাংলাদেশেও ঈদের দিনটি থাকে খুবই উৎসবমুখর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উপলক্ষে মেলার আয়োজনও করা হয়। নানা ধরনের খেলাধুলা এবং শিশুদের চিত্রাঙ্কনেরও ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। দিনব্যাপী এসব অনুষ্ঠান চলে। ফলে প্রকৃত অর্থে ঈদের পুরো আনন্দ তারা উপভোগ করে থাকেন। কোনো কোনো দেশে উটকে নানা সাজে সজ্জিত করে ঈদকার্ড তৈরি করা হয় ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। বাংলাদেশেও ঈদকার্ড দেয়ার একটা প্রচলন আছে। ছোট বয়সের ছেলে-মেয়েরা এই আনন্দে শামিল হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদের দিনটিকে বহুল আনন্দময় করে তোলার জন্য নানা বয়সের মেয়েরা বাহারি সাজে উৎসবে যোগদান করেন। বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর চিত্র সংবলিত নানা রঙের অসংখ্য বেলুন আকাশে উড়িয়ে থাকেন এসব মহিলা। নানা ধরনের পসরা নিয়ে মহিলারা মেলায় হাজির হন। কাগজ, তালপাতা ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও দর্শনীয় সামগ্রী তৈরি করে উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলেন তারা। এরূপ নানাধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঈদের দিনকে প্রকৃত উৎসবের দিনে পরিণত করা হয় বিশ্বের অন্যান্য সব দেশে। আমেরিকার নিউইয়র্কে অবস্থিত লং আইল্যান্ডের বিশাল ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ম্যানিলা, চায়না, ফালুজা, গাজা স্ট্রিপ, কায়রো এবং তিউনিসিয়াসহ অসংখ্য দেশে নানাভাবে ঈদকে উৎসবমুখর করে তোলা হয়। আর এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবার সহযোগিতা থাকে। বাংলাদেশে ঈদের দিন এসব আচার-অনুষ্ঠান কিছুটা কমই দেখা যায়। মূলত ঈদের দিনটিতে সরকারি ছুটি থাকার কারণে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করতে দেখা যায় না। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক উৎসব আয়োজন করতে দেখা যায়। ২০১৫ সালের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের একটি চিত্রে দেখা যায়, বিপুল দর্শকের উপস্থিতিতে একজন মেয়েকে দীর্ঘ বাঁশ হাতে দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে। বিপুল দর্শকের উপস্থিতি উৎসবের ব্যাপকতা প্রমাণ করেছে এই চিত্রে। এসব উৎসব, ঈদ জামাত এবং ঈদের শোভাযাত্রা মূলত মোগল আমলের পরমপরাগত উৎসবেরই অংশ। বাংলাদেশেও এই একই দৃশ্য দেখা যায় প্রতি বছর।
বাংলাদেশে ঈদের ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়। উপমহাদেশে ঈদের প্রচলন শুরুই করে মোগলরা। মোগলদের বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ঈদের দিন আমাদের দেশে এখন সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন হিসেবে পালন হচ্ছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে ঈদের জাঁকজমক ধীরে ধীরে বেড়েছে।
মোগলদের আগে বাংলায় ঈদের প্রচলন তেমন ছিল না। মোগল সম্রাটরা আসার পর ঈদ পালন করার আনন্দ পান মুসলমানরা। মোগলদের ঈদ উদযাপনের ইতিহাস এবং বর্তমান যুগে তার প্রভাব নিয়ে অনেকের অনেক মতবাদ। সব মিলিয়ে ঈদকে এতটা বর্ণিলভাবে উপভোগের সুযোগ করে দেয়ার জন্য মোগলদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
প্রাচীন ইতিহাস
সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের নাম ঈদুল ফিতর। মোগলদের আগমনের আগে বাংলায় ঈদের দিনের খুব একটা মর্ম ছিল না। মোগলরা আসার পর থেকেই ঈদকে উৎসব রূপে দেখতে পায় উপমহাদেশের সব মুসলিম। আগে ঈদুল ফিতর উল্লেখিতভাবে পালন না করার পেছনে কিছু কারণ খুঁজে বের করেন বিশিষ্ট লেখক মুনতাসির মামুন। তার কথা মতে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসিত তখনকার সমাজে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব বড়দিনকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হতো। খুব ধুমধাম করে পালন করা হতো বড়দিন বা ক্রিসমাস। এই দিনে সরকারি ছুটিরও ব্যবস্থা ছিল। কলকাতার বাইরে মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যদিও এই অনুষ্ঠানের কোনো যোগসূত্র ছিল না। তখন উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সমপরিমাণ খ্রিস্টানও ছিল। আর ব্রিটিশদের শাসনামল ছিল বিধায় খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবগুলোই পালন করা হতো। সে সময় খুব জমকালোভাবে হিন্দু ধর্মের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা পালন করা হতো। মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ। তাই তাদের ধর্মীয় উৎসবের মর্যাদাও ছিল কম। ঈদের ছুটির তুলনায় পূজার ছুটি ছিল বেশি। ঈদের ছুটি বাড়ানোর আবেদন করলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি সে যুগের মুসলমানরা।
ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য নিম্নবিত্ত মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে হালকা আনন্দ-উৎসবের ব্যবস্থা করত। তাছাড়া তখন সাধারণ মানুষের ধর্ম এবং ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে জানা ছিল খুব কম। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ উদযাপিত না হওয়ার পেছনে আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। এসব ক্ষেত্রেও মোগলদের অনেক বড় অবদান রয়েছে। মোগলরা প্রত্যেক প্রদেশে মক্তব গড়ে তুলেছিলেন সঠিক কোরআন ও ইসলামী আইন শিক্ষা দেয়ার জন্য। সেই চারশ’-পাঁচশ’ বছর আগে উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মকে সঠিক রূপে প্রচার করেন মোগলরাই।
মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতা
মোগল আমলে ভারতে ঈদের দিনের ইতিহাস সম্পর্কে লেখা পাওয়া গেছে বিভিন্ন বইপত্রে। সে সময় ঈদ এবং ঈদের অনুষ্ঠানকে সরকারিভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো। মোগল সম্রাজ্যে যেসব অনুষ্ঠান হতো সেসব অনুষ্ঠানের আবার চিত্রাঙ্কনও করা হতো। সে আমলের বিভিন্ন চিত্রে ফুটে ওঠে সে সময়ের উৎসবের ঘনত্ব। এমনই একটি চিত্রে প্রথম মোগল সম্রাট বাবরকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তারা রাজ দরবারের সভাসদকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়। সম্রাট বাবর একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান ছিলেন। তার জীবনে ধর্ম ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সব মোগল সম্রাটকেই ঈদের নানা উৎসব পালন করতে দেখা গেছে। এসব তথ্য ইতিহাসে যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্পী অঙ্কিত চিত্রেও। মোগল সম্রাজ্যের শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি উদার হৃদয় সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তার ইংরেজ অফিসার টমাস মেটকাফেকে দিয়ে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করিয়েছেন। যেগুলো ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করেছে।
তাবাকাৎ-ই-নাসিরীর লেখক ঐতিহাসিক মিনহাজ উস সিরাজ জানিয়েছেন, সুলতানরা রমজান মাসে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। ধর্ম প্রচারক নিযুক্ত করতেন এ কাজের জন্য। বাংলাদেশে ঈদের সবচেয়ে পুরনো বর্ণনা পাওয়া যায় মির্জা নাথানের লেখায়। ঈদুল ফিতরের সময় তিনি ছিলেন বোকাই নগরে। তার লেখার ভিত্তিতে জানা যায় সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় যখন নতুন চাঁদ দেখা যেত, তখন শিবিরে বেজে উঠত শাহি তুর্য অর্থাৎ রণশিঙ্গা এবং একের পর এক গোলন্দাজ বাহিনী ছুড়তে থাকত গুলি যেন তা আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলত এ আতশবাজি। শেষ রাতের দিকে বড় কামান দাগানো হতো। কামানের তীব্র শব্দে ভূকম্প অনুভূত হতো।
অধ্যাপক আবদুর রহিম বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মুসলমান ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে ঈদের বিবরণ তৈরি করেছেন। তিনি যা লিখেছেন তা অনুযায়ী বলা যায় বাংলাদেশে মোগল সৈন্যদের ছাউনি থেকে ঈদের আনন্দবার্তা ঘোষণা করা হতো। এতে প্রকাশ পায় কীভাবে মুসলমানরা ঈদ উৎসবকে স্বাগত জানাত এবং এই আনন্দ-উৎসবে আমোদ-প্রমোদ করত এবং এর জন্য শুকরিয়া আদায় করত। ঈদের দিন মুসলমানরা সব বয়সের নারী-পুরুষ ও ছেলে-মেয়েরা সুন্দর নতুন কাপড় পরত। মুসলমানরা সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রা করে ঈদগাহে যেত। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা উৎসবের সময়ে মুক্তহস্তে অর্থ ও উপহারাদি পথে ছড়িয়ে দিতেন।
মোগলরা বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের পর মুসলমান ধর্ম অনেক এগিয়ে যায়। ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আগত মোগলরা ইসলাম সম্পর্কে অনেক বেশি জানতেন। কিন্তু তারা বিশুদ্ধ ধর্ম পালনে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। ঈদ মানেই খুশি, বলা আছে ইসলাম ধর্মে। তাই তখন মোগলরা রমজানের প্রথম থেকেই চেষ্টায় থাকত ঈদের খুশিকে আয়ত্ত করে নিতে। তাদের জন্য তখন সুরা পান করাতেও ছিল একধরনের আনন্দ। কিন্তু এসব আনন্দ সীমাবদ্ধ ছিল শুধু উচ্চবিত্ত মোগলদের মধ্যে। তার মানে এই নয় যে, নিম্নবিত্তদের আনন্দ-উৎসবের ব্যবস্থা ছিল না। নিচু শ্রেণির মুসলমানদের জন্যও আনন্দ-উৎসবের সুব্যবস্থা করেছিলেন তখনকার মোগল অধিপতিরা।
মোগলরা ঢাকায় আসায় উৎসব হিসেবে ঈদ পালন করা হতে থাকে। দিল্লি থেকে এত দূরে উৎসব করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাইতেন না মোগলরা। ফলে ঈদ উদযাপনটা হয়ে ওঠে অধিক আনন্দময়। মোগলদের ঈদ উদযাপন হতো দু-তিন দিন ধরে। চলত সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন। আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন নিয়ে একরকম মেলাই বসে যেত। তখনকার ঈদ উদযাপনের চিত্র পাওয়া যায় সুবেদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জা নাথানের বর্ণনা থেকে। যদিও তিনি সে সময়ে বোকাই নগরে ছিলেন। তার বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, তখনকার ঢাকাতেও মোগলরা খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে ঈদ উদযাপনের আয়োজন করতেন। সুবেদার ইসলাম খান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাবাইচের ব্যবস্থা করতেন। এ সময় স্বয়ং সুবেদার ইসলাম খান উপস্থিত থাকতেন।
শাহ সুজা শিয়া মতাবলম্বী হওয়ায় তিনি ঢাকায় আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনশ’ শিয়া পরিবার। এদের আগমনে ঢাকার অভিজাত শ্রেণির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। তাদের কল্যাণে সাংস্কৃতিকভাবে ঢাকা আরো মার্জিত হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে ধরে নেয়া যায় ঈদ উদযাপনেও আরো চাকচিক্যের সংযোজন ঘটে। এসব উৎসবে ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতি থাকত না বললেই চলে। জানা গেছে, দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁর সময় জয় করা হয়েছিল ত্রিপুরা। তখন ঈদের দিন নবাব খুশি হয়ে গরিবদের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করার আদেশ দেন। ঢাকার কেল্লা থেকে এক ক্রোশ দূরে ঈদগাহ যাওয়ার পথে রাস্তায় ছড়ানো হয়েছিল এই মুদ্রা। কিন্তু পরবর্তীতে ঈদের দিন এভাবে গরিবদের মধ্যে মুদ্রা বিতরণের কথা আর জানা যায়নি।
ঈদগাহ
মোগল আমলের সবচেয়ে বড় ঈদগাহের নিদর্শন এখনো দৃশ্যমান। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় অবস্থিত মোগল স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর অন্যতম এই ঈদগাহ। ধানমন্ডি ঈদগাহটি দৈর্ঘ্যে ১৪৫ ফুট ও প্রস্থে ১৩৭ ফুট। ৪ ফুট উঁচু করে ভূমির ওপরে এটি নির্মিত হয়, যাতে বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তিন ধাপের মিম্বর ঈদগাহের উত্তর পাশে রয়েছে, এখানে দাঁড়িয়ে ইমামরা নামাজ পড়ান। ঈদগাহটি চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রথমদিকে এখানে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মোগল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই নামাজ পড়তে পারতেন, সাধারণ নগরবাসীরা এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। পরে ঈদগাহটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় এবং তাতে ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসল্লিরা আসতেন। ঈদগাহটি বর্তমানেও ঈদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ঈদের নামাজ
মোগল রাজারা ধর্মকর্ম করেছেন অনেক বেশি। ঈদের দিনের নামাজ তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঈদের নামাজ পড়ানোর জন্য রাজারা ইমাম নিয়োগ করতেন। শহরের বাইরের বিরাট উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো এবং এসব স্থানকে ঈদগাহ বলা হতো। তবে মহিলাদের জন্য কোনো ঈদ জামাতের ব্যবস্থা ছিল কিনা তা জানা যায়নি।
ঈদের শোভাযাত্রা
স্যার টমাস মেটকাফে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্ভেন্ট ছিলেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কোর্টে কাজ করার কারণে মেটকাফে সম্রাটের প্রিয়ভাজন হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। বাহাদুর শাহ জাফর স্যার টমাস মেটকাফেকে দিয়ে ভারতের শিল্প-সংস্কৃতির ওপর জরিপ করান এবং সেগুলোর ওপর চিত্রাঙ্কন করার দায়িত্ব দেন। চমৎকার এই দায়িত্ব পেয়ে মেটকাফে অতি উৎসবের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি ভারতের শিল্পীদের সহযোগিতায় মুসলিম আর্কিটেকচারের ওপর গবেষণা ও চিত্রাঙ্কনের কাজ শুরু করেন। একে একে গুরুত্বপূর্ণ ইমারতগুলোর চিত্র অঙ্কন করেন। এরপর মোগল আমলে ঈদকে কেন্দ্র করে যেসব অনুষ্ঠান হতো সেই অনুষ্ঠানেরও চিত্র অঙ্কনে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এমনই একটি চিত্রের নাম ‘ঈদের শোভাযাত্রা’। কাগজে আঁকা এই চিত্রটির মাধ্যম ছিল কালি, তুলি এবং রঙ। ১২ ফোল্ডের দীর্ঘ এই স্ক্রল চিত্রে স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, তার ছেলে এবং আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত রয়েছেন। উপস্থিত রয়েছেন স্যার টমাস মেটকাফে ও অন্য সভাসদরা। ঈদ শোভাযাত্রার চিত্রের সর্বত্র রয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। সম্রাট, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সম্রাটের ছেলে ও আত্মীয়-স্বজনরা সুসজ্জিত হাতির পিঠে অবস্থান করছেন। ঘোড়ার পিঠেও রয়েছেন কেউ কেউ। যার সরাসরি উদ্যোগে এ চিত্র সৃষ্টি হয়েছে, সেই টমাস মেটকাফে অবস্থান করছেন সুসজ্জিত হাতির পিঠে। যেসব শিল্পী চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে মেটকাফেকে সাহায্য করেছেন, তাদের মধ্যে দিল্লির চিত্রশিল্পী মাজহার আলী খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পী অঙ্কিত চিত্রটি কাল্পনিক নয়। বাস্তব দৃশ্য অবলম্বনেই ঈদুল ফিতরের এ চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষ যাতে মোগল সম্রাট, সভাসদ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সান্নিধ্যলাভে উৎসাহ বোধ করেন সে জন্য শোভাযাত্রার সর্বপরিকল্পিতভাবে তাদের অবস্থানকে নিশ্চিত করেছে। এটাই এ চিত্রের বিশেষত্ব।
ঢাকার ঈদ মিছিল
মোগল আমলে ঢাকায় ঈদ মিছিল বলে একটা কথা ছিল। সে মিছিলে শামিল হতেন রাজধানীর অভিজাত শ্রেণির সর্বস্তরের। উনিশ শতকের প্রথমদিকে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার ঈদ ও মহরমের মিছিলের ছবি এঁকেছিলেন। মোট ৩৯টি ছবি আঁকেন তিনি। চিত্রগুলোতে দেখা যায় ঈদের মিছিলগুলো নায়েব-নাযিমদের নিমতলী প্রাসাদ, চকবাজার, হোসেনি দালান প্রভৃতি স্থাপনার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। ঈদের দিন নায়েব-নাযিমদের বাসস্থান নিমতলী প্রাসাদের ফটক থেকে বিভিন্ন পথ ঘুরে, চকবাজার, হোসেনি দালান হয়ে মিছিল আবার শেষ হতো মূল জায়গায় এসে। মিছিলে থাকত জমকালো হাওদায় সজ্জিত হাতি, উট, পালকি। সামনের হাতিতে থাকতেন নায়েব-নাযিম। কিংখাবের ছাতি হাতে ছাতি বরদার, বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ছিল কাড়া-নাকাড়া শিঙা। রঙ-বেরঙের নিশান দিয়ে মিছিলকে আরো জাঁকজমকপূর্ণ করা হতো। দর্শকরা সারি বেঁধে থাকতেন রাস্তার দু’পাশে। সুবাদারেরা ‘ঝরোকা’ মঞ্চে প্রজাদের দর্শন দিতেন। বিকেলে কাঞ্চনিদের নৃত্য ছিল রাজদরবারে। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সুবাদার ইসলাম খানের দরবারে প্রায় তেরশ’ কাঞ্চনি (নৃত্যশিল্পী) সুলতানের মনোরঞ্জনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকত। মোগল আমলে গ্রামীণ মানুষের ঈদ উৎসবের ধারা একই ছিল। ঢাকার শৌখিন ধনজ লোকদের প্রিয় কাপড় ছিল মসলিন। সে সময় ঢাকার সোনারগাঁর মসলিনের সুনাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ঈদ মেলা
অনুমান করে নেয়া হয় মোগল আমলে বাদশাহি বাজারে অর্থাৎ বর্তমান চকবাজারে ঈদ মেলার আয়োজন হতো। বিশেষ করে তখনকার প্রশাসনিক সদর দফতর ঢাকা কেল্লার আশপাশের এলাকা ঈদের সময়টায় থাকত জমজমাট। চকবাজার এবং রমনা ময়দানের সেই ঈদ মেলায় বিভিন্ন রকমের বাঁশের তৈরি খঞ্চা ডালা আসত। কাঠের খেলনা, ময়দা এবং ছানার খাবারের দোকান বসত সুন্দর করে সাজিয়ে। আর বিকেল বেলা হতো কাবলির নাচ। চকবাজার, কমলাপুরে এখনো সেই মেলার রেশ ধরে মেলা বসে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদের দিন ছোট-বড় মেলা বসে। মেলায় এখনো অনেকেই গিয়ে থাকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে মানুষ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঈদের মেলায় যায় আনন্দ উপভোগ করতে। ঈদ মেলায় বিভিন্ন খেলা, পুতুল নাচ আরো অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা করা হতো। হরেকরকম মিষ্টান্ন বানিয়ে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা এই ঈদ মেলায়।
শাহি ভোজ
ঈদের খুশি যেন পরিপূর্ণ হয় না ঘরে শাহি খাবারের আয়োজন না হলে। মোগল আমল থেকে শুরু করে আজ অব্দি ঈদের দিন সব মুসলিমের ঘরে ঘরেই রান্না হয় মুখরোচক সব শাহি রান্না। মোগলদের রাজত্বকালে ঈদের দিন তৈরি হতো বিভিন্ন ধরনের শাহি খাবার। সকালের নাশতায় খাওয়া হতো বাকরখানি, পরোটা, মাংস আর কয়েক পদে রান্না করা শাহি সেমাই। দুপুরের খাবারে থাকত মোরগ পোলাও, কোরমা, পরোটা, কালিয়া, জর্দা। রাতেও এমন সব খাবারের আয়োজন করা হতো। মোগলদের ঈদের সব রান্নায় মালাই ব্যবহার করা হতো। রাতের খাবারের সঙ্গে উচ্চবিত্ত মোগলরা সুরা পান করতেও পছন্দ করতেন। এসব খাবার-দাবার মোগল যুগে অভিজাত পরিবারদের মধ্যে ব্যাপক প্রচলিত ছিল। এছাড়া সেই আমলে মুসাফিরদের জন্য ঈদের খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করা হতো।
হালের ঈদে মোগল প্রভাব
বর্তমানে ঈদ আর আগের মতো নেই। এখন আর মোগল আমলের মতো ঈদ শোভাযাত্রা, ঈদ মিছিলে গিয়ে আনন্দ করার মতো সময় হয়ে ওঠে না সাধারণ মানুষের। তাই এসবের চাহিদাও নেই। সুতরাং বর্তমান যুগের ঈদে মোগল আমলের প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো নতুনত্ব আনা হয়েছে। বিশেষ করে পোশাক-আশাকে ইদানীং মোগল আমলের বিভিন্ন প্রতিকৃতি ব্যবহারে মেতে উঠেছে নামী-দামি ফ্যাশন হাউসগুলো। সেই সঙ্গে পোশাকের ডিজাইনেও ট্র্যাডিশনাল লুকের সঙ্গে নতুন কিছু মিলিয়ে করা হচ্ছে ফিউশন। গয়নার ক্ষেত্রে মোগল আমলের প্রভাব বলতে গেলে সবসময়ই ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। আর ইদানীং ট্র্যাডিশনাল গয়নার চাহিদা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। ট্র্যাডিশনাল গয়না বললেই মোগলদের সেসব কারুকার্যপূর্ণ গয়নাগুলোই চোখে ভাসে। ঈদের খাবার-দাবারের বেলায় বলা চলে এখনো মোগল আমলেই আছি। কারণ ঈদের দিন উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত কম-বেশি সবার ঘরে ঘরে রান্না হয় শাহি খাবার। মোগল আমলের মতো ঈদ এখন আর না হলেও রোজা এলেই শুরু হয়ে যায় ঈদের প্রস্তুতি। আর আনন্দ-উদযাপন ঈদের পর পর্যন্ত।
Comments