‘ডেপুটি কমিশনার’ কীভাবে ‘জেলা প্রশাসক’ হন?

দেশের ৬৪ জেলার ডেপুটি কমিশনারদের (ডিসি) নিয়ে আজ ঢাকায় শুরু হয়েছে 'জেলা প্রশাসক' সম্মেলন। স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা ইউনিট। এর প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি কর্মচারীর ইংরেজি পদনাম 'ডেপুটি কমিশনার (ডিসি)'। কিন্তু বাংলায় বলা হচ্ছে 'জেলা প্রশাসক', যা দেশের কোনো আইন-বিধিতে নেই। এরপরও এ পদ নামটি কেন ব্যবহার হচ্ছে, তার সদুত্তর দিতে পারছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য 'পদবির পরিভাষা' শীর্ষক প্রকাশনার ৬২ নম্বর পৃষ্ঠায় 'ডেপুটি কমিশনার'-এর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে 'জেলা প্রশাসক'। কিন্তু একই পৃষ্ঠায় 'ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস'-এর বাংলা পদনাম করা হয়েছে 'উপকর কমিশনার', 'ডেপুটি কমিশনার অব কাস্টমস'-কে বলা হয়েছে 'উপকর কমিশনার, কাস্টমস', 'ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ'-কে বলা হয়েছে 'উপপুলিশ কমিশনার'। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—'ডেপুটি কমিশনার'-এর বাংলা পদনাম 'জেলা প্রশাসক' কীভাবে হলো?

তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এর আওতায় 'জেলা প্রশাসক' শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে তথ্য জানার পরামর্শ দেয়।

তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২ মার্চ ডিসি সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে 'জেলা প্রশাসক' পদনামটি কোথা থেকে এলো, এর আইনি ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সেটা বলতে পারেননি। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে তার পাশে সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব মিলিয়ে উপস্থিত অন্তত আট জন কর্মকর্তাও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এক পর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, 'এটি যারা বাংলা অনুবাদ করেছেন, তাদের কাছে জেনে নিতে পারেন।'

এরপর আমরা যোগাযোগ করেছি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষের (বাবাকো) কর্মকর্তাদের সঙ্গে, যারা সরকারি কর্মচারীদের 'পদবির পরিভাষা-২০১৮' প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত। বাবাকোর সিনিয়র অনুবাদ কর্মকর্তা আবুল হোসেন এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এরপর বাবাকোর বিশেষজ্ঞ কাজী জুলফিকার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান,  'ডেপুটি কমিশনার'-এর বাংলা পরিভাষা 'ডেপুটি কমিশনার'ই রেখেছিলাম, পরে সেটি উপরের নির্দেশে পরিবর্তন করে 'জেলা প্রশাসক' রাখা হয়েছে। এটা সঠিক অনুবাদ নয়, তা সবাই জানি। কিন্তু মন্তব্য করতে পারব না।

আগ্রহ উদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, 'ডেপুটি কমিশনার'-এর ঊর্ধ্বতন হিসেবে বিভাগীয় প্রশাসনে যিনি দায়িত্ব পালন করেন, তার পদবি 'কমিশনার', বাংলা পরিভাষায় যা 'কমিশনার'ই রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে 'কমিশনার'কে 'বিভাগীয় প্রশাসক' হিসেবে হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।

'জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৫' উপলক্ষে শনিবার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদকে প্রশ্ন করেছিলাম, সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনিও স্বীকার করেছেন, আইন-বিধিতে 'জেলা প্রশাসক' শব্দটির উল্লেখ নেই।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি বলেছেন, 'জোর যার মুল্লুক তার নীতি ঔপনিবেশিক আমল থেকে প্রয়োগ হচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে সেটা রয়ে গেছে। ডিসিদের "জেলা প্রশাসক" পদবি বহাল রাখা তারই ধারাবাহিকতা।'

তার ভাষ্য, 'প্রশাসক শব্দের মাধ্যমে একটি মাতবরি বা মোড়লিপনার ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা বলে মনে করি। সরকারি কর্মচারীদের এমন মনোভাব গ্রহণযোগ্য নয়। এই পদনামটি পরিবর্তন হওয়া উচিত।'

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসক বা প্রশাসক হন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। রাষ্ট্রের প্রধান আইনি দলিল সংবিধানে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে 'নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর' প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক শাসনের ভার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক ইউনিটগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধির নেতৃত্বে পরিচালিত হবে।

দেশের প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর অন্যতম—উপজেলা, জেলা ও বিভাগ। বাস্তবতা হচ্ছে এর কোনোটিই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে না। উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও কার্যত এসব প্রতিষ্ঠানকে আলংকারিক করে রাখা হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যানরা সরকারের কাছ থেকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে এখন আদালতে মামলা লড়ছেন।

এক সময় ডিসির দায়িত্ব পালন করেছেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ কে এম আব্দুল আওয়াল মজুমদার বলেন,  'ডেপুটি কমিশনার'র বাংলা কোনোভাবেই 'জেলা প্রশাসক' হতে পারে না। এটা কেন করা হলো তা বোধগম্য নয়। এখনকার বেশিরভাগ অফিসার তো পড়াশোনা করেন না, এসব তারই ফল। তবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলা পরিভাষা হিসেবে জেলা প্রশাসক ব্যবহার হয়ে আসছে বলে জানান তিনি।

প্রসঙ্গত বিভিন্ন জেলার ওয়েবসাইটগুলোতে ঢুকলে দেখা যায় ডিসিরা তাদের পরিচয় লিখেছেন, 'জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট'। প্রশ্ন হচ্ছে—'জেলা প্রশাসক' শব্দদ্বয় যদি 'জেলা ম্যাজিস্ট্রেট'-এর বাংলা পরিভাষা হবে, তাহলে একই বিষয় দুইবার করে লিখার অর্থ কী?

প্রসঙ্গত, ডিসিদের জেলায় তিন ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কমিশনার। অর্থাৎ রাজস্ব আদায়, বিচার সংক্রান্ত এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের সমন্বয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দায়িত্বটি দুইশ বছরের বেশি সময় আগের, যা ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনামলের। শেষোক্ত দায়িত্বটি যোগ হয়েছে পাকিস্তান আমলে।

এর মধ্যে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর হলে ডিসিরা শুধু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্বে থাকেন, যেটিও সংবিধান সম্মত নয়। বিষয়টি নিয়ে আদালতের রায় এখনো অপেক্ষমাণ। তাই সময়ের বিবর্তনে 'জেলা প্রশাসক' পদনামটি ব্যবহার কেন হচ্ছে?

প্রশ্ন হচ্ছে—বিড়ালের গলায় এই ঘণ্টা পরাবে কে? প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের মতে, এমন সংস্কারমূলক কাজের জন্য যে মানদণ্ডের কর্মচারী প্রয়োজন, প্রশাসনে তেমন ব্যক্তিদের দেখা যায় না। শীর্ষ কর্মচারীরা ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা খোঁজেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য পদলেহন করেন, চাকরি শেষ হলে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আবারও নিয়োগের তদবির করেন। ফলে এ ধরনের সংস্কারমূলক উদ্যোগ প্রশাসনের ভেতর থেকে আসছে না।

প্রশাসন পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা তৈরির প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়োকচিত গুণ নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা গড়ে উঠতে পারছেন না। ফলে অপেক্ষাকৃত বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলারা প্রশাসনে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে যা ইচ্ছা তাই করার সাহস দেখাতে পারে।

সাবেক সচিব বদিউর রহমানের মতে, 'এ ধরনের বিষয়গুলো সমাধানের জন্য রাষ্ট্রের পরতে পরতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা সেটা করতে এখনো সফল হতে পারেননি। ফলে কর্মচারীরা নিজেরদের মতো আইন-বিধির ব্যাখ্যা করে নিজেদের সুপিরিয়রিটি বজার রাখার অপচেষ্টা করে, মানুষ অন্তর থেকে এসব অপছন্দ করেন। পদ দিয়ে সম্মান পাওয়া যায় না, সম্মান পেতে হলে অন্যকে সম্মান দিতে হয়।'

বাহরাম খান: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

20 non-banks on BB red list

As of December last year, they disbursed Tk 25,808 crore in loans against collateral worth Tk 6,899 crore, according to the BB report

10h ago