শক্তিশালী ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব আইজিপির

দুর্নীতি ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই নিজেদের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকেই একটি শক্তিশালী স্বাধীন 'পুলিশ কমিশন' গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী, পুলিশের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও পুলিশের কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্বে থাকবে এই কমিশন। এতে করে রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় পদোন্নতি ও নিয়োগের পুরোনো সংস্কৃতির অবসান ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।

সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধানের কাছে এই খসড়া প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। পুলিশের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে কাজ করছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।

গত ২৯ ডিসেম্বর আইজিপি বাহারুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা একটি পুলিশ কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন সংস্কারের প্রস্তাব পুলিশ সংস্কার কমিশনে দিয়েছি।'

কমিশনের লক্ষ্য হল পুলিশ যেন নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং জন-আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে তা নিশ্চিত করা। এছাড়াও, এর লক্ষ্য আইনের শাসন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করা।

কীভাবে পুলিশ কমিশন গঠন করা যেতে পারে সে ব্যপারে মতামতের জন্য সম্প্রতি অনলাইনে জরিপ পরিচালনা করে পুলিশ সংস্কার কমিশন। এই প্রক্রিয়ায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জরিপে অংশ নেওয়া ১৪,৩৮৯ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৫৮.৯ শতাংশ পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে একটি পৃথক তদারকি সংস্থা গঠনের পক্ষে মত দেন।

সাফার রাজ সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আইজিপির কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছি যেখানে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে।

সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য বলেন, কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের একটি সংযোজনী হিসাবে পুলিশের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেন, এটি কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো উল্লেখ না করেই একটি পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করবে।

যেমন হতে পারে পুলিশ কমিশনের কাঠামো

প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনে ১১ জন সদস্য থাকবেন। এর চেয়ারম্যান হবেন আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি।

সদস্যদের মধ্যে চারজন সংসদ সদস্য থাকবেন - দুইজন ক্ষমতাসীন দল থেকে এবং দুইজন বিরোধী দল থেকে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে পরামর্শ করে স্পিকার তাদের নাম প্রস্তাব করবেন।

কমিশনে আরও চারজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকবেন - একজন আইন বিশেষজ্ঞ, একজন মানবাধিকার কর্মী, একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি এবং সমাজবিজ্ঞান বা পুলিশিং সংক্রান্ত একজন শিক্ষাবিদ। এই চারজনের মধ্যে একজন নারী থাকবেন। রাষ্ট্রপতি একটি বাছাই কমিটির প্রস্তাবিত ছয় জনের তালিকা থেকে তাকে নিয়োগ দেবেন।

এছাড়াও, স্বরাষ্ট্র সচিব এবং আইজিপি পদাধিকারবলে পুলিশ কমিশনের সদস্য হবেন এবং আইজিপি সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।

প্রধান বিচারপতি অথবা তার মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বাছাই কমিটির প্রধান হবেন। এই কমিটিতে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধানগণ এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব অথবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।

কমিশনের কার্যাবলী

কমিশন আইজিপি নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নয় এমন তিনজন কর্মকর্তার একটি প্যানেল সুপারিশ করবে।

আইজিপির কর্মকালের মেয়াদ হবে অবসরের বয়স নির্বিশেষে দুই থেকে তিন বছর।

প্রস্তাবিত কমিশনকে আইজিপিকে অপসারণ করার ক্ষমতাও দেওয়া হবে, যদি কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন।

এটি পুলিশ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিশেষায়িত ইউনিট, উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), মেট্রোপলিটন কমিশনার এবং জেলা পুলিশ সুপার সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য নামও সুপারিশ করবে।

প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিটি নিয়োগ দুই বছরের জন্য হবে। সেই সঙ্গে, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং অন্যান্য সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করবে পুলিশ কমিশন।

সংস্কার কমিশনের আরেকজন সদস্য বলেন, এটা করা গেলে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে পদোন্নতি এবং লোভনীয় পদে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের অবসান ঘটাবে।

প্রস্তাবিত কমিশন প্রয়োজনে একটি জাতীয় জননিরাপত্তা নীতি এবং পুলিশ সম্পর্কিত আইন, বিধি ও প্রবিধিও প্রণয়ন করবে।

প্রয়োজনে এটি আইনসঙ্গতভাবে বলপ্রয়োগের পরিধি নির্ধারণ, পুলিশ প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিশেষায়িত ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা করার কাজও করবে।

কমিশনের মেয়াদ

পুলিশ কমিশনের সদস্যদের মেয়াদ হবে চার বছর। সংসদ ভেঙে গেলে সংসদ সদস্যরা কমিশনের সদস্য থাকবেন না, যেখানে কমিশনে নিয়োগ শুধুমাত্র এক মেয়াদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে।

ঋণখেলাপি, বিদেশি নাগরিক, কর ফাঁকিতে অভিযুক্ত, অর্থ আত্মসাৎকারী, অপরাধী বা প্রজাতন্ত্রের পদাধিকারী ব্যক্তি কমিশনের সদস্য হওয়ার যোগ্য হবেন না।

খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মী দিয়ে সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় তহবিলও বরাদ্দ করবে সরকার।

অভিযোগ ব্যবস্থাপনা

কমিশন একটি অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি তত্ত্বাবধান করবে, যেখানে কমিশনের তিনজন সদস্য থাকবেন। এই কমিটি পুলিশের বিরুদ্ধে বিদ্যমান অভিযোগ সুরাহার জন্য আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে কেউ সন্তুষ্ট না হলে এই তিন সদস্যের কমিটির কাছে আপিল করতে পারবেন।

এই অভিযোগ কমিটি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা যে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন তা সমাধানের জন্য কমিশন একটি তিন সদস্যের অভিযোগ প্রতিকার কমিটিও গঠন করবে।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

4h ago