‘আমি, জোশুয়া নর্টন… যুক্তরাষ্ট্রের সম্রাট!’

জোশুয়া নর্টন। ছবি: ক্যালিফোর্নিয়া হিস্টোরিক সোসাইটির সৌজন্যে

'যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ নাগরিকের অনুরোধ ও ইচ্ছায়, আমি জোশুয়া নর্টন, কেপ অব গুড হোপের সাবেক ও গত নয় বছর ১০ মাস ধরে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর বর্তমান বাসিন্দা, নিজেকে এই দেশের সম্রাট ঘোষণা করছি।'

ঘটনাটি ১৮৫৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের। মানুষটি ছিলেন পরিপাটি ও গম্ভীর। সংবাদমাধ্যম দ্য সান ফ্রান্সিসকো ইভিনিং বুলেটিন'র কার্যালয়ে এসে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই একটি লিখিত কাগজ দিয়ে বললেন, 'এটা ছাপানো হোক।'

সম্পাদক সেই 'ঘোষণাপত্রটি' পত্রিকার সান্ধ্যকালীন সংস্করণের তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছেপেছিলেন।

সেই ঘোষণায় সারাদেশ থেকে জনপ্রতিনিধিদের সান ফ্রান্সিসকোর মিউজিক্যাল হল-এ দেখা করতে বলা হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইন সংশোধনের জন্য তাদের ডাকেন। তিনি মনে করতেন, দেশে যে অন্যায় চলছে তা বন্ধ হওয়া দরকার।

ঘোষণাপত্রে সই করতে গিয়ে তিনি লেখেন, 'প্রথম নর্টন। যুক্তরাষ্ট্রের সম্রাট।'

গত ২০ এপ্রিল আল জাজিরায় জোশুয়া নর্টনকে নিয়ে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ইলন মাস্ক প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান নন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনায় এসেছেন। বরং, দক্ষিণ আফ্রিকান জোশুয়া নর্টন ১৮৫৯ সালে নিজেকে 'সম্রাট' ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা নিয়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার ঘোষণায় এর ইঙ্গিত ছিল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনীতি দাসদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু উত্তরের রাজ্যগুলো ছিল এর বিরোধিতায়।

১৮৬০ সালে দাসপ্রথাবিরোধী রিপাবলিকান নেতা আব্রাহাম লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর, দক্ষিণের রাজ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে বের হতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে দেশবাসী জড়িয়ে পড়ে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে।

সান ফ্রান্সিসকোর যে মিউজিক্যাল হলে জনপ্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল তা বৈঠকের নয় দিন আগে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে জোশুয়া নর্টন নতুন জায়গার কথা জানালেও, আসলে কেউই সেখানে আসেননি।

সান ফ্রান্সিসকো সাহিত্য উৎসব লিটকুয়াক'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেন গানাহল মনে করেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে ১৯ শতকের 'সম্রাট' জোশুয়া নর্টনের স্মৃতি আবার জাগিয়ে তোলা যেতে পারে। কেননা, তিনি অভিবাসী, নারী ও ভিন্ন মতের কারণে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে লড়াই করেছিলেন। তিনি তাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।

ছবি: ক্যালিফোর্নিয়া হিস্টোরিক সোসাইটির সৌজন্যে

যারা জোশুয়া নর্টনকে দেখেছিলেন বা তার বন্ধু ছিলেন তারা তার প্রশংসা করতেন। রাজনীতিতে তার প্রভাব না থাকলেও তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে বই, তৈরি হয়েছে সিনেমা। তাকে নিয়ে ভক্তদের ক্লাবও আছে। তিনি এখনো আলোচ্য বিষয়। কয়েকটি ব্যাংক তার নামে ব্যাংক নোটও ইস্যু করেছিল।

'সম্রাট' জোশুয়া নর্টন জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যু হয় ৬১ বছর বয়সে। ১৮৮০ সালের ৮ জানুয়ারি, ক্যালিফোর্নিয়ায়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার '২১ বছরের শাসন'।

সেসময় সংবাদমাধ্যম সান ফ্রান্সিসকো কল'র প্রতিবেদনে বলা হয়, 'অমাবস্যার অন্ধকারে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ভেতর… যুক্তরাষ্ট্রের সম্রাট ও মেক্সিকোর রক্ষাকর্তা প্রথম নর্টন ঈশ্বরের দয়ায় ইহলোক ত্যাগ করেছেন।'

তার মৃত্যুর পর এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এই 'সম্রাট' দরিদ্র ছিলেন। ইউরেকা বোর্ডিং হাউসে তার ছোট্ট কামরায় ছিল হাঁটার লাঠি ও টুপি। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কয়েকটি দেশের ধাতব মুদ্রা। বিশ্বনেতাদের জাল টেলিগ্রামের খাপ। ধারণা করা হয় সেগুলো স্থানীয়রা মজা করে পাঠিয়েছিলেন।

আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, শহরের মর্গে 'সম্রাট' জোশুয়া নর্টনের মরদেহ দেখতে অন্তত ১০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তার মরদেহ নিয়ে হয়েছিল শবযাত্রা।

সেসময় দ্য সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকলের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেই শবযাত্রায় ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষকে দেখা গিয়েছিল।

জোশুয়া নর্টনের বাবা ছিলেন কৃষক। ছোট ব্যবসাও ছিল তার। তবে ব্রিটিশ শাসনে থাকা শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে তিনি কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা পেলেও তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি।

১৮৪৫ সালে ২৭ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা জোশুয়া নর্টন ব্যবসা করার চেষ্টা করেও সফল হননি। তার সম্পর্কে আর তেমন কিছু জানা যায় না। তিনি সান ফ্রান্সিসকোয় এসেছিলেন ১৮৪৯ সালে।

সব নাগরিক অধিকার আন্দোলনে যোগ দেওয়া এই মানুষটি থাকতেন শহরের সবচেয়ে সুন্দর হোটেলে। তাই এই সাধারণ মানুষটিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক কল্পকথাও। মৃত্যুর প্রায় ১৫০ বছর পরও জোশুয়া নর্টনকে দেখা হয়, 'সান ফ্রান্সিসকো মূল্যবোধের অগ্রদূত' হিসেবে।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus, Modi exchange Eid greetings

The interim government on Sunday shared both the letters on its Facebook page

1h ago