সরকারের নজর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের বিদেশে পাচার করা সম্পদের ওপর

আবাসন খাতে ‘কালো’ টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, চুরি হওয়া সম্পদ ও বিদেশে পাচার করা সম্পদ পুনরুদ্ধার। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে ভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব ব্যবহার করে সম্পদের তথ্য গোপন ও বিদেশে সম্পদ স্থানান্তরের তথ্য উন্মোচিত হয়েছে।

এসব সম্পদ উদ্ধারের লক্ষ্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সোমবার বাজেট বক্তৃতায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের অর্জিত আয় বিদেশে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে শাস্তির বিধানের কথা জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন অথচ পরবর্তীতে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন, এমন ব্যক্তি কর্তৃক বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর যথাযথভাবে কর পরিশোধ না করে নানা উপায়ে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ-সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপের বিধান করা হয়েছে।

উপদেষ্টা তার বক্তব্যে সংস্কারের অংশ হিসেবে টাস্কফোর্স গঠনের কথাও উল্লেখ করেছেন, যার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চুরি বা পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

এসব টাস্কফোর্স ব্যাংকিংখাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে কাজ করবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

'এস আলম এবং তার মতো অন্যান্য' অর্থ পাচারকারীদের শাস্তি দিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন।

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম এবং তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের বিরুদ্ধে দুদক একাধিক মামলা করেছে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশে সম্পদ কেনা ও বিনিয়োগসহ প্রায় এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত সম্পদের অভিযোগ আনা হয়েছে।

সাইফুল আলম ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।

নিজেকে আইনত একজন 'বিদেশি বিনিয়োগকারী' উল্লেখ তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যকে বিদেশে সম্পদ অর্জন এবং তথ্য গোপন রাখার অভিযোগে এস আলমসহ অন্যদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি সম্প্রতি সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান ও ভাগ্নে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের ৮৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের নয়টি সম্পত্তি জব্দ করেছে। শায়ান ও শাহরিয়ার দুজনই ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতার একটি কথা মনে রাখা দরকার যেখানে তিনি বলেছেন, 'সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য।' একইসঙ্গে তিনি দুর্নীতির মূলোৎপাটনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

'কালো' টাকা সাদা করার সুযোগ

উপদেষ্টার এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত আয়ের 'কালো' টাকাকে আবাসনখাতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে সাদা করার বিধান রয়েছে—যদিও অনেক বেশি কর দিয়ে এই সুযোগ পাওয়া যাবে।

বছরের পর বছর ধরে কালো টাকার ওপর অতিরিক্ত কর দিয়ে রিয়েল এস্টেট ও কেনা জমিতে ভবন তোলার ক্ষেত্রে 'কালো' টাকা 'সাদা' করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরের বাজেটে অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৬ হাজার টাকা এবং ভূমি উন্নয়ন বা জমিতে ভবন তোলার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

তবে, এ বছর এই সুযোগ শুধু অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে সীমিত করা হয়েছে। জমির ক্ষেত্রে 'কালো' টাকা সাদা করা যাবে না।

নতুন অর্থবছরের বাজেটে রেডি ফ্ল্যাট কেনা এবং জমি কিনে ভবন তৈরিতে বিনিয়োগের মধ্যে পার্থক্য রাখা হয়েছে।

গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় 'কালো টাকায়' রেডি ফ্ল্যাট, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে প্রতি বর্গমিটারে ২১ হাজার ৫২৭ টাকা ৮ পয়সা হারে কর দিতে হবে।

আর জমির ওপর ভবন তোলার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে অতিরিক্ত আরও ৯ হাজার ৬৮৭ টাকা ৫১ পয়সা কর দিতে হবে, যা গত অর্থবছরের বাজেটের আবাসন খাতের করের চেয়ে ৬১ শতাংশ বেশি।

এলাকা ভেদে প্রতি বর্গমিটারে করের পরিমাণ কমলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় বাড়তি করহার ৬১ শতাংশই থাকবে।

গত অর্থবছরের বাজেটে এ ধরনের বিনিয়োগকারীদের অর্থের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে, এবারের বাজেটে এ বিষয়টির কোনো উল্লেখই নেই।

আগের বাজেটে অঘোষিত স্থাবর সম্পত্তির ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে 'কালো' টাকা 'সাদা' করার বিধান রাখা হয়েছিল। এবার অবশ্য এ ধরনের সম্পদের বিষয়ে বাজেটে কিছু বলা হয়নি।

কর কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করেনি বা তদন্ত হয়নি এমন সম্পদের ক্ষেত্রে এখনো এই সুযোগ পাওয়া যাবে। এভাবে 'সাদা' না করা এমন অপ্রদর্শিত সম্পদের তথ্য পরে পাওয়া গেলে শাস্তি পেতে হবে।

বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার 'কালো' টাকা 'সাদা' করার সুযোগ রাখার নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, এটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সংবাদ বিবৃতিতে বলেছেন, 'যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র সংস্কার—বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।'

'এর মাধ্যমে সরকার বাস্তবে পুরো বছরজুড়ে অবৈধ ও অপ্রদর্শিত অর্থ-সম্পদ অর্জনের জন্য নাগরিকদের উৎসাহিত করছে এবং বছর শেষে কালো টাকাকে বৈধতা দেওয়ার অঙ্গীকার করছে। বৈধতা দেওয়ার অজুহাত হিসেবে যে খাতে তোষণ করা হচ্ছে, সেই আবাসনখাতই দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের একটি হিসেবে চিহ্নিত,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Binimoy platform suspended by Bangladesh Bank

BB suspends Binimoy over irregularities

During the previous AL govt, it was developed by the IDEA under the ICT Division at a cost of Tk 65 crore.

11h ago