দখলে মরিয়া তৃণমূল: ঠেকাবে কে?

হঠাৎ আমাদের এক জুনিয়র ফ্রেন্ডের ফোন। একটা জেলায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সে। ভীষণ ব্যস্ততা তার। তবুও মাঝে মাঝে ফোন পাই। তার সঙ্গে কথা হওয়া মানেই দেশের মাঠপর্যায়ের হালআমলের খবর পাওয়া। আর্থিকভাবে দারুণ সৎ, কিন্তু লিবারেল ঘরানার এই কর্মকর্তার দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনাও অন্যরকম। সবসময় আউট অব দ্য বক্স চিন্তা করেন।

ফোন করেই বললেন, 'হাতে সময় কম, কথা বেশি বলব না। জানতে চেয়েছিলেন, দেশের মাঠপর্যায়ের বর্তমান অবস্থা কি? হোয়াটসঅ্যাপে একটা কাগজ পাঠালাম। পড়ে দেখেন। দেশের তৃণমূলের নতুন পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।'

তার পাঠানো কাগজটা পড়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।

এটা রাজনৈতিক দলের প্যাডে লেখা তৃণমূলের দুজন উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক পদাধিকারীর স্বাক্ষরিত তদবিরপত্র। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, একটা বড় রাজনৈতিক দলের উপজেলা পর্যায়ের দুজন শীর্ষ নেতা এমন চিঠি লেখেন কীভাবে? অফিসিয়াল প্যাডে স্মারক নম্বরসহ লেখা এই তদবিরপত্রে একটি বেসরকারি হাইস্কুলের গভর্নিং বডির এডহক কমিটির সভাপতি করার জন্য একজনের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সুপারিশ করা হয়েছে।

দলটির উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব স্বাক্ষর করে পাঠিয়েছেন এই তদবিরপত্র। তাতে লেখা হয়েছে, উল্লিখিত ব্যক্তি তাদের দলের মনোনীত প্রার্থী এবং ওই জেলার একজন বড় নেতা, সাবেক মন্ত্রীর (মন্ত্রীর নামসহ) ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। তাকেই ওই হাইস্কুলের গভর্নিং বডির এডহক কমিটির সভাপতি করা হোক।

চিঠিটি পড়ে কতগুলো প্রশ্ন মাথায় এলো?

প্রথমত, দেশে কোনো রাজনৈতিক সরকার নেই। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও নেই। সাধারণত যখন কোনো নির্বাচিত সরকার থাকে, তাদের রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিরাই সরকারি দলের প্রতিনিধি হিসেবে নানারকম সুপারিশ নিয়ে মাঠ কাঁপিয়ে বেড়ায়। এখন তো দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই। তাহলে, এই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষমতায় না থেকেও এমন অনৈতিক-অনধিকার ক্ষমতার চর্চা করছেন কীভাবে?

লিখিতভাবে এমন অনৈতিক, বেআইনি সুপারিশ করছেনই বা কোন রাজনৈতিক বিবেচনায়?

কবে নির্বাচন হবে, কবে তারা সরকারে যাবে, তার ঠিক নেই। অথচ এখনই এমন প্রমাণাদিসহ অনৈতিক-অনধিকার বেআইনি কাজ করার উদ্যোগ নিচ্ছেন কোন সাহসে?

এটা কি তাদের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা, নাকি দুঃসাহস? তাদের কেন্দ্রীয় নেতারা কি এসব বিষয়ে অবহিত? নাকি, তাদের সম্মতিতেই ঘটছে এসব!

২.

এই ঘটনার বিস্তার কেমন? এটি এক বা দুই জেলার ঘটনা, নাকি সারা দেশেই এরকম ঘটছে? রাজনৈতিক বিটের এক সাংবাদিককে ফোন করে জানতে চাইলাম। খুবই করিৎকর্মা, খোঁজখবর রাখা এই সাংবাদিকের তথ্যাদির ওপর আমার ভরসা বিস্তর। পুরো ঘটনা জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আসা কাগজটি পাঠিয়ে তার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলাম।

জানালেন দুদিন আগে তার একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা।

উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় গেছেন। জেলা প্রশাসকের রুমে বসে আছেন। হঠাৎ সেখানে হাজির একজন স্থানীয় সাংবাদিক। সঙ্গে একটি ছাত্রসংগঠনের ছাত্র ও যুবদলের বেশ কয়েকজন নেতা। সেই সাংবাদিক সঙ্গে আনা রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরিচয় করে দিয়ে জানালেন একটা তদবিরে এসেছেন। স্থানীয় একটি হাইস্কুলের গভর্নিং বডির এডহক কমিটির সভাপতি করতে চান তারা যুবদলের এক নেতাকে। সঙ্গে আনা সেই নেতাকেও পরিচয় করে দেওয়া হলো। ডিসি জানালেন, এই পদের জন্য আপনাদের মূল দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি একজনের নাম ও সাধারণ সম্পাদক আরেকজনের নাম সুপারিশ করে গেছেন। আপনারা সবাই মিলে বসে একজনকে ঠিক করে আনেন। তাহলে আমাদের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।

আমার স্নেহভাজন রাজনৈতিক বিটের সাংবাদিক তার অভিজ্ঞতার বয়ান শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লেখা একজন জেলা প্রশাসকের একটি চিঠিও পাঠালেন। এই চিঠিটি জেলা প্রশাসক লিখেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর। তিনি জানিয়েছেন, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি গঠন করতে গিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা মাঠপর্যায়ে কি দারুণ জটিলতায় পড়েছেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে সভাপতি মনোনয়নের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে পরস্পর সমন্বয়হীনতা ও মতবিরোধের কারণে অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি উক্ত কমিটি গঠন করতে গিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের রোষানলের সম্মুখীনও হচ্ছেন।' এই অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানগণ কর্তৃক জটিলতা পরিহারের জন্য সভাপতি হিসেবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মনোনয়ন দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া, এডহক কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধির ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের আত্মীয়-স্বজনকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

এসব পরিস্থিতি বয়ান করে ওই জেলা প্রশাসক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এডহক কমিটি গঠনে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও জটিলতা নিরসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

৩.

এখন এটা একটা কুইজ হতে পারে? এই রাজনৈতিক দলের নাম কী? কারা তৃণমূলের মাঠ-ঘাট-জলাশয়-বাজার-নদী-খাল-বিল-টার্মিনাল-খাসজমি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লেগেছে? পত্রপত্রিকায় সেসব খবর বেরুচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী নিজ দলের দখলদারদের হাতে খুন হওয়ার খবরও মিলছে। মিডিয়ার বাইরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেও জানা যাচ্ছে এসব কাজে তৃণমূলে কারা হামলে পড়ছেন।

এ পর্যন্ত যাদের সঙ্গেই আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে তারা সবাই উদ্বিগ্ন। কেননা, তারা ভাবছেন বড় রাজনৈতিক দল, যারা বহুদিন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তারা বেসামাল হয়ে পড়ছেন। তৃণমূলে এখনই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে, দলের মূল নেতৃত্ব শেষাবধি বড় ধরণের রাজনৈতিক দুর্নামের ভাগি হয়ে পড়বেন। এখনই কেন্দ্রের উচিত তৃণমূলের রাশ টেনে ধরা, তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা, দলের সবপর্যায়ে কড়া বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া।

এটা জরুরি, কেননা—

১. বাংলাদেশ এখন একটা বড় রাজনৈতিক সংকটে উপনীত। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে দেশে সুশাসনের যে জনপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে সেটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। জনপ্রত্যাশা জনহতাশায় রূপ নিলে সেটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরেই বাধা সৃষ্টি করবে। তাতে অগণতান্ত্রিক শাসন নতুন চেহারায় আবির্ভূত হতে পারে। শাসনতান্ত্রিক রূপান্তরে তা অজানা বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করতে পারে। সেই সংকটে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রাজনীতি চাপে পড়তে পারে। রাজনৈতিক স্তরে নতুন সংকট জনপরিসরের ভাবনাকেও বদলে ফেলতে পারে।

২. মানুষ যদি ভেবে নেয়, আমাদের পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই আগের চেহারা বদলাবে না, সুশাসনের নতুন মাত্রা আনবে না, তবে তাতে, দেশের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক আবহের প্রাতিষ্ঠানিক পুনঃপ্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

৩. দেশের ভোটার সংখ্যায় একটা নতুন জনমিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রে নতুন কণ্ঠস্বরের সোচ্চার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাদের শক্তি, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির চাইতে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যার বিচারে বৃহৎ বলে আবির্ভূত হলেও নৈতিক মানে, আত্মাহুতির প্রাবল্যে, সাহসে, বীরত্বে, ফ্যাসিবাদের পতনের প্রাণপণ লড়াইয়ে এই নতুন শক্তির কাছে বড় বলে প্রমাণিত হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্তির চেতনায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে বহুমাত্রিক আপোষে পারঙ্গম বলে প্রমাণিত হচ্ছে।

ফলে, নতুন জনমিতির নতুন কণ্ঠস্বর আগামী দিনে কোন দিকে জনরায় দেবে সেটা ঠাওর করা সম্ভব নয়। ফলে আদর্শে, সুশাসনের ইঙ্গিতে, নয়ারাষ্ট্রের গঠনের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলে সেটাও রাজনৈতিক রূপান্তরের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করতে পারে।

৪. দেশে এখন ভোটার সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। ২০০৮ সালের পর এখন অবধি ভোটার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ কোটি। এই নতুন ভোটার, মোট ভোটারের ২৫ শতাংশ। যাদের মন-পরিচয় আমাদের অজানা। কেননা, এই ভোটারদের সিংহভাগ এখনো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। বড় রাজনৈতিক দল পরিচালনাকারী সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে এই ভোটারদের বয়স-চিন্তার বিস্তর ফারাক রয়েছে। রাজনীতিতে তার ছাপ পড়েছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাজে ও আচরণে যদি সুশাসনের চেহারা সুস্পষ্ট করতে না পারে, তবে সেটাও রাজনীতির গণতান্ত্রিক হস্তান্তরের পথকে বিপাকে ফেলতে পারে। এমনকি ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার পথকেও সুগম করতে পারে।

পুনশ্চ: নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরই এখন গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত নয়। রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও নতুন শর্ত। যার মূল কথা হচ্ছে সুশাসন। ফ্যাসিবাদের বদলে নতুন লুটেরা-দখলদার অলিগার্ক শ্রেণির পুনর্প্রতিষ্ঠার রাজনীতি গায়ের জোর দেখাতে পারে কিন্তু নৈতিক জোরে তা জনহৃদয় জয় করতে না পারলে, টেকসই হবে না। এই কথাটা আমাদের বড় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা না বুঝলে বড় ভুল করবেন। তাতে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, দেশও সুরক্ষিত থাকবে না।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English
VAT changes by NBR

NBR revises VAT, SD on 9 items following public outcry 

NBR said it has slashed VAT on ready-made clothes, restaurants, sweets, non-AC hotels and motor workshops and mostly restored to the previous levels

1h ago