বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্য কোটা চালু থাকা কি জরুরি?
জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। ওই অভ্যুত্থানের মূলমন্ত্র ছিল একটি বৈষম্যবিহীন সমাজের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা। তা সত্ত্বেও, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কোটা চালু আছে।
এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য যে কোটা রয়েছে (পোষ্য বা ওয়ার্ড কোটা নামে পরিচিত), তা সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিতর্ক ও বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের কোটা বাতিলের দাবি জানালেও অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষক এটি চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি এ ধরনের কোটা চালু থাকা উচিত? এটি কি জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে মানানসই?
প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়—এই আট বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ ধরনের কোটার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা রয়েছে। এই সাতটির মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি পোষ্য কোটা আন্দোলনের মুখে বাতিল ঘোষণা করা হয়। তবে বাকি ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো এই চর্চা অব্যাহত রয়েছে। পোষ্য কোটার বাইরে বাকি ১০ ধরনের কোটা হলো প্রতিবন্ধী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, খেলোয়াড়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অ–উপজাতি (পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালী), বিদেশি শিক্ষার্থী, দলিত, চা–শ্রমিক ও বিকেএসপি (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) কোটা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকার বিষয়টিতে অনেকেই সমর্থন জানালেও, অন্যেরা যুক্তি দেন, পোষ্য কোটাসহ কয়েক ধরনের কোটার ধারণাই এখন বাতিলের খাতায় চলে গেছে। এগুলোকে পুরোপুরি বাতিল অথবা বাস্তবসম্মত উপায়ে সংস্কার করা উচিত বলে তারা মত দেন।
এ ক্ষেত্রে আলাদা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তান, স্ত্রী ও এমন কী, ভাই-বোনদের জন্যেও কোটা রয়েছে। পরীক্ষায় পাস করলেই পোষ্যরা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তির সুযোগ পান। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ এই কোটার আওতায় প্রতিটি বিভাগে সর্বোচ্চ চারজনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কোটা ন্যায্য নয়, কারণ একটি আসনের জন্য হাজারো সাধারণ শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কম-বেশি পোষ্যদের জন্য কিছু আসন নির্দিষ্ট করা থাকে, যা মেধাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবমাননা। বিস্ময়করভাবে, এতদিন পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য কোটা চালু ছিল, যার আওতায় উপাচার্য তার পছন্দ অনুযায়ী ২০ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে পারতেন। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এই কোটা বাতিল হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, পোষ্য কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করাই সবচেয়ে মঙ্গলজনক। তবে আমরা স্বীকার করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের এই ব্যবস্থা চালুর রাখার দাবিতেও যুক্তি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত যুগপৎভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বৈষম্যবিরোধী ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেতনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমরা পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের পাশে আছি। আমরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি। ভর্তি প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের বৈষম্য থাকতে পারে না। এটাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে তা ন্যায্য হয় এবং প্রকৃত মেধাকে স্বীকৃতি দেয়। শুধুমাত্র তখনই আমাদের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বৈষম্যহীন সমাজের মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটবে।
Comments