ভূমি জালিয়াতি: পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে করা হয়েছে অর্পিত, নতুন খতিয়ান সৃজনও

ctg_map_ds
স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অফিসগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। এর মধ্যেই ভূমি অফিসের রেজিস্ট্রার (বালাম বই) জালিয়াতির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভূমি অফিস কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে ঘষামাজা করে পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে করা হয়েছে অর্পিত সম্পত্তি। করা হয়েছে নতুন করে খতিয়ান সৃজনও।

রেজিস্ট্রার বই জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের আগ্রাবাদ সার্কেল ভূমি অফিসে।

এই ঘটনায় গত ১২ মে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার তানভীর হাসান তুরান।

এক চিঠিতে সহকারী কমিশনার মাদারবাড়ী (বন্দর) মৌজার সৃজিত খতিয়ান নম্বর ৭৩১ ও রামপুরা মৌজার খতিয়ান নম্বর ২২২৪ জমির অসামঞ্জস্যতা উদঘাটনের জন্য আগ্রাবাদ সার্কেল ভূমি অফিসের ভারপ্রাপ্ত কানুনগো তনক চাকমাকে প্রধান করে সেই কমিটি করেন। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও দুই মাস পরও তা জমা দেওয়া হয়নি।

জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভূমি অফিসের ব্যবস্থাপনার জন্য একাধিক রেজিস্ট্রারে সব জমির তথ্য ও রেকর্ড রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস, তহশিলদার, জেলা প্রশাসন অফিস, জেলা জজের রেকর্ড রুম ও ভূমি অধিদপ্তরের জরিপ শাখায় তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

আগ্রাবাদ ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হালিশহর থানার রামপুর মৌজার শূন্য দশমিক ৩৮০০ একর জায়গার জন্য ২২২৪ খতিয়ানে মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন নামের একজন ভূমি অফিসে কাগজপত্র দাখিল করেন। কাগজপত্র দাখিলের পর তার খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, এই নামে কোনো খতিয়ান নেই। যেই দাগ ও খতিয়ান ধরে আবেদন করা হয়েছে, সেটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি (এপি)। রেজিস্ট্রার খাতায় সেটিকে ফ্লুয়িড কলম দিয়ে ভিপি (অর্পিত সম্পত্তি) করা হয়েছে।

বিষয়টি জানতে চাইলে আগ্রাবাদ ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার তানভীর হাসান তুরান রোববার সকালে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কামাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি খতিয়ান জমা দিয়ে আবেদন করলে সেটি তদন্ত করার সময় কিছু অসামঞ্জস্যতা পেয়েছি। যখন এটি নিয়ে কাজ শুরু হয়, তখন আমরা এই খতিয়ানের অস্তিত্বই খুঁজে পাইনি। জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) বিষয়টি জানিয়েছি। এখানে খতিয়ান হিসেবে যা জমা দেওয়া হয়েছে, সেই ধরনের তথ্য আমরা পাইনি।

'রেজিস্ট্রার বইতে ঘষামাজা কিংবা খতিয়ান কখন হয়েছে তা বলা মুশকিল। আমরা এখানে এসেছি বেশিদিন হয়নি,' বলেন তিনি।

কীভাবে সই করে খতিয়ান সৃজন করা হলো কিংবা রেজিস্ট্রার বই ঘষামাজা করা হলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়গুলো তদন্ত কমিটি দেখছে। তারা আমাকে প্রতিবেদন দিয়েছেন। কিন্তু আমি এখনো সেটি পড়তে পারিনি। সেটি আমি দেখার পর জেলা প্রশাসন অফিসে ফরওয়ার্ড করে দেবো।

আগ্রাবাদ ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হালিশহর রামপুরা এলাকার কামাল উদ্দিনের দাখিল করা খতিয়ানে বলা হয়েছে, সেটি বিএস ৮৪৪ ও ৮৬৯ থেকে আসা।

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে রেজিস্ট্রার-২ এর একাধিক স্থানে ঘষামাজার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বইয়ের যেখানে ঘষামাজা করে এপিকে ভিপি বানানো হয়েছে, সেটি ১৪৭ নম্বর পাতায়। মালিকের নামে লেখা আছে ফসিউল আলম, খতিয়ান লেখা আছে ৮৪৪। দাগ নম্বর ৩২ ও ৩৩ লেখা। ডান পাশে উপরে লেখা আছে লাল কালিতে 'সম্পূর্ণ ভিপি ল্যান্ড, খাজনা বন্ধ'। এখানে 'এপি'কে ভিপি বানানো হয়েছে। জমির পরিমাণের কলামে ঘষামাজা করে ফ্লুয়িড দিয়ে লাল কালি দিয়ে 'ভিপি' লেখা হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বিবরণে কলামে এপিকে ভিপি করা হয়েছে ফ্লুয়িড দিয়ে।

ঘষামাজার বিষয়টি ধরা পরার পর সেখানে খতিয়ানের পাশে লেখা আছে 'এপি নং০৯/১৮৮৬-৮৭ লিজকৃত, অত্র খতিয়ানে সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে'। বালাম বইয়ের ১৭২ পাতাতেও ঘষামাজা করে এপিকে ভিপি বানানো হয়েছে। ৮৬৯ খতিয়ানে ফিরোজা বেগমের নাম লেখা আছে। দাগের নম্বর ৩১ ও ৩০। সেখানে জমির কলামে দুইবার এপিকে ভিপি বানানো হয়েছে ফ্লুয়িড কলম ব্যবহার করে।

বালাম বইয়ের আরেক পাতায় ২২২৪ খতিয়ানে মোহাম্মদ কামাল উদ্দিনের নাম আছে। সেখানে ভূমির দাগে উপরে ফসিউল ও ফিরোজা বেগমের দাগ নম্বর ৩২, ৩৩, ৩১, ৩০ লেখা আছে। এই চার দাগ নম্বর দিয়েই কামাল উদ্দিনের নামে খতিয়ান সৃজন করা হয়েছে। জালিয়াতির ঘটনা ধরা পরার পর সেই খতিয়ানকে এপি তালিকাভুক্ত বলে লেখা হয়েছে বইতে।

জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বালাম বইতে কোনো কিছু সংযোজন বিয়োজন করতে হলে জেলা প্রশাসক কিংবা সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ডের সই দিতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে সেটি বিভাগীয় কমিশনারের কাছে  যায়।

এপি সম্পত্তি দুই ধরনের হয়। একটি গেজেটভুক্ত, অন্যটি বিশেষ বিবেচনায়, যা 'ক' ও 'খ' তালিকায় বিভক্ত। দুই তালিকার রক্ষণাবেক্ষণ এবং যাবতীয় কাজ সম্পাদন হয় প্রধান বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে। তিনি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই করে জমি লিজ বা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এপি সম্পত্তি বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। তাই হয়তো এখানে এপিকে জালিয়াতির মাধ্যমে 'ভিপি' বানিয়ে নকল খতিয়ান সৃজন করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি ঘটনা। এমন হয়তো আরও ঘটনা থাকতে পারে যা অগোচরে আছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, এটা নিয়ে কমিটি হয়েছে। আপনি আগ্রাবাদ এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলেন।

কীভাবে জালিয়াতির ঘটনা হলো, এর নেপথ্যে কারা জড়িত, কীভাবে এত বড় জালিয়াতির ঘটনা হলো, এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে কেউ এখনো আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেনি।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina’s final days before the fall

A desire to cling to power, intolerance for dissent and failure to see the writing on the wall were what eventually unravel Sheikh Hasina’s iron-fisted rule of 15 years.

5h ago