যৌক্তিক সংস্কার ছাড়া রাজনৈতিক অসারতার বিলোপ সাধন অসম্ভব

'ইতিহাস চীনের বিচার করবে'—নোবেল লরিয়েট লিও জিয়াওবোর মৃত্যুর পর পেন ইন্টারন্যাশনাল, রাইটার্স ইন প্রিজন কমিটির চেয়ার সলিল ত্রিপাঠি কথাটি বলেছিলেন। মানবাধিকার কর্মী লিও জিয়াওবো ২০১৭ সালে কারান্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বে অর্থনৈতিক সূচকে চীনের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে রাজনৈতিক মানদণ্ডে দেশটির অবস্থান বেশ পেছনে।

তাবৎ পৃথিবীতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, হাইব্রিড রেজিম বা মিশ্র শাসন এবং কর্তৃত্ববাদী দেশ রয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ভূমিকা কর্তৃত্বের কণ্ঠস্বর না হয়ে মানবতাসূলভ হলে পৃথিবীতে আজকের এই যুদ্ধ, হানাহানি ও রক্তপাত দেখতে হতো না। আবার মিশ্র শাসন এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন জারি না থাকলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মোড়লিপনার সুযোগ সৃষ্টি হতো না।

আরব বসন্তের সাম্প্রতিক সম্প্রসারণের ফলে বাসার আল আসাদের রাজত্বের অবসান ঘটেছে। মাত্র ১২ দিনেই তাকে বহু বছরের শাসনের স্তম্ভ ছেড়ে রাশিয়ায় পালাতে হয়েছে। যেমন গণঅভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। যে স্বপ্ন, আস্থা, বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গী করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই স্বপ্নের ডানায় প্রথম পেরেকটি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই ঠুকেছিলেন। সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর তিনি নিজে সেটি কাঁটাছেড়া করেছিলেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বাঙালির দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাহস ও আদর্শের প্রতীক। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত শাসনামলে ক্ষমতার মসনদ স্থায়ী করতে বাকশাল ও রক্ষীবাহিনী গঠন করেও শেষ রক্ষা হয়নি।

ভেবে অবাক হই, আওয়ামী লীগ কখনো শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিত কেন সৃষ্টি হলো—তার কারণ নির্ণয় করার চেষ্টা করেনি।

পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছিল গোলমেলে, অস্বচ্ছ ও নানা দোলাচলে আচ্ছন্ন। ১৯৮২ সালে লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নব দৃশ্যপটে উপস্থিত হলেন। সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিং—ধারণা থেকে তিনি ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও কবি-লেখক শ্রেণিকে ক্ষমতা, বিত্ত ও চাকচিক্যের মোহে আবিষ্ট এবং উদ্বুদ্ধ করে নিজের ওজন ভারি করলেন। তারাও সানন্দে এরশাদের চলার পথের সারথি হলেন। কূটাভাসের কলেবর বৃদ্ধির কারণে শাসনের সময় দীর্ঘায়িত হলো।

নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর জনগণ আবার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা থেকে পার্লামেন্টারি সরকার ব্যবস্থার ঘোষণায় জনগণ ছিল আনন্দে উন্মাতাল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন হলে বিএনপি ক্ষমতা লাভ করে এবং সেই ক্ষমতা তারা বহমান রাখতে চায়। পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায়ও সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলন তুঙ্গ পরিণতি লাভ করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। বিএনপি প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নিজ ঘরানার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে। ফলে ২০০৬ সালের শেষে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বহুল চর্চিত ১/১১'র জন্ম হয়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। একটানা ১৫ বছর সাত মাস তারা দেশ শাসন করেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের চরম বিতর্কিত এবং চাতুর্যে ঘেরা নির্বাচনের কুশীলব এই আওয়ামী লীগ। পরিবারতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সেই সরকার কমপক্ষে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল।

নব্বইয়ের পর বাংলাদেশের প্রধান দুটি দল বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় থেকে আসলে কী প্রসব করেছে? দেশের জনগণকে কী উপহার দিয়েছে? ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি তাদের শাসনামলে জাতীয় গ্রিডে  বিদ্যুৎ যুক্ত করতে পারেনি। 

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে একটি নীল নকশা তৈরি করেছিল কীভাবে তারা ঘৃণ্য ও জঘন্য উপায়ে আজীবন ক্ষমতার লাগাম ধরে রাখবে। ফলে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ—আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও গণমাধ্যমকে ধ্বংস করেছে। তারা জ্বী হুজুর মার্কা মোসাহেব শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল, যাদের প্রধান কর্মযজ্ঞ ছিল—নির্মমভাবে বিরুদ্ধমত দমন করা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। থানাগুলো হয়ে উঠেছিল গায়েবি মামলার তোষাগার।

বিদেশি ঋণের টাকায় জনগণকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসানোর গোলকধাঁধা ছিল ক্ষমতা কব্জায় রাখার প্রধান অস্ত্র। আপেক্ষিক উন্নয়ন পিরামিডের মতো উঁচুতে উঠেছে আর জনগণ তাদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে ক্রমান্বয়ে ছিটকে পড়েছে। অপর একটি অতীতের সোনালি আলো আওয়ামী লীগ অসৎ উদ্দেশ্যে অতি মাত্রায় উসকে দিয়েছে। সেটি হলো—মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তারা এটি প্রচার করেছে এবং জনগণের মগ্ন চৈতন্যে একটি বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছে যে, তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক। এটি প্রতিষ্ঠিত করতে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানকে বহুমাত্রিক পথে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। তাদের সরকারের গঠনমূলক সমালোচকদের রাজাকার আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এসবই আওয়ামী সরকারের বাধাহীন ক্ষমতা প্রলম্বিত করার সুদূরপ্রসারী কৌশল।

উন্নয়ন কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের এজেন্ডার আওতাভুক্ত নয়। সরকার নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সূচকের মানদণ্ড অনুসরণ করে তার কার্যক্রম পরিচালনা করলে উন্নয়ন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। ২০০৬ সালে বিএনপির  শাসনামলে লন্ডনভিত্তিক ইআইইউ (দ্য ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) প্রকাশিত প্রথম ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে ৬ দশমিক ১১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক শ্রেণিতে। গত ১৭ বছর যাবৎ বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ হাইব্রিড রেজিম বা মিশ্র শাসন শ্রেণিতে রয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা তথৈবচ। এক কথায় অসারতার জালে বন্দী। টমাস মান যেমন বলেছেন, 'রাজনীতি আমাদের বিধিলিপি'। রাজনীতিবিদদের ভেতর গণতন্ত্রচর্চা, নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন এবং পরমত সহিষ্ণুতার অভাব প্রকট। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবর্তে অবজ্ঞা, আক্রোশ, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। বড় দুটি দল কখনো সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিল না এবং দুটি দলই পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সার্কাসে পারদর্শিতা দেখিয়েছে। শেষ ১৫ বছরে দূষিত রাজনীতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করেছে এবং ক্রমান্বয়ে তা হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী। ভয় ও আতঙ্ক ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি 'থুসিডাইডিস ফাঁদে' আটকে ছিল।

অবশেষে রক্তাক্ত জুলাই বিপ্লবের চরম বহিঃপ্রকাশ গণঅভ্যুত্থানের ফলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই চেতনাকে সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনের সময়সীমা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যথাযথ ও যৌক্তিক সংস্কারের পরেই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন যে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। তারা বারবার অলীক এক গণতন্ত্রের বয়ান শোনাচ্ছেন, যা অধরা স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে। তাদের আকাশ সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাসের বাষ্পে ছেয়ে আছে। বিএনপির ধারণা আওয়ামী লীগের পর তাদেরকেও মাইনাসের ষড়যন্ত্র চলছে। জামায়াতে ইসলামী অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য সময় দিতে আগ্রহী। অতীতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে আশনাই থাকলেও বর্তমানে দুদলই দূরবর্তী ও বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। অন্যদিকে ছাত্ররা 'জনশক্তি' নামে নতুন দল গঠন করতে চলেছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেবো না। এটাই আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার'।

রাজনৈতিক অসারতার কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই যথাযথ সংস্কার নিশ্চিত করেই নির্বাচনের পথে যাত্রা করা অবশ্য কর্তব্য। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। বিজয়ী দল সরকার গঠন করবে। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকাটা অপরিহার্য, তা না হলে 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স'র স্থানটি কার্যকর থাকবে না। তাই যৌক্তিক সংস্কার ছাড়া রাজনৈতিক অসারতার বিলোপ সাধন সম্ভব নয়।

লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট

Comments

The Daily Star  | English

Reform commission reports: Proposals seek to bring youths into JS

Reform commissions on the constitution and election process have both recommended measures that increase opportunities for the youth to run for parliament and become more involved in politics, sparking both hope and criticism.

9h ago