জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেল প্রকল্প: ৮২ শতাংশ বেড়ে ব্যয় হতে পারে ২৬ হাজার কোটি টাকা
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা হতে পারে, যা প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে ৮২ শতাংশ বেশি। শুরুতে চীন প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে চাইলেও পরে সরে আসে। ফলে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ায় এই ব্যয় বৃদ্ধি।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ১৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল ঢাকা এবং দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেললাইনটিকে ডুয়াল-গেজ ডাবল লাইনে রূপান্তর করা।
কিন্তু চীন ২০২১ সালের মার্চে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোয় প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি।
বাংলাদেশের অনুরোধে জাপান প্রকল্পটি অর্থায়নে রাজি হয় এবং এর সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যালোচনা করে। জাপানি পরামর্শকরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে এখন ২৫ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা লাগবে, যা প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে ১১ হাজার ৬৯৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বা ৮২ শতাংশ বেশি।
২০২০ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে প্রকল্প ব্যয় এক হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমানোর নির্দেশ দেওয়ার চার মাস পর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় চীন। তখন বলা হয়েছিল, প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি।
এখন প্রকল্পটি ৮২ শতাংশ বেশি ব্যয়ে ২০৩০ সালের জুনে শেষ হতে পারে।
এই প্রকল্পের দেরি হওয়ার কারণে যমুনা নদীর ওপর ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রেলসেতুটি অন্তত পাঁচ বছর অপর্যাপ্ত ব্যবহৃত হবে। সেতুটি জানুয়ারিতে খুলে দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সেতুটি ডাবল-লাইন হলেও সিঙ্গেল-লাইন রেলপথ থেকে ট্রেন যাবে সেতুতে।
রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত ৩০ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি জাপানের একটি প্রাক্কলিত বাজেট, যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমরা এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করব।'
তিনি জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কর্মকর্তারা তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য জাপানের সহযোগিতাকে সাধুবাদ জানান এবং প্রকল্প ব্যয় যৌক্তিক করার কথা বলেন।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, এ মাসের শেষের দিকে জাপানের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করবে বলে আশা করা যাচ্ছে এবং তারা রেলওয়ে প্রকল্প, বিশেষ করে ব্যয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন।
ট্রেন চলাচলে দেরি হওয়ার কারণ
ঢাকা ও দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর দেরি হওয়া গত কয়েক বছর ধরে একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সিঙ্গেল লাইন রেলপথ দিয়ে চলাচল করে। এই লাইনে সর্বোচ্চ ২২টি ট্রেন সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব। যেখানে প্রতিদিন ট্রেন চলছে প্রায় ৪০টি। এর ফলে অল্প কয়েকটি ট্রেন ছাড়া প্রায় সবগুলোকেই রেল ক্রসিংয়ে পড়তে হয়।
জয়দেবপুর এবং বঙ্গবন্ধু সেতু (পূর্ব) স্টেশনের মধ্যে একটি স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনের দূরত্ব তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হওয়ায় প্রতিটি ট্রেনকে আরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়।
প্রকল্পে দেরি
এই সমস্যা সমাধানে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ১৪ হাজার ২৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকার প্রকল্পটি গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেললাইনকে ডুয়াল-গেজ ডাবল লাইনে রূপান্তর করা হবে।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের জন্য চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
লাইন সম্প্রসারণের জন্য চীনের আট হাজার ৭৫৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অর্থায়ন করার কথা ছিল এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা সম্পন্ন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে চুক্তি সইয়ের জন্য চীন সরকারকে একাধিক চিঠি দিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়।
কিন্তু চীন ২০২১ সালের মার্চে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে, 'সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ঘাটতি ও প্রাথমিক কাজ অপর্যাপ্ত।'
সূত্রগুলো দাবি করছে, এই প্রকল্প থেকে চীনের পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে ভূ-রাজনীতির কিছু সম্পর্ক থাকতে পারে। এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে মালবাহী ট্রেন যোগাযোগ আরও বাড়ত। এর পাশাপাশি প্রকল্পের খরচ কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনাও ভূমিকা রেখেছে।
ব্যয় বৃদ্ধি
চীন প্রকল্পটি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর জাপান এতে অর্থায়নে রাজি হয়েছে এবং তারা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন দেখেছে। গত অক্টোবরে জাইকার একটি প্রতিনিধি দল রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকও করেছে।
জাপানি কর্তৃপক্ষের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রকল্পটির ব্যয় হবে ২৫ হাজার ৯৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা ১৯ হাজার ১০৩ কোটি টাকা ঋণ দেবে এবং বাকি অর্থ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে।
রেল সূত্র এই প্রকল্পের ব্যয় এত বেশি বৃদ্ধির পেছনে তিনটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছে।
একজন রেল কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে যখন অনুমোদিত হয় তখন প্রকল্প ব্যয় ২০১৩ সালের হার অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে নতুন ব্যয় ২০২৩ সালের হার অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া, প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ডলার-টাকার বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকার কাছাকাছি, যা এখন প্রায় ১২০ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এই দুটিই ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ।'
তিনি জানান, এরসঙ্গে এই প্রকল্পের অধীনে একটি অতিরিক্ত রেল স্টেশন তৈরি করা হবে। এর কারণেও ব্যয় কিছুটা বাড়বে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলপথ মন্ত্রণালয়কে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে জানানো হয়েছে এবং মন্ত্রণালয় এর উত্তরে বিস্তারিত নকশা তৈরির সময় যথাসম্ভব ব্যয় কমানোর চেষ্টা করতে বলেছে।
প্রকল্পটির বিস্তারিত নকশা প্রস্তুত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে ইতোমধ্যে ১৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
সূত্র জানায়, বিস্তারিত নকশার পর প্রকল্পের ব্যয় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে, যার জন্য পরামর্শক নিয়োগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নকশার কাজ ও বিডিং নথি তৈরি করতে ১৫ মাস সময় লাগতে পারে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জাইকার একটি প্রতিনিধি দল এ মাসের শেষের দিকে ঢাকায় আসতে পারে এবং সবকিছু ঠিক থাকলে মার্চে ঋণ চুক্তি হতে পারে।
Comments