পুলক থেকে জাহিদ হাসান

অভিনেতা জাহিদ হাসান, নামেই যার পরিচিতি। টেলিভিশন নাটকের অন্যতম শীর্ষ অভিনেতা তিনি। নব্বই দশক থেকে অভিনয়ে তার পথচলা শুরু। নাটক, সিনেমা, ওটিটি—তিন মাধ্যমেই তিনি উজ্জ্বল। একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। নাট্য পরিচালক হিসেবেও সফল হয়েছেন। নতুন করে আলোচনায় এসেছেন 'উৎসব' সিনেমায় অভিনয় করে।
জানা যাক জাহিদ হাসানের জীবনের কিছু অজানা কথা।
পুলক থেকে জাহিদ হাসান
তারকা অভিনেতা জাহিদ হাসানের ডাক নাম পুলক। পরিবারের সদস্যরা পুলক নামেই ডাকেন। এই নামটি রেখেছিলেন তার মা। আর জাহিদ নামটি রেখেছিলেন তার দাদা। সিরাজগঞ্জের বন্ধুরা পুলক নামে ডাকেন। পুলক থেকে জাহিদ হাসান হিসেবে পরিচিতি পেতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। কষ্ট করতে হয়েছে। অভিনেতা হওয়ার জন্য সাধনা করতে হয়েছে। তারপর নব্বই দশকের শুরু থেকে তার ক্যারিয়ারের উত্থান শুরু। সিরাজগঞ্জের পুলক হয়ে যান সবার ভালোবাসার জাহিদ হাসান।
অভিনয়ে পথচলা যেভাবে
স্কুলজীবন থেকে মঞ্চ নাটক ও যাত্রাপালা দেখার ঝোঁক ছিল জাহিদ হাসানের। স্কুলজীবনে তিনি শুনতে পান সিরাজগঞ্জ শহরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যাত্রাপালা হবে এবং নামভূমিকায় অভিনয় করবেন বিখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। জাহিদ হাসানের খুব ইচ্ছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যাত্রাপালা দেখবেন। এরপর পরিবারের অনুমতি পাওয়ার পর ছুটে যান যাত্রা দেখতে। ২০ টাকা দিয়ে সেদিন তিনি টিকিট কেটেছিলেন। আনোয়ার হোসেনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় এভাবেই। এই ভালো লাগা এবং এই ঘোর তার মধ্যে অনেকদিন ছিল।
এরপর স্কুল পাস করে সিরাজগঞ্জের একটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। নিজ শহরে তরুণ সম্প্রদায় নাট্যদলে যোগ দেন। পরপর কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন এই দলের হয়ে। তবে, 'সাত পুরুষের ঋণ' নাটকটি তাকে বেশ আগ্রহী করে তুলে অভিনয়ে। আশির দশকে নাটকটি বিটিভিতে প্রচার করা হয়, তাও আবার সরাসরি। অভিনয়ের প্রতি তার প্রেম গেঁথে যায় এভাবেই।

প্রথম উপার্জন ১২০০ টাকা
অতঃপর অভিনয়ের স্বপ্ন ও ভালোবাসা নিয়ে জাহিদ হাসান ঢাকায় চলে আসেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও ভর্তি হননি তিনি। কেননা, তাকে রাজধানীতে থিতু হতে হবে এবং রাজধানীতে না থাকলে অভিনেতা হতে পারবেন না। এরপর, ১৯৮৯ সালের কোনো একদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে অডিশন দেন অভিনেতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য। ইচ্ছে পূরণ হয়। তিনি তালিকাভুক্ত হন।
১৯৯০ সালে প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটক করার সুযোগ আসে। 'জীবন যেমন' দিয়ে টিভি নাটকে তার অভিষেক ঘটে। ক্যারিয়ারের শুরুতে নাটকটিতে ভালো একটি চরিত্র পান তিনি। আর প্রথম অভিনয়ের জন্য সম্মানী পান এক হাজার ২০০ টাকা।
পরিবার চাইত তিনি ডাক্তার হন
জাহিদ হাসানের বাবা-মা চাইতেন সন্তান ডাক্তার হোক। মানুষের সেবা করুক বড় হয়ে। কিন্তু জাহিদ হাসান চাইতেন অভিনেতা হবেন। এভাবেই লেগে থাকেন অভিনয়ে। ঢাকায় এসে একদিকে নাট্যকেন্দ্রের মঞ্চ নাটকে অভিনয়, অন্যদিকে টিভি নাটকের জন্য রামপুরায় যাতায়াত। মাঝে বেইলি রোডের আড্ডা। শুধু কি বেইলি রোডের আড্ডা? সেই সময় তিনি টিএসসি, কখনো রামপুরা টিভি কেন্দ্রের কাছাকাছি আড্ডা দিতেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রামপুরার কাছাকাছি আড্ডা দিতেন এই ভেবে, যদি তার ডাক আসে অভিনয়ের জন্য।
যে নাটকগুলো তাকে বদলে দেয়
বিটিভিতে তার অভিনীত 'জীবন যেমন' প্রচারিত হওয়ার পর স্বপ্ন বড় হতে শুরু করে। আশায় থাকেন—আবার কবে ডাক পড়বে? এরপর সমাপ্তি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান। 'সমাপ্তি' নাটকটি তাকে পরিচিতি এনে দেয়। প্রচুর দর্শকরা নাটকটি দেখেন। আরও পরে তিনি অভিনয় করেন সখী ভালোবাসা কারে কয়, কাশবনের কন্যা, ছবি শুধু ছবি নয়...আরও পরে কয়েকটি ধারাবাহিকে অভিনয় করে এদেশের মানুষের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান তিনি। ধারাবাহিকগুলো হচ্ছে—সবুজ ছায়া, সবুজ ছাতি, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার...ইত্যাদি।
রূপালি পর্দায় জাহিদ হাসান
১৯৮৬ সালে 'বলবান' নামের একটি সিনেমা দিয়ে প্রথম রূপালি পর্দায় অভিনয় করেন জাহিদ হাসান। 'বলবান' ছিল বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের প্রযোজিত সিনেমা।
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত 'শ্রাবণ মেঘের দিন' সিনেমায় জাহিদ হাসান অভিনয় করেন মতি চরিত্রে। এই সিনেমার জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তাকে এনে দেয় ব্যাপক খ্যাতি। 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সিনেমায় তার সাবলীল অভিনয় নতুন মাত্রা যোগ করে। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী পরিচালিত এই সিনেমায় তিনি খোরশেদ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেন। তৌকীর আহমেদ পরিচালিত 'হালদা' সিনেমাটিও তার ক্যারিয়ারে বড় ভূমিকা রেখেছে। গোলাম সোহরাব দোদুল পরিচালিত 'সাপলুডু' সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করেও বেশ সাড়া পান তিনি। হুমায়ূন আহমেদের 'আমার আছে জল' সিনেমা করে প্রশংসিত হন। আরও কয়েকটি সিনেমা করেছেন।
সব শেষ মুক্তি পেয়েছে তার অভিনীত ও তানিম নূর পরিচালিত 'উৎসব' সিনেমা। জাহাঙ্গীর চরিত্রে অভিনয় করে নতুন করে 'উৎসব' সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মাঝে প্রত্যাবর্তন করেছেন জাহিদ হাসান। 'উৎসব' সিনেমা তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছে।

নাটক পরিচালনা
জাহিদ হাসান অভিনয়ের পাশাপাশি একসময় নাটক পরিচালনা শুরু করেন। এক ঘণ্টার নাটক, টেলিফিল্ম ও ধারাবাহিক—সব মিলিয়ে অনেকগুলো নাটক পরিচালনা করেছেন। তবে, 'লাল নীল বেগুনি' মেগা-ধারাবাহিক পরিচালনা করে আলোচনায় আসেন পরিচালক হিসেবে। তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পায় 'লাল নীল বেগুনি' নাটকটি। এই নাটকে তিনি অভিনয়ও করেন। তার বিপরীতে ছিলেন পূর্নিমা।
সংসারজীবন
জাহিদ হাসান ভালোবেসে বিয়ে করেন বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় মডেল সাদিয়া ইসলাম মৌকে। তাদের ঘর আলো করে আছে দুই সন্তান। তার মেয়ের নাম পুষ্পিতা ও ছেলের নাম পূর্ণ।
Comments