পোড়া শরীর নিয়ে নিজেই সাহায্যের জন্য ছুটছিল রোহান

ছবি: সংগৃহীত

পোড়া দগ্ধ শরীর নিয়ে এক শিশু স্কুলের মাঠ পেরিয়ে একা ছুটে যাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে সাহায্যের জন্য। উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত সোমবার যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার কিছু সময় পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় সেই দৃশ্য।

পুরো একটা দিন কেউ জানত না সে কার সন্তান, কী তার নাম। শুধু জানা যাচ্ছিল একটা শিশু পোড়া শরীর নিয়ে বাঁচার লড়াইয়ে একা ছুটছে।

অসহায়, একা সেই শিশুর জন্য যখন দেশের মানুষ প্রার্থনা করছে, ঠিক তখন রাজধানীর মেট্রোরেলে একটি কোচে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন এক বয়স্ক মানুষ। বিকেল ৩টা ১০ মিনিটের দিকে উত্তরা থেকে মতিঝিলগামী একটি ট্রেনের কোচ-৩ এ দেখা হয় জাকির হোসেনের সঙ্গে। কেন কাঁদছেন— জানতে চাইলে বলেন, 'বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আমার ভাতিজা পুড়ে গেছে। সন্দ্বীপ থেকে আসছি। ওকে দেখতে বার্ন ইনস্টিটিউটে যাচ্ছি।'

ফোনে ভিডিওটি দেখিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলেন, 'স্কুল মাঠে দগ্ধ শরীর নিয়ে যে ছেলেটা দৌড়াচ্ছিল ওই আমার ভাতিজা।'

এভাবেই পরিচয় পাওয়া যায় ১৪ বছরের রবিউল ইসলাম নাবিলের। পরিবার পরিজন যাকে রোহান নামে ডাকে।

মাইলস্টোন স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোহান গত সোমবার স্কুলে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে তার শরীরে আগুন ধরে যায়।

ঘটনার পর পোড়া শরীর নিয়ে নিজেই দৌড়ে হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করে। কয়েকজন মানুষ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, নিয়ে যায় উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে। সেখানেই অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা রোহান হাসপাতালের কর্মীদের মা-বাবার ফোন নাম্বার দেয়।

মেট্রোরেলের সেই কোচে রোহানের বাবা নিজাম উদ্দিনও ছিলেন। সেখানে থাকা সবাইকে তিনি শুধু বলেন, 'আমার ছেলেটার জন্য সবাই দোয়া করবেন।' তারপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সেই ভয়াবহ মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে নিজাম উদ্দিন বলেন, 'আমার ছেলেটার সারা শরীর পুড়ে গেছে। ওই অবস্থাতেই ও দৌড়াচ্ছিল।'

'একসময় কিছু মানুষ ওকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা তখন পর্যন্ত কিছুই জানতাম না।'

চোখের জল সামলে তিনি বলেন, 'আমার ছোট্ট ছেলেটা খুব সাহসী। ওই ভিডিও দেখে মানুষ ভয় পেলেও ও কিন্তু সাহস হারায়নি। হাসপাতালে গিয়ে ও নিজেই ওর মায়ের ফোন নাম্বার দিয়েছে। সেখান থেকেই আমরা জানতে পারি ও কোথায় আছে।'  

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং রোহানকে বার্ন ইনস্টিটিটে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মা নাসিমা বেগম সারাক্ষণ ছেলের পাশেই আছেন।

রোহানের আরেক চাচা মোতাছের হোসেনও সন্দ্বীপ থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন। সবাই মিলে উত্তরার বাসা থেকে যাচ্ছিলেন বার্ন ইন্সটিটিউটে।

নিজাম উদ্দিন যখন কথা বলছিলেন, পাশেই মোতাছের হোসেন তখন নীরবে চোখের পানি মুছছিলেন।

রোহানের বড় ভাই শিহাব ও তাদের একমাত্র বোন নুপুরও একই স্কুলের শিক্ষার্থী।

রোহানের বাবা বলেন, 'বছরের পর বছর এই স্কুলে আমি আমার সন্তানদের নিয়ে গেছি, নিয়ে এসেছি। সোমবারও আমি রোহানকে স্কুলে দিয়ে এসেছি অন্যান্য দিনের মতোই। কিন্তু সেদিন তো আর বাড়ি ফিরে এল না।'

এক বাবার এমন অসহায়ত্ব আর কান্নায় মেট্রোরেলের ওই কোচে থাকার সবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কেউ কাঁদছিলেন, কেউ প্রার্থনা করছিলেন যেন ছেলেটা বেঁচে থাকে। এই পরিবার যেন তার সন্তানকে ফিরে পায়।

রোহান বার্ন ইনস্টিটিউটের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন, তার শরীরের ৫০ শতাংশই দগ্ধ।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'কেউ যদি এইচডিইউতে থাকে, তাহলে বোঝা যায় তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা সাধ্যমতো সব রোগীর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।'

রোহানের মতো আরও কয়েকজন শিশুকে সেদিন ভিডিওতে দেখা গেছে—পোড়া শরীর নিয়ে দৌড়াচ্ছে। যার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে কতটা বিভীষিকাময় ছিল সেই দুপুর।

Comments

The Daily Star  | English

US takes in $87b from tariffs in first half of 2025

More than $87 billion in tariff revenue collected by end of June, surpassing $79 billion total for all of 2024

1h ago