‘নির্বাচনে অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত’

election commission logo

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে সেগুলোতে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য সুপারিশ করেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকরা।

আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভায় এমন সুপারিশ করেন তারা।

বৈঠকে দ্য ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের উচিত গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের জন্য দায়ীদের শাস্তির সুপারিশ করা।

নির্বাচনে অনিয়মে জড়িতদের 'নির্বাচনী অপরাধী' আখ্যা দিয়ে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া, সংসদের নারী সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করার ও আসনসংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার আহ্বান জানান গোলাম মোর্তোজা।

সংস্কার কমিশনকে পূর্ববর্তী তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার—কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ, কে এম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি জানান তিনি।

সাবেক তিন নির্বাচন কমিশনারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে 'ভোটারবিহীন' ও 'রাতের ভোটের' নির্বাচনের পেছনের কারণ বের করার এবং সে অনুযায়ী সামনের নির্বাচনের বিধিমালা সাজানোর সুপারিশ করেন ডেইলি স্টার বাংলার সম্পাদক।

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, আমার প্রস্তাব হচ্ছে অনাবাসী প্রতিনিধিত্ব হবে না। ঢাকায় থেকে খাগড়াছড়ি বা দিনাজপুরের প্রতিনিধিত্ব করবে না। এটা ওই এলাকার জনগণকে বঞ্চিত করা। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় খরচে নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী আসনে সরাসরি ভোট হতে পারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে। অথবা তিনটি আসন মিলে একটি নারী আসন হবে, যেখানে সরাসরি নির্বাচন হবে। সব নাগরিক যাতে তার পছন্দের প্রার্থী বাছাই করতে পারে সেটা আমাদের চাওয়া।

আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. মো. গোলাম রহমান বলেন, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে অনেক আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য আইনের পরিমার্জন, পরিবর্ধন করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে অতীতে দেখেছি যেভাবে প্রভাবিত করা হয়, সেই সুযোগ যেন না থাকে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন এই সময়ে তো সম্ভব না। এটা সংসদ থেকে করতে হবে। কেননা, সেখান থেকে করতে না পারলে কার্যকর হবে না।

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, নির্বাচন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক না কেন, নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে তাদের প্রভাবিত করা হয়ে থাকে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে না হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। এমন সিস্টেম যদি করতে পারি যে এনআইডি পাঞ্চ করে জানতে পারি সে ভোটার কি না এবং ভোট দিতে পারবে কি না। কেননা, ভোটার লিস্ট হওয়ার ছয় মাস পর কিন্তু অনেকের ১৮ বছর হয়ে যায়। এতে তিনি কিন্তু ভোট দিতে বঞ্চিত হন। এক্ষেত্রে এনআইডি কার্ডকেই ভোটার কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ভোটার লিস্টটাতে সময় ও অর্থের অপচয় হয়।

প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি বলেন, সবার আগে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল করতে পারলে দলীয় সরকারের অধীনে যে সমস্যা হয়, তার ৮০ শতাংশ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। এটা সবার আগে ভাবতে হবে। এর সঙ্গে সংবিধান সংস্কার কমিশনকেও ভাবতে হবে। তাদের প্রস্তাব সরকারকে দেওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও দেওয়ার জন্য। এতে দলগুলো বা সরকার কতটুকু মানল তা আমরা জানতে পারব। আরেকটা বিষয় হলো নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ১০০ আসনে নির্বাচন হবে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া গণমাধ্যমকর্মী ছাড়াও যারা ভোটের দায়িত্ব পালন করেন, তাদের আগাম ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেন জাতীয় নির্বাচনের আগে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেন থাকে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের উদ্যোগসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সিনিয়র সাংবাদিকরা করেছেন। আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি, কেননা, আমরা যা ভাবছি সেসব বিষয়ই তারা বলেছেন। স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য যেমন বলেছেন, তেমনি গণমাধ্যম সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে যেন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়, সেই সুপারিশও করেছেন তারা। এনআইডির-ভিত্তিতে যাতে ভোটার তালিকা করা যায়, আমরা সেটাও বিবেচনা করছি। কেননা, এতে ভোটের আগের দিনও কেউ ভোটার হতে পারবে। অনেক সুপারিশ আসছে ব্যতিক্রমধর্মী ও সাংঘর্ষিকও। আমরা সবগুলো পর্যালোচনা করে প্রস্তাব করব।

ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী আসনে নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ১০০ আসনে নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেবেন। এতে সংসদে ৪০০ আসন করতে হবে। লটারির মাধ্যমে প্রথমবার ১০০ আসনে, পরেরবার অন্য ১০০ আসনে এভাবে চারবারে ৪০০ আসনে নারীরা সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। আর অন্য আসনগুলোতে নারী ও পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই পদ্ধতি আছে। তবে বাস্তবে সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। নারীরা যাতে সবার মতো প্রথম শ্রেণির নাগরিকের মতো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো নয়, এমন প্রস্তাব তারা করেছেন। এ ছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা সুপারিশ করব।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে 'একতরফা' জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দলের বয়কটের পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ।

নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করলেও এতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানায়, নির্বাচনের আগের রাতেই ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এই নির্বাচন 'রাতের ভোটের নির্বাচন' হিসেবে খ্যাত।

সর্বশেষ কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনও বর্জন করে বিরোধী দলগুলো। অধিকাংশ আসনে দলীয় কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এটি 'ডামি নির্বাচন' হিসেবে খ্যাত।

শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

5h ago