চট্টগ্রাম আদালতে ‘আয়নাবাজি’

চাকরির লোভে কারাগারে আসামির বদলে অন্যজন, আইনজীবীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

মো. আজির উদ্দিন কুড়িগ্রামের ছেলে। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জে। তার বিরুদ্ধে নেই কোনো মামলা। কিন্তু আর্থিক প্রতারণার এক মামলায় মূল আসামির পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করে যান কারাগারে। কথা ছিল, এর বিনিময়ে আজির উদ্দিন পাবেন একটি ভালো চাকরি।

শেষ পর্যন্ত আজির উদ্দিনের আর চাকরি পাওয়া হয়নি। অথচ গত এক মাসের বেশি সময় ধরে তিনি জেল খাটছেন।

'আয়নাবাজি' সিনেমার মতো এমন ঘটনা নজরে এলে মামলাটি নিয়ে নড়েচড়ে বসেন আদালত। সংশ্লিষ্ট মামলা থেকে মুক্তিনামা দেওয়ার পাশাপাশি বিচারক সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।

অন্যদিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আরেকজনের পক্ষে আদালতে হাজির হওয়ায় আজিরের বিরুদ্ধে বিচারকের নির্দেশে মামলা করা হয়েছে। একইসঙ্গে মূল আসামির বিরুদ্ধে আবারও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন আদালত।

আজ সোমবার চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪ এর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হক এই আদেশ দেন।

পাশাপাশি আসামির পরিচয়ে অন্য একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র সত্যায়ন এবং জাল ওকালতনামার জন্য কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না—তা এই মামলার আইনজীবীকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জমা দিতে বলেছেন আদালত।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ থানায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে ২০২৩ সালে মামলা হয়। ওই বছরের ১৫ অক্টোবর মামলার দুই ও তিন নম্বর আসামি নাজমুল হোসেন ও মো. নবিজ উদ্দিন হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পান। জামিনের মেয়াদ শেষ হলেও নবিজ বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি। ২৮ ডিসেম্বর আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেন।

একই সময়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত গ্রহণ করেন। নবিজকে পুলিশ গত ৪ মার্চ কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানা থেকে গ্রেপ্তার করে নিকটবর্তী আদালতে নেয়। পরের দিন নবিজ বাদীর সঙ্গে আপস করার কথা জানিয়ে আদালত থেকে জামিন নেন।

নথি অনুসারে, গত ২৫ মার্চ ধার্য তারিখে নবিজ আদালতে মামলার হাজিরা দেননি। কিন্তু গত ১২ ডিসেম্বর আজির উদ্দিন নবিজ সেজে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত নাকচ করে হাজতে পাঠান।

সূত্র জানায়, সেই সময় আজির উদ্দিনকে নবিজ সাজিয়ে আদালতে মিথ্যা ওকালতনামা জমা দেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট তৌহিদুর রহমান খান (টিআর খান)।

কারাগারে যাওয়ার পর আসামির আঙুলের ছাপ নিতে গেলে শুরু হয় বিপত্তি। জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমে আঙুলের ছাপ নিতে গেলে দেখা যায়, কারাগারে থাকা নজিব উদ্দিনের নাম দেখায় আজির উদ্দিন। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে কারারক্ষীদের সব ঘটনা খুলে বলেন আজির।

কারাগার থেকে প্রতিবেদন আকারে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আদালত গত রোববার আজির উদ্দিনকে হাজির করেন। আজির আদালতকে জানান, আসামি নবিজ উদ্দিন ও নাজমুল হোসেন আপন ভাই। নাজমুল তার ভাইকে বাঁচাতে চাকরির প্রলোভন দিয়ে আজির উদ্দিনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন এবং আদালতে উপস্থাপন করেন। কথা ছিল জামিন করিয়ে আজির উদ্দিনকে ভালো চাকরি দেওয়া হবে।

চট্টগ্রাম জেলা আদালতের কোর্ট পরিদর্শক হাবিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আদালত থেকে লিখিত আদেশ পেয়েছি। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ে অন্য আসামির পক্ষে হাজতে যাওয়ায় আজির উদ্দিন ও নাজমুলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার কথা বলা হয়েছে এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আজির উদ্দিনকে উপস্থাপন করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে।'

এ বিষয়ে টিআর খান তাহিমের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

একজনের হয়ে আরেকজনের কারাবাস চট্টগ্রামে নতুন ঘটনা নয়। নগরের কোতোয়ালি থানার এক হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই কারাগারে যান মিনু আক্তার। মর্জিনা আক্তার নামে পূর্বপরিচিত এক নারী তাকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কারাগারে যেতে বলেন। তিনি কুলসুমাকে চেনেন না। তার সন্তানদের দেখভালের জন্য মাসে মাসে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষের দিকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মিনু কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান।

২০২১ সালের ১৬ জুন তিন বছর পর মুক্তি পান মিনু। ওই সময় কারাগারে আঙুলের ছাপ চালু ছিল না। পরে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। গ্রেপ্তার হন কুলসুমা। এভাবে চট্টগ্রামে কারামুক্ত থাকতে অনেক আসামি প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা চুক্তিতে নিজের বদলে অন্য ব্যক্তিকে আসামি সাজিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করাচ্ছেন।

এছাড়া, ২০২৩ সালে এমন ১২টি ঘটনা শনাক্ত করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

Comments

The Daily Star  | English

Plane collides with military helicopter near Washington airport, 18 bodies found so far

The regional passenger plane from Kansas crashed into Potomac River after the mid-air collision

3h ago