পচা মস্তিষ্কের প্রজন্ম কি সন্নিকটে?

বর্তমান বিশ্বে মানুষের দুই পৃথিবীতে বাস। এক. একচুয়াল ওয়ার্ল্ড বা প্রকৃত পৃথিবী দুই. ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড বা অনলাইন জগৎ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে মানুষ দীর্ঘ একটি সময় ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে যুক্ত থাকছেন। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা ধরনের আধেয়তে মানুষ এখন রীতিমতো আসক্ত।

ডাটারিপোর্টাল নামের একটি গবেষণা পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারাবিশ্বের মানুষ গড়ে ২ দশমিক ২৩ মিনিট সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকেন। যার ফলে ছন্দপতন ঘটছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। পতিত হচ্ছেন নানা ফাঁদে। কমছে সৃজনশীলতা। নষ্ট হচ্ছে আত্মিক প্রশান্তি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিপদজনক এবং প্রাণঘাতী ঘটনাও ঘটছে। ঘৃণার চাষ এবং অপপ্রচারও বিস্তৃত হচ্ছে বড় পরিসরে।

সমাজ জীবনে অনলাইন জগতের সর্বগ্রাসী আধিপত্যের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, অসাড়তা। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া এরইমধ্যে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করেছে। যুগান্তকারী এই বিলটি পাস করার সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলাবিনেসে আইন সভায় স্পষ্ট করে বলেছেন, আগামী প্রজন্মকে 'ক্ষতি' থেকে রক্ষায় তারা বদ্ধ পরিকর। নিঃসন্দেহে এই ক্ষতি বহুমুখী ও সর্বগ্রাসী।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধেয় যে একটি সৃজনশীল ও সংবেদনশীল প্রজন্মকে ভোঁতা ও অনুভূতিশূণ্য করে দিচ্ছে, এই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের একটি জরিপে। সংস্থাটির জরিপে ২০২৩ সালের আলোচিত শব্দ হিসেবে প্রথম স্থান অর্জন করেছে 'ব্রেইন রট' শব্দটি। যার সহজ বাংলা 'মস্তিষ্ক পচন'। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই শব্দটির ব্যবহার ২৩০ শতাংশ বেড়েছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় ভার্চুয়াল জগতের আগ্রাসনে কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সৃজনশীলতা। আর বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়েছে অসাড়তা ও পচন।

হুটসুইটে ও উই আর সোশ্যাল নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে ঢাকা অনেক আগেই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী শহরের খেতাব পেয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ছে স্মার্টফোনের ব্যবহার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত হওয়ার হার। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজেকে একজন ডিজিটাল ক্রিয়েটর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ। ফলে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে লাখো কনটেন্ট। যেগুলোর বেশিরভাগই স্থূল, চটুল, মানহীন। এই আধেয়গুলোর এক অংশ আবার বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে দেশে টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকের জন্য তৈরি এই আধেয়গুলোর বিশাল এক কনজিউমার বা ভোক্তা শ্রেণি ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। যারা প্রতিনিয়ত কোনো ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই এই আধেয়গুলো গলধঃকরণ করছেন। আর এতেই দ্বার উন্মোচন হচ্ছে একটি পচা মস্তিষ্কের প্রজন্মের।

পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ কি জানেন? গণযোগাযোগ তাত্ত্বিকদের মতে এই জগতের সবচেয়ে সহজ কাজ হলো ঘরে বসে টিভি দেখা। এতে কোনো কায়িক শ্রম নেই, এতে মাথাও খাটাতে হয় না। দুই দশক আগেও টেলিভিশনকে বলা হতো 'ব্রেইন রট' বা 'মস্তিষ্ক পচন'র প্রধান আধেয়। যার জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি সহজলভ্য স্মার্টফোন। যা ক্রমাগত পচিয়ে দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের সৃজনশীলতা ও উদ্যমকে। ধ্বংস করে দিচ্ছে উদ্ভাবনী শক্তি।

বড় পরিসরে যথাযথ কোনো গবেষণা না থাকায় বাংলাদেশে 'ব্রেইন রট' বা 'মস্তিষ্ক পচন' নিয়ে সাম্প্রতিক তথ্য আমাদের হাতে নেই। কিন্তু এই পচন যে আমাদের সমাজে শুরু হয়েছে তাতে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও চারদিকে একটু দৃষ্টি দিলেই আমরা দেখতে পাই মস্তিষ্ক পচনের নমুনা। যা চটুল বিনোদন আধেয় থেকে শুরু করে অপ্রপ্রচারভিত্তিক ইউটিউব ভিডিও পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব ভিডিওর গভীর ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। যেখানে একজন আধেয় গ্রাহক কোনো প্রশ্ন তুলছেন না, কোনো তথ্য ক্রসচেক করছেন না, নিজে প্রভাবিত হয়ে ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্ধভাবে, অকাতরে।

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল জেন-জি ও জেন-আলফা প্রজন্মের। তরুণ, সতেজ, সক্রিয় ও সংবেদনশীল এই শক্তিকে 'মস্তিষ্ক পচন' থেকে রক্ষা করতে হবে। এ দায়িত্ব একজন অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, আমলা, উপদেষ্টা সবার। এই দায়িত্ব পালনে সবাই ব্যর্থ হলে সমাজে অবধারিতভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। যার কিছু আলামত এখনই দৃশ্যমান।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Comments

The Daily Star  | English

Reform commission reports: Proposals seek to bring youths into JS

Reform commissions on the constitution and election process have both recommended measures that increase opportunities for the youth to run for parliament and become more involved in politics, sparking both hope and criticism.

10h ago