পাকিস্তানে ‘সৌর ঝড়’

পাকিস্তানের বড় শহর থেকে শুরু করে ছোট গ্রামের ঘরগুলোর ছাদ যেন প্রজ্বলিত গাঢ় নীল সৌর প্যানেলের গালিচা। ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানের বড় শহর থেকে শুরু করে ছোট গ্রামের ঘরগুলোর ছাদ যেন প্রজ্বলিত গাঢ় নীল সৌর প্যানেলের গালিচা। ছবি: রয়টার্স

পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর যখন ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে প্রবেশ করছে আর একে ঘিরে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ঠিক এমন সময় মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন পাকিস্তানে সৌরবিদ্যুতের প্রসার নিয়ে লেখা প্রতিবেদনে 'পারফেক্ট স্টর্ম' শব্দ দুটি ব্যবহার করে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের 'সৌর বিপ্লব' এত দ্রুত কীভাবে বাস্তবায়িত হলো তা নিয়েই প্রতিবেদন।

গত ১ মে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের বড় শহর থেকে শুরু করে ছোট গ্রামের ঘরগুলোর ছাদ যেন প্রজ্বলিত গাঢ় নীল সৌর প্যানেলের গালিচা।

প্রায় ২৪ কোটি মানুষের দেশটিতে খুব দ্রুত 'সৌর বিপ্লব' ঘটে চলেছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

প্রায় ২৪ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তানে খুব দ্রুত ‘সৌর বিপ্লব’ ঘটে চলেছে। ছবি: রয়টার্স
প্রায় ২৪ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তানে খুব দ্রুত ‘সৌর বিপ্লব’ ঘটে চলেছে। ছবি: রয়টার্স

সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে চীন থেকে পাকিস্তানে আসা সৌর প্যানেলে বাজার সয়লাব। জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এম্বার'র তথ্য বলছে—২০২৪ সালে পাকিস্তানে ১৭ গিগাওয়াটের প্যানেল আমদানি করা হয়েছে। এর আগের বছরের তুলনায় যা দ্বিগুণের বেশি। পাকিস্তান এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সৌর প্যানেল আমদানিকারক।

দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদের জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিনিউয়েবলস ফার্স্ট'র একজন পরিচালক মুস্তাফা আমজাদ সিএনএন'কে বলেন, 'ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোয় সৌর প্যানেল ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। তবে পাকিস্তান যে গতিতে ও যত সংখ্যক প্যানেল বসিয়েছে তা অভাবনীয়।'

তার মতে, পাকিস্তানে 'সৌর বিপ্লব' হয়েছে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে। তবে সরকারের চাপে নয়, জনগণের চাহিদা ও বাজার ব্যবস্থার ফলেই এটি ঘটেছে।

'পারফেক্ট স্টর্ম'

পাকিস্তান সোলার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও হ্যাড্রন সোলারের প্রধান নির্বাহী ওয়াকাস মুসা মনে করেন, পাকিস্তানে সৌরশক্তির এত দ্রুত প্রসার কিছু বিষয়ের এক 'নিখুঁত সমন্বয়' এর ফল।

এ সবের মধ্যে আছে—চীন থেকে আসা কম দামের প্যানেলের পাশাপাশি পাকিস্তানে বিদ্যুতের আকাশছোঁয়া দাম।

ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বাথের সেন্টার ফর ডিভেলপমেন্টের গবেষণা সহযোগী আশা আমিরালি গণমাধ্যমটিকে জানান, পাকিস্তানে বিদ্যুৎ নিয়ে বিপত্তি ১৯৯০ এর দশক থেকে শুরু। তখন খুব ব্যয়বহুল জ্বালানিচুক্তি হয়। প্রচুর ডলার খরচ হয়। উৎপাদকরা কী পরিমাণ বিদ্যুৎ দিচ্ছেন তা বিবেচনায় না নিয়েই তাদের পেছনে দেদারসে অর্থ ঢালা হয় বলেও জানান তিনি।

পাকিস্তানের সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক প্রসার আর সব সাধারণ সুখবরের মতো নয়। এটি বেশ জটিল ও গোলমেলে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন—পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যয়বহুল, চাহিদা কম ও সরকারের প্রচুর ভর্তুকি দরকার—এ ধারণা এখানে টেকে না।

সতত সম্পদ ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ হরজিৎ সিং বলেন, 'সরকারের ভর্তুকি ছাড়া সৌরবিদ্যুতে প্রসার সম্ভব নয়—এমন ধারণা পাকিস্তানিরা ভেঙে দিয়েছেন। তারা সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছেন কারণ এটি সস্তা।'

সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে চীন থেকে পাকিস্তানে আসা সৌর প্যানেলে বাজার সয়লাব। ছবি: রয়টার্স
সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে চীন থেকে পাকিস্তানে আসা সৌর প্যানেলে বাজার সয়লাব। ছবি: রয়টার্স

এপ্রিলে সাধারণত দেশটিতে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি চলে যায়। সঙ্গে থাকে দীর্ঘ লোডশেডিং। জনগণের ধারণা এমন পরিস্থিতিতে সৌরবিদ্যুৎ তাদের রক্ষা করতে পারে।

একদিকে, পাকিস্তানি রুপির মান ক্রমাগত কমছে আবার অন্যদিকে, সৌরবিদ্যুতের প্রসারের কারণে কমছে সরকারের দেওয়া বিদ্যুতের চাহিদা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়।

গত তিন বছরে দেশটিতে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫৫ শতাংশের বেশি। আবার দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। পাকিস্তানে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ৩০ গিগাওয়াট। গত বছর সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে ১৫ গিগাওয়াটের মতো।

ব্লুমবার্গএনইএফ'র সৌরবিদ্যুৎ গবেষক জেনি চেজ সিএনএন'কে বলেন, 'পাকিস্তানে সব জায়গায় ঘরের ছাদে যত সৌর প্যানেল দেখা যায়, তা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।'

টিকটক-ইনস্টাগ্রামের ভূমিকা

বিদ্যুৎ নিয়ে পাকিস্তানিদের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তান সোলার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ওয়াকাস মুসা সে দেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসারকে সমাজমাধ্যমের প্রসারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

পাকিস্তানিরা প্রথাগত সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মতো সমাজমাধ্যমকে তথ্যের জন্য বেছে নিচ্ছেন। এসব মাধ্যমে তারা নিজেদের তথ্য প্রকাশ করছেন। সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে তারা নিজেরাই উৎপাদক ও ব্যবহারকারী হয়েছেন।

দেশটির সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা নিজ নিজ অ্যাকাউন্টে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একে অপরের পরামর্শ নিচ্ছেন। নানান রকম সৌর প্যানেল বা কম দামে ভালো প্যানেলের তথ্য পাচ্ছেন।

পাকিস্তানে সব জায়গায় ঘরের ছাদে যত সৌর প্যানেল দেখা যায়, তা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।’ ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানে সব জায়গায় ঘরের ছাদে যত সৌর প্যানেল দেখা যায়, তা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।’ ছবি: রয়টার্স

সমাজমাধ্যমে আসছে নানা ধরনের বিজ্ঞাপনও। এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে পাকিস্তানিরা ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা নিয়ে ছুটছেন আশপাশের দোকানগুলোয়।

'ঝড়ে' ভাঙছে 'খুঁটি'

ঝড়ের সঙ্গে ক্ষতির যোগ আছে। পাকিস্তানের 'সৌর ঝড়'ও এর ব্যতিক্রম নয়। সৌরবিদ্যুতে দেশবাসীর ঝুঁকে পড়ায় যেন 'ভেঙে পড়ছে' সেখানকার সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলা বিদ্যুতের গ্রিড।

ওয়াকাস মুসা সিএনএন'কে বলেন, 'আমাদের গ্রিডলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'

সরকারি সঞ্চালনের মাধ্যমে পাওয়া বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎ কিনতে পারছেন না। ফলে বিদ্যুৎ বিক্রি হচ্ছে কম। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ মেটাতে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বিদ্যুতের দাম।

বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় মানুষ ক্রমশ সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন।

পাকিস্তান পাওয়ার ডিভিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএন'কে বলেন, 'সরকারের উচিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।' তবে সেসব উদ্যোগ কী হতে পারে তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি।

আশা আমিরালি মনে করেন, পাকিস্তানে সৌরবিদ্যুতের প্রসার বলে দিচ্ছে সেখানে এখন প্যানেল কেনা শুধু ধনীদের বিষয় নয়। সেসব এলাকায় গ্রিডের বিদ্যুৎ দিনে অল্প সময়ের জন্য পাওয়া যায় সেসব এলাকায় মানুষ সৌরবিদ্যুতের আশ্রয় নিচ্ছেন। যাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ বা আর্থিক সঙ্গতি ছিল না তাদের ঘরেও এখন জ্বলছে বিজলী বাতি। অনেকে আবার দলবদ্ধভাবে প্যানেল কিনে সেচের ব্যবস্থাও করে নিচ্ছেন। এক সময় সেচের জন্য নির্ভর করা হতো ডিজেলচালিত জেনারেটরের ওপর।

মোদ্দা কথা, সৌরবিদ্যুতের প্রসারে পাকিস্তানে একদিকে কমছে সরকারের গ্রিড বিদ্যুৎ বিক্রির আয়। কমছে জ্বালানি তেল বিক্রির রাজস্বও। তবে 'সৌর ঝড়' পাকিস্তানকে বিশ্বমঞ্চে এনে দিচ্ছে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে 'অগ্রগামী' হওয়ার খেতাব।

তবে জ্বালানিবিষয়ক গবেষক মুস্তাফা আমজাদ মনে করেন, যদি এই 'সৌর বিপ্লব' ভুল পথে যায়, তাহলে বৈশ্বিকভাবে সৌরশক্তির প্রতি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশটির নিশ্চিত করা উচিত যে তাদের সৌরবিদ্যুতের সাফল্য যেন রূপকথার গল্পের মতোই হয়, এমন কিছু যেন না হয় যা 'কী করা উচিত নয়' এর উদাহরণ হিসেবে থেকে যায়।

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

3h ago