আচমকাই কেন আসাদের পতন?
![আসাদের পতনের পর তার পোর্ট্রেট ছিঁড়ে ফেলে উল্লসিত জনতা। ছবি: এএফপি](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/12/09/afp_20241208_36pu2mu_v1_highres_syriaconflictkurds.jpg)
মাত্র এক বছর আগের কথা। প্রায় ১০ বছর বাইরে রাখার পর আরব দেশগুলোর প্রধান সংগঠন আরব লিগে সিরিয়াকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বিশ্ববাসী ভেবেছিল দামেস্কে বাশার আল আসাদ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেলেন। আরব লিগে সিরিয়ার ফিরে আসা মানেই প্রতিবেশী সৌদি আরবসহ বাকি ২১ আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া।
আর রিয়াদের যেখানে সায়, সেখানে সঙ্গী পেতে সমস্যা হয় না। কিন্তু, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল 'গণেশ উল্টে গেছে'।
সিরিয়ায় বাপ-বেটার পাঁচ দশকের বেশি সময়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী ও সরকারবিরোধী আন্দোলন যখন প্রায় স্তিমিত হয়ে আসছিল বা বাবা হাফিজ আল আসাদের হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাশার আল আসাদের ক্ষমতা যখন শত ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে প্রায় পোক্ত হওয়ার পথে তখনই এলো বিদ্রোহীদের হাতে দামেস্কের পতন ও বাশারের পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ।
আরব বসন্ত ও সিরিয়ার 'চোরাবালি'
![বাশার আল-আসাদের প্রাসাদে ব্যাপক ভাঙচুর করে সিরিয়রা। ছবি: এএফপি](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/12/09/afp_20241208_36pt7md_v1_highres_syriaconflict.jpg)
একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০১০ সালের শুরুতে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় 'আরব বসন্ত'র বাউলা বাতাসে সে দেশের একনায়ক জয়নাল আবেদিন বিন আলির সরকারের পতন ও তার দেশ পালানোর পর সেই বাতাস আরও গতি নিয়ে আঘাত হানে মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর, জর্ডান, ইয়েমেন ও বাহরাইনসহ অন্যান্য দেশ ও সিরিয়ায়।
আরব বসন্তের জেরে ২০১১ সালে সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির একদলীয় শাসনে থাকা সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে এই আন্দোলনকে সুন্নিপ্রধান সিরিয়ায় শিয়াপন্থি প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে সৌদি ও তুরস্ক সমর্থিত 'বিশৃঙ্খলা' হিসেবে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শুধু তাই নয় সেসময় দামেস্কে গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলন জোরালো হলে গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিরা সরকারের পক্ষত্যাগ করতে শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাশার আল আসাদ সেই আন্দোলন দমন করেন অস্ত্রের জোরে।
অস্ত্রের জবাব অস্ত্র দিয়ে দেওয়ার বাসনায় আন্দোলনকারীও হাতে অস্ত্র তুলে নেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের। একেক দেশ থেকে পাওয়া সমর্থন নিয়ে বিরোধীরা ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লে সেই সুযোগে হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে উঠে সশস্ত্র গোষ্ঠী আইএসআইএল। তারা বাশার সরকারের পাশাপাশি গণতন্ত্রকামীদেরকেও শত্রু মনে করায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ 'চোরাবালি'র চেহারা পায়। কে যে কার শত্রু তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। বিশ্ববাসী আগ্রহ হারান সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহে।
এমন পরিস্থিতিতে আইএসআইএল বা সংক্ষেপে আইএস যোদ্ধারা সিরিয়ায় শিয়াদের পবিত্রস্থানগুলোয় হামলা চালালে বাশার আল আসাদের সরকারের প্রতি সমর্থন দেয় শিয়াপ্রধান আঞ্চলিক শক্তি ইরান। প্রথমে রুশ সরকার সিরিয়ায় থাকা তাদের নৌঘাঁটি নিয়ে আতঙ্কিত হলেও পরে মিত্র তেহরানকে পাশে পেয়ে বাশার আল আসাদের সমর্থনে সরব হয়ে উঠে মস্কো।
আইএস দমনের লক্ষ্য নিয়ে দামেস্কের সঙ্গে তেহরান ও মস্কো জোট বাঁধলে একই উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রও। মিত্রদের সহযোগিতায় ওয়াশিংটন ঘাঁটি করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়। সুযোগ বুঝে যুদ্ধে জড়ায় বাশার আল আসাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ তুরস্কও। সিরিয়ায় থাকা কুর্দিরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বাশার সরকার তাদেরকে স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। স্পষ্টত বহু দলে বিভক্ত হয়ে যান কুর্দিরা।
'সিরিয়ার অনেক কুর্দি তুরস্কের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছেন'—এমন বার্তা নিয়ে আঙ্কারাও সেনা পাঠায় সিরিয়ার মাটিতে। এতে আরও জটিল হয়ে উঠে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। এমন জটিলতায় ঝুলে যায় বাশার সরকারের ভাগ্য। সিরিয়ায় বাশারের বিরুদ্ধে লড়াই করা গোষ্ঠীগুলো মূল লক্ষ্য হারিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে সেই সুযোগে নিজেকে 'অবিসংবাদিত' করে তোলেন বাশার আল আসাদ। টিকে যায় তার সরকার। শুধু টিকেই যায় বললে হয় না, মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও করে তোলে।
বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো
![বাশার আল-আসাদের ব্যক্তিগত বাসভবনে ভাঙচুর করে সিরিয়রা। ছবি: এএফপি](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/12/09/afp_20241208_36pv87x_v3_highres_syriaconflict.jpg)
শুধুমাত্র ভিন্নমতের কারণে শত শত বছর নিপীড়িত হওয়ায় সংখ্যালঘু আলাওয়াত বা আলাভি সম্প্রদায়ের তরুণরা সিরিয়ায় ফ্রান্সের শাসনামলে দলে দলে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৪৬ সালে ফরাসিরা সিরিয়া ছাড়লে আলাভি-পরিচালিত সেনারা হয়ে উঠেন দেশটির 'ভাগ্য বিধাতা'।
সিরিয়ায় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সুন্নি হলেও খ্রিষ্টানসহ অন্যদের সমর্থন নিয়ে ১০ শতাংশের শিয়া মতাবলম্বী আলাভিরা দেশ শাসনের ভার নেয়। সেনা কর্মকর্তা ও বাথ পার্টির নেতা হাফিজ আল আসাদ দেশটির ১৮তম প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭১ সালে। ক্ষমতায় থাকেন আমৃত্যু। তথা ২০০০ সাল পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হন ছেলে বাশার আল আসাদ।
হাফিজ ও বাশারের মূল শক্তি ছিল 'জাতীয় ঐক্য'। জাতিগতভাবে বহুধা বিভক্ত সিরীয়দের অস্ত্র ও ক্ষমতার জোরে নীরব রাখতে পেরেছিলেন তারা। সমাজতান্ত্রিক বলয়ের সমর্থন নিয়ে পিতা-পুত্র হয়ে উঠেন পশ্চিমের বিরোধী শক্তি। নিজ ভূখণ্ডের বাইরে প্রথম রুশ ঘাঁটি গড়ে উঠে সিরিয়ায়। তাই এ দেশটিকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা কথা বলতো নিচু সুরে।
প্রায় দেড় যুগ আগে আরব বসন্ত শুরু হলে পশ্চিমের দেশগুলো যখন দেখলো তাদের পছন্দের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তখন তারা দ্বিমুখী নীতি নেয়। অপছন্দের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সরব হয়। বাশার যেহেতু পশ্চিমের কাছে ব্রাত্য তাই তিনি পশ্চিমবিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেকে দেশে-বিদেশে পরিচিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
২০০৩ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতন হলে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমবিরোধী মুখ হিসেবে বাশার পরিচিত হতে শুরু করেন। সম্পর্ক জোরদার করেন রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে। রাশিয়ার পুতিন সরকার সিরিয়াকে গুরুত্ব দেয় ভূমধ্যসাগরে নিজের অবস্থান জানান দিতে। তুরস্কের রেসিপ এরদোয়ান আসেন ব্যবসার সুবিধা পেতে। ইরানের আয়াতুল্লাহরা দেখেন লেবাননের হিজবুল্লাহদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুবর্ণভূমি হিসেবে।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়লে সিরিয়ায় তার প্রভাব পড়ে। গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ায় পণ্যের বাজার বহু আগেই হারিয়েছিল তুরস্ক। সাম্প্রতিক ইসরায়েল যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হিজবুল্লাহ। সিরিয়ার চলমান পরিস্থিতি দেখে তাই হয়ত বলা যায়—এসবই ছিল বজ্র আঁটুনির ফসকা গেরো।
আচমকাই কেন আসাদের পতন?
![ছাগলের কান সম্বলিত বাশারের প্রতিকৃতি নিয়ে আনন্দ মিছিল করছে প্রবাসী সিরিয়রা। ছবি: এএফপি](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/12/09/afp_20241208_36pw6qt_v2_highres_germanysyriaconflict.jpg)
পড়তে পড়তে প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়ানো বাশার আল আসাদকে এভাবে পালাতে হলো কেন—তা সাধারণ পাঠকের কাছে অনেকটাই ধোঁয়াশার। প্রায় ১৪ বছর লড়াই করে যিনি টিকে ছিলেন তিনিই কিনা মাত্র দুই সপ্তাহের যুদ্ধে কুপোকাত!
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর সিরিয়ায় গোপন ও প্রকাশ্য হামলা চালিয়ে আসাদের সেনাবাহিনীকে ভীষণ দুর্বল করে দিয়েছে। তারা সেখানে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের তৎপরতা নস্যাৎ করে দিয়েছে। সিরিয়া ও ইরান সরকার সবসময়ই সেসব তথ্য গোপন করে গেছে। এমন ভাব দেখিয়েছে যে 'কিছুই হয়নি। ওসব কাটিয়ে উঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র'।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমের দেশগুলো আর্থিকভাবে সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে রাখায় গত ৪ ডিসেম্বর এক মার্কিন ডলারের বিনিময়ে সিরীয়দের দিতে হয় সাড়ে ১৭ হাজার সিরীয় পাউন্ড। দেশটিতে বাশারের জনপ্রিয়তা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। এর একদিন পর সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসি 'কেন এত দ্রুত আসাদ সরকারের পতন?' প্রতিবেদনে জানায়, বাশার আল আসাদকে রক্ষার মতো কেউ পাশে নেই।
বাশারের সরকারি বাহিনীর একনিষ্ঠ সহযোগী হিজবুল্লাহও তার বিপদে লেবানন থেকে আসতে পারেনি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হলে সেই কম্পন নাড়িয়ে দেয় বাশারের মূল সমর্থনকারীদের। এক এক করে সবাই হাত গুটিয়ে নেওয়ায় ধসে পড়ে প্রায় পাঁচ দশকের আসাদ-সাম্রাজ্য।
বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রদের দুরবস্থায় দিশেহারা ইরান নিজেকে বাঁচাতেই যখন ব্যস্ত তখন বন্ধু বাশারের দিকে নজর দেওয়া দেশটির জন্য 'বিলাসিতা'। তাই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সহায়তায় বিদ্রোহী হায়াত তাহরির আল শামসের নেতৃত্বে বাশারবিরোধী সব গোষ্ঠী 'এক ছাতা'র নিচে জড়ো হলে বাশারের পতন ঘটে অনেকটা বিদ্যুৎগতিতে।
তাই এক বছর আগে আরব লিগে ফিরিয়ে নেওয়ার যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা যেন নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের হঠাৎ জ্বলে ওঠার মতোই।
Comments