৩৬ জুলাই ২০২৪

শেখ হাসিনা পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর সংসদ ভবনের সামনে হাজারো মানুষ জমায়েত হন। ছবি: নাঈমুর রহমান/স্টার
শেখ হাসিনা পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর সংসদ ভবনের সামনে হাজারো মানুষ জমায়েত হন। ছবি: নাঈমুর রহমান/স্টার

আবু ইসহাক যে একজন মধ্যবয়সী, তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। তার পরনের রক্তে রঞ্জিত সাদামাঠা ধূসর চেক শার্টটির নিচে জীর্ণশীর্ণ গেঞ্জিতে কোনোমতে জুড়ে দেওয়া এক টুকরো কাগজে হস্তাক্ষরে লেখা তার নাম-পরিচয়।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা এই মানুষটি গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ও সে একজন বাবার এবং পরিবারের দায়িত্বই পালন করছিলেন—বাজারে যাচ্ছিলেন নিত্যপণ্য কিনতে।

মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ইসহাকের তরুণ ছেলে হুংকার দিয়ে বলে উঠল, 'বাবাকে কবর দেওয়ার পরও যদি এই সরকার ক্ষমতায় থাকে, আমি নিজেই সরকার টেনে নামাব।'

তার আর প্রয়োজন পড়েনি। মাটিতে ইসহাকের মরদেহ যখন পড়ে ছিল, ঠিক সে সময়ই শেখ হাসিনা দেশত্যাগের জন্য বিমানবন্দরের পথে।

ইসহাকের মাথার ক্ষত থেকে নির্গত লাল রক্ত স্ট্রেচার গড়িয়ে ওয়ার্ডের মেঝেতে জমাট বেঁধেছিল। তুলা দিয়ে একজন রক্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু সেই চেষ্টাও ছিল বিফল, ঠিক যেমন বিফল ছিল ইসহাককে বাঁচানোর উদ্যোগ।

ইসহাকের লাশ সরানো হলেও দিনভর ওই রক্তের দাগের পরিধি শুধু বাড়তেই থাকে। কারণ ইসহাকের জায়গায় আসে অন্য মরদেহ—আদনান-নূরের মতো আরেও অনেকের।

আদনান একটি স্থানীয় অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিক ছিলেন। তিনিও যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা। তার খুলিতেও গুলির ক্ষত। তার রক্তেও রঞ্জিত মেঝের সেই একই জায়গা।

নূরের মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন একজন পথচারী। তিনি জানান, নূর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন এবং যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়।

নূর যে আসলেই মৃত, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি মেশিনের প্রয়োজন পড়েনি, পড়েনি কোনো কাগজের রিপোর্টেরও। তার খুলির অর্ধেক গুলির আঘাতে উড়ে গেছে। রোগাদেহের এই মানুষটি গলায় প্রেসকার্ড ঝুলিয়ে সাংবাদিক হওয়ার চূড়ান্ত মূল্য পরিশোধ করেছেন। অখ্যাত পোর্টালের এই সাংবাদিক গণমাধ্যমের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে হয়তো থেকে যাবে অজানা।

এরপর সেখানে জায়গা হয় ২২ বছর বয়সী হামিদুর রহমানের। রক্তের দাগবিহীন বুক—শুধু ফুসফুসের ডান পাশে ছোট একটি ক্ষতস্থান। হঠাৎ দেখলে মনে হতেই পারে হামিদুর ঘুমিয়ে আছেন। তার দেহ দেখে বিভ্রান্ত নার্সরাও ডিফিব্রিলেটর বের করে হামিদুরের ঘুম ভাঙানোর শেষ চেষ্টা করেন।

তবে তার বুকের ওপরের গর্তেই স্পষ্ট ছিল শেষ মুহূর্তে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতা—একদম কাছ থেকে, পয়েন্টব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি চালানো না হলে গুলির ক্ষত এমন হয় না।

হামিদুর যে আসলেই মৃত, তা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না তার বন্ধু রাফিও। ক্লান্ত দেহের সব শক্তি ঢেলে দিয়ে বন্ধুর বুকের ওপর বারবার চাপ দিয়ে নিথর হৃৎপিণ্ড সচল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল রাফি। কিন্তু পারেনি হামিদুরের ঘুম ভাঙাতে।

পরাজিত রাফি লুটিয়ে পড়ে বন্ধুর মরদেহের পাশে। 'বংশাল পুলিশ এই হত্যার জন্য দায়ী। আমি তাকে (হামিদুর) বিক্ষোভে যোগ দিতে রাজি করিয়েছিলাম। এখন আমি কীভাবে তাকে ছাড়া তার বাবা মায়ের কাছে যাব?', কান্নাজড়িত কণ্ঠে কোনোমতে এ কথাগুলো বলেন রাফি।

মেঝেতে জমাটবাধা রক্তের দাগ বাড়তেই থাকল।

হামিদুরের জায়গা নিলো ১৩ বছর বয়সী শাওন। শাওনের রক্তমাখা স্ট্রেচারের ওপর আর্তনাদ করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক বৃদ্ধ। সাদা দাঁড়ি, টাক মাথা ও জীর্ণশীর্ণ মানুষটি শাওনের বাবা। তাকে দেখে মনে হলো, এই সন্তানটি ছিল তার শেষ বয়সের ইচ্ছে পূরণের নিদর্শন। সেই সন্তানের নিথর মরদেহ এখন মেঝেতে পড়ে আছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই গণহত্যায় অন্তত ২০০ শিশু প্রাণ হারিয়েছে।

মেঝেতে রক্তমাখা চাদর জড়ানো অপর এক ব্যক্তিকে ইসিজি মেশিন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন প্রথমবারের মতো মেশিনে আঁকাবাঁকা রেখা দেখা গেল। মানুষটি এখনো বেঁচে আছেন। নার্স উত্তেজনায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, 'লাশ তো কথা বলছে!' বাকিরা এসে দ্রুত তাকে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে শয্যায় শুইয়ে দিলেন।

মারণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে পুলিশ ও পুলিশের সশস্ত্র ব্যাটালিয়ন। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার
মারণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে পুলিশ ও পুলিশের সশস্ত্র ব্যাটালিয়ন। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

মানুষটি সেই মুহূর্তেই শয্যা পেলেন, ঠিক যে মুহূর্তে অন্য এক অভাগা রিটন তার প্রাণ, একইসঙ্গে হাসপাতালের শয্যাটিও হারালেন।

যাত্রাবাড়ীর দোকানি রিটনের পুরো দেহে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো ছিল ব্যান্ডেজ। গুলির আঘাত নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি। গলায় আঘাত হেনে সেই গুলি তার মাথার পেছন ভেদ করে বের হয়ে যায়। ভাইয়ের মৃত্যু মানতে পারছিলেন না আরিফুর।

রিটনের প্রাণহীন দেহ শয্যা থেকে মেঝেতে সরিয়ে নেওয়ার সময় প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তিনি। 'আমার ভাই পড়ালেখা করতে পারেনি। তিনি কাজ করতেন যাতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারি। পড়ালেখা শেষে আমি চাকরি নিয়ে দুইজনের খরচের যোগান দিতে চেয়েছিলাম। সে কীভাবে মারা যেতে পারে?'

গাড় সবুজ রঙের প্লাস্টিকের বেডশিটের ওপর রিটনের ছোপ ছোপ লাল রক্তে যেন ফুটে উঠেছিল জাতীয় পতাকার অবয়ব।

মানুষের কান্না, চোখের পানি, রক্ত, তীব্র গন্ধ—এই সবকিছুতেই অবিচল থেকে যন্ত্রের মতো সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি কাজ করে গেছেন প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল চিকিৎসাকর্মীরা। ঘড়ির কাঁটার মতো বিরামহীনভাবে ঘুরে চলা তাদের রুটিন—মরদেহ বহন করে আনা, পরীক্ষা করে মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া, মরদেহের জন্য ট্যাগ বানানো, মেঝেতে বা বাইরের হলে মরদেহে রেখে আসা।

কক্ষে একমাত্র জীবিত রোগী ছিলেন শাহ মো. শাহরিয়ার। কক্ষের এক কোণে, নিজ শয্যায় সোজা হয়ে বসে ছিলেন তিনি। তার দেহের সঙ্গে আইভি সংযুক্ত করা ছিল। ডান কাঁধে ছিল ব্যান্ডেজ। দিনভর মেঝেতে লাশের আসা-যাওয়ার নির্মম দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন তিনি।

'চানখারপুলের কাছে আমাকে গুলি করে বিজিবির সদস্যরা। আর কয়েক ইঞ্চি নিচে বুলেটের আঘাত পেলে আমিও বাকিদের সঙ্গে মেঝেতেই থাকতাম,' ব্যথায় জর্জরিত কণ্ঠে বলেন তিনি।

দিনের শেষ অব্দি ইসহাক যেখানে ছিলেন তার আশেপাশের জায়গাগুলোতে মোট ৪১ জন ঠাঁই পায়। প্রায় এক মাসের বিক্ষোভের এই দিনটিই ছিল সবচেয়ে রক্তাক্ত। ৫ আগস্টের এই দিনটিকেই জেন জি'দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ডাকা হয় '৩৬ জুলাই'।

ওই ৪১টি মরদেহের মধ্যে ৩২টিই এসেছে যাত্রাবাড়ী ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে। শেখ হাসিনার পতনের দিন নগরীর সবচেয়ে ভয়াবহতম ও সহিংস এলাকায় পরিণত হয় যাত্রাবাড়ী।

হাসপাতালে আনার আগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ তিন অথবা তার চেয়ে বেশি ঘণ্টা ধরে সড়কের ওপর পড়ে ছিল। তাদের সবার দেহে ছিল তাজা গুলির ক্ষত। অনেক পরে জানালা থেকে ধারণ করা একটি ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই ভিডিওতে সামনের সড়কের নারকীয় ঘটনাগুলো স্পষ্ট ধরা পড়ে, যা সাক্ষ্য দেয় যাত্রাবাড়ীর সহিংসতা-গণহত্যার।

সম্ভবত, দুপুর ২টার দিকে এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়। এতে দেখা যায়, দলে দলে পুলিশ বের হয়ে এসে সড়কে বিক্ষোভকারীদের খুঁজে বের করে পাখির মতো গুলি করে মারছে। যদিও ধারণা করা হয়, চাইলে তারা মারণাস্ত্র ব্যবহার না করেই সড়কে জমায়েত হওয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারত।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, দিনের মাঝামাঝি সময় থেকেই পুলিশ কারফিউ ভঙ্গ করা বিক্ষোভকারী ও যারা শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাদের উদ্দেশে গুলি চালাচ্ছিল। যখন হাসিনার পতন হলো ও গণভবন জনতার দখলে চলে গেল, তখন বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপর পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায়।

হাসিনার পতনের পর কর্ণফূলী ইপিজেডের পুলিশ রেঞ্জে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছবি: স্টার
হাসিনার পতনের পর কর্ণফূলী ইপিজেডের পুলিশ রেঞ্জে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছবি: স্টার

বিক্ষোভকারীরা ছিল নিরস্ত্র, বিপরীতে মারণাস্ত্র সজ্জিত পুলিশ। যদিও ততক্ষণে সরকারের পতন হয়েছে, তবুও হাসিনা-সরকারের অনুগত পুলিশ যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই গুলি করেছে।

সেই গণহত্যায় নিহত একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশের পাশে বসে ছিল ১৮ বছরের কম বয়সী এক কিশোর। লাশ বহন করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল সে।

সেই কিশোর এবং আরও অনেক বিক্ষোভকারী যাত্রাবাড়ী থানা ঘেরাও করে ভবনটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিল। রক্তের দাগ লেগে থাকা হাত নেড়ে ছেলেটি বলতে লাগল, 'দিনের শুরুর দিকে পুলিশ আমার ভাইদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। আমরা থানা দখল করতে চেয়েছিলাম। জোহরের নামাজের এক ঘণ্টা পর আমরা থানার ভেতর ঢুকে পড়ি। কয়েকজন কমপাউন্ডে রাখা গাড়িগুলোতে অগ্নিসংযোগ করল। এ সময় তারা থানার ভেতর থেকে আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়ে।'

মোজাহিদুল ইসলাম নামের অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী দুপুর পৌনে তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থানার পেছনের একটি জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন। তিনি বর্ণনা দেন, 'আনুমানিক পৌনে তিনটার দিকে আমি বিক্ষোভে যোগ দিতে শাহবাগের দিকে রওনা দেই। থানার বাইরে রাখা পুলিশের গাড়িগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। হঠাৎ করেই দেখলাম, আমার পাশ দিয়ে বুলেট ছুটে যাচ্ছে। দৌড়ে থানার পেছনে আশ্রয় নিলাম। ভবনের ছাদে পুলিশ অবস্থান নিয়েছিল। সেখান থেকে সড়কে কাউকে আসতে দেখলেই গুলি ছুড়ছিলেন তারা।'

তিনি জানান, বিকেল চারটা বেজে ৪৭ মিনিট নাগাদ পুরো থানা আগুনের গ্রাসে। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর, থানা প্রাঙ্গণে খুঁজে পাওয়া যায় আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া পাঁচ পুলিশের মরদেহ। তারা সবাই ছিলেন জুনিয়র কর্মকর্তা—কনস্টেবল থেকে শুরু করে সহকারী উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার। সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাদেরকে ফেলে পালিয়েছিলেন।

হাসিনা সাম্রাজ্যের বিদায়ঘণ্টা বাজলেও হাসপাতালগুলোতে তখনো ছিল অভিন্ন চিত্র।

মর্গের বাইরের মেঝেতে মরদেহের স্তূপ জমছিল। স্তূপাকারে শায়িত লাশগুলো নিজের ও সহযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে জায়গা করে নিয়েছিল একে অপরের পাশে।

দুর্ভাগা তারাই, যাদের মরদেহ সংগ্রহ করতে আসেনি কোনো স্বজন। মরদেহের ওপর চলছিল মাছিদের উৎসব। হাজারো মানুষ ব্যস্ত ছিল তাদের অন্তিম মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ধারণে।

অনেকের গায়ে কাফনের কাপড়ের মতো জড়ানো ছিল বাংলাদেশের পতাকা। সস্তা সিনথেটিক কাপড়ের উজ্জ্বল লাল রঙের বৃত্তটি রক্তে ভিজে উঠেছিল আরও গাড় লাল হয়ে। গুলিতে ঝাঁজরা সারিবদ্ধ লাশগুলোর বুক সাক্ষ্য দেয় ঠিক কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার তার দেশের জনগণের ওপর।

মাটিতে জমে থাকা রক্ত এড়িয়ে আমি মরদেহের সংখ্যা গণনা করতে ও নথিবদ্ধ করতে শুরু করি। এত এত 'অজ্ঞাতনামা' তকমাযুক্ত মরদেহগুলোকে কীভাবে তালিকাভুক্ত করব? নাম-পরিচয়বিহীন এই লাশগুলোর বুকে সাঁটানো কাগজে নাম লেখা 'অজ্ঞাতনামা'। পাশে ডাক্তারের আন্দাজে দেওয়া আনুমানিক একটা বয়স। এই 'অজ্ঞাতনামা' মরদেহগুলো শুধুই সংখ্যা; তারা 'নিহত'—এটাই মুখ্য। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দায়িত্বে এদের কবর হবে যেখানে থাকবে না কোনো নামফলক।

এভাবে ঠিক কতগুলো 'অজ্ঞাতনামা' মরদেহের কবর হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। ১ আগস্ট নাগাদ দ্য ডেইলি স্টার মর্গ রেজিস্টার থেকে ২১টি অজ্ঞাতনামা মরদেহের খোঁজ পেয়েছিল। তবে এই আন্দোলনের সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন ৫ আগস্টের পর নিঃসন্দেহে সংখ্যাটি আকাশ ছুঁয়েছিল। সেদিন অজ্ঞাতনামার কাতারে যোগ হয় আরও ১৯টি মরদেহ।

নাম-পরিচয়বিহীন লাশগুলোর বর্ণনা সেদিন আমার নোটখাতায় এইভাবেই লিখেছিলাম, 'কমবয়সী, তরুণ, যাত্রাবাড়ী থেকে। বুকে বেশ বড় ছিদ্র। কালিমাখা হাত। হয়তো মেকানিক। সম্ভবত অপ্রাপ্তবয়স্ক। যাত্রাবাড়ী থেকে আসা মরদেহ। দাঁড়ি আছে, লম্বা চুল। বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে বুলেট। দাড়িওয়ালা লাশ, বুকে ক্ষত। গতকালের অজ্ঞাতনামা, ১৪। আজকের আশিক, ১৪। আজ তার মা তাকে চিহ্নিত করেছেন। তলপেটে গুলি। উত্তর বাড্ডা থেকে আসা অজ্ঞাতনামা মরদেহ। গায়ে ছড়রা গুলির ক্ষত...'

ততক্ষণে হাসিনা তার সিংহাসন ছেড়ে পালিয়েছেন। গণভবন—উঁচু প্রাচীরে ঘেরা সেই দুর্গ—যেটির নামের পেছনের অনুপ্রেরণা 'জনগণের ভবন'—সেই ভবনের দখল নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছে জনগণ। ততক্ষণে সড়কগুলোতে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছে অগুনতি মানুষ।

শহীদ মিনার থেকে দুই দিন আগে একটি সুবিশাল মিছিল বের হয়েছিল, যা কার্যত বিগত সরকারের বিদায়-ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। আজ সেই একই জায়গায় চলছিল বিজয় র‍্যালি।

কয়েক সপ্তাহের সহিংসতা ও রাষ্ট্র-আরোপিত কারফিউর পর, অভিভূত জনগোষ্ঠী নিজেদের লাল-সবুজে রাঙিয়ে বিজয় উদযাপনে নেমে পড়ে। শিশুদের হাসি—যা পৃথিবীর সুন্দরতম শব্দের অন্যতম—আরও একবার সড়কগুলোতে শোনা গেল। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে গোলাগুলির কর্কশ শব্দ, মানুষের আর্তচিৎকার কিংবা ভীতিকর নীরবতায় যা ধামাচাপা পড়েছিল।

লুকিয়ে থাকা ফেরিওয়ালারা বের হয়ে এলেন, ঝালমুড়িওয়ালারা আবারও ঢাকার প্রিয় জলখাবারগুলো বানাতে লাগলেন, বেলুন বিক্রেতারা হিলিয়াম-ভর্তি আনন্দ বিক্রি করতে লাগলেন।

তবে সবাইকে ছাপিয়ে, সেদিন সবচেয়ে ভালো ব্যবসা নিশ্চিতভাবে করেছিলেন পতাকা বিক্রেতারা। রাস্তায় যতগুলো মানুষ, ঠিক ততগুলো লাল-সবুজের পতাকা। বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের নিজস্ব সংজ্ঞার দেশাত্মবোধ, ক্ষতিকর রাজনীতিকরণ ও গলা চেপে ধরা বাণিজ্যিকীকরণের নাগপাশ থেকে মুক্তি পাওয়া দেশপ্রেম মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করে দেখিয়ে দিলো ঠিক কত গভীরভাবে এই সুবিশাল জনগোষ্ঠী তাদের এক চিলতে দেশটিকে ভালবাসে।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে আর একবারও এ ধরনের অসামান্য জাতীয় ঐক্যের মুহূর্ত আসেনি। হাসিনার পতনের পর যখন সব শ্রেণির মানুষ নতুন করে তাদের স্বপ্নের দেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে ছুটে আসে, ঠিক তখনই অপ্রকাশ্য সামাজিক ভেদাভেদগুলো প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

নতুন করে পাওয়া এই স্বাধীনতার প্রথম মিনিটেই এ ভেদাভেদের বীজ বপন করা হয়েছিল। ক্ষুব্ধ জনতা তাদের গত ১৫ বছরের রাগ, বঞ্চনা ও হতাশা উগড়ে দেয় সেই মানুষগুলোর ওপর, যারা তাদের দিকে বন্দুকের নল তাক করে ট্রিগার চেপেছিল।

হাসপাতালে বিক্ষোভকারীদের মরদেহ আসার সংখ্যা হ্রাস পেলেও মৃত্যুর মিছিল শেষ হতে তখনো ছিল অনেক বাকি।

চাঁদপুরের শপথ চত্বরে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ভাস্কর্যের সঙ্গে তার মরদেহ বেঁধে রাখা হয়েছিল। একদিন আগে (৪ আগস্ট) এক পুলিশের বিবস্ত্র মরদেহ এনায়েতপুর থানার বাইরের একটি গাছে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। একই থানায় আরও ১০ জনের মরদেহ এদিকে-সেদিকে পড়ে ছিল। হিন্দুদের বাড়িতে হামলা হচ্ছিল। তছনছ করা হচ্ছিল গণমাধ্যম কার্যালয়। যশোরের এক হোটেলে অগ্নিসংযোগে পুড়ে মারা যায় অন্তত ২৪ জন জীবন্ত মানুষ। প্রতিশোধের আগুন ছিল সর্বগ্রাসী।

বিমানবন্দর পুলিশ স্টেশনে রাতভর জ্বলছিল আগুন। 'আমি থানার পেছনে একটি ছোট শেডের ভেতর লুকিয়ে আছি। আমাকে এখনো খুঁজে পায়নি', এক পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠ শুনলাম ফোনে। প্রায় ফিসফিস করে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। থানার বাইরের সেই শেডে লুকিয়ে ছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর এই পুরোটা সময় আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে থাকে থানা।

স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'তারা আমার সামনেই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এই ক্ষুব্ধ জনতা কারো কথা শুনে না। ভেতরে যারা আছেন, তারা কেউই বাঁচবেন না।'

কয়েক মুহূর্ত পরেই ছবির মাধ্যমে তার কথার প্রমাণ এলো। ছবিতে দেখতে পেলাম, এক বিবস্ত্র পুলিশ কর্মকর্তার হাঁটুতে দড়ি বেঁধে তাকে গাছের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দেহ থেকে প্রাণ চলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে—যেভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে জন্মদিনের উৎসবে উপহার ও চকলেট পেতে পিনাতার গায়ে লাঠি দিয়ে ক্রমাগত বাড়ি দিতে থাকে শিশুরা।

স্বাধীনতা উৎসবের উদযাপনকারীরা যখন বাড়িতে যায়, তখন তারা রাস্তায় কিছু মানুষকে রেখে যায়। সে রাতে তারা সড়কে রড হাতে টহল দিতে থাকে। সেই রাতে; নতুন করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের প্রথম রাতে আমি আমার কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো মাঝরাতে আমার বাবাকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলি। বলি, এসে আমাকে অফিস থেকে নিয়ে যাও।

জায়মা ইসলাম: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান 

Comments

The Daily Star  | English

Four killed in Faridpur as train hits microbus on level crossing

The accident occurred around 12:30pm at Munshibazar area in Faridpur Sadar

19m ago