প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন
সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটের বিধান পুনর্বহালের প্রস্তাবও করেছে।
আজ বুধবার সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট চালু করার জন্য সুপারিশ করেছে। এই দ্বিকক্ষে যাতে করে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ করতে এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছে।
কমিশন মনে করে, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করেছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষমতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। সে কারণে যাতে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ ও নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ—প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
সেই কমিশন থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার যারা আসবেন বিরোধী দল থেকে এবং একজন থাকবেন যিনি অন্যান্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করবেন।
কমিশন মনে করে এই প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে পারবে।
'এটা প্রায় স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা জরুরি এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দিতে না পারেন, এজন্য এগুলোকে কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করার সুপারিশ করেছে।'
কমিশন মনে করে প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়ার ব্যবস্থা দরকার এবং সেই কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যেন প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য কমিশন তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছে।
কমিশন মনে করে যে, বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটার সঙ্গে তারা দ্বিমত পোষণ করেছে এবং কমিশন বলেছে, বাংলাদেশ পরিচিত হওয়া উচিত জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে।
কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট কাঠামোর পরামর্শ দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে কমিশন মনে করে যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক না, সেজন্য এটিকে কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর অর্পণের পরামর্শ দিয়েছে৷
কমিশন বিচারবিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সুগম করতে হলে এবং সবার কাছে পৌঁছে দিতে হলে কমিশন মনে করে বিচারবিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার৷
কমিশন সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই দেশের সব বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের মর্যাদা এবং এখতিয়ার-সম্পন্ন একটি একক স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
কমিশন মনে করে এবং যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা সবাই মনে করে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা থাকা জরুরি, সেজন্য কমিশন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। তারা জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয়ক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবও করেছে।
এ ছাড়াও কমিশন মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণের কথা বলেছে এবং সেগুলোকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষার জন্য একটি সমন্বিত একক সনদের সুপারিশ করেছে।
কমিশন মনে করে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের যে পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, তাতে করে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে কমিশন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে এবং এক ধরনের নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে যাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সেটার সুপারিশ করেছে।
কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ সুপারিশ জমা দেওয়ার সময় বলেন, কমিশন আশা করে সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারবেন।
Comments