দিনাজপুরের ঐতিহাসিক কান্তজীউ মন্দিরে ভ্রমণে যেতে চাইলে

কান্তজীউ মন্দির
ছবি: ইউএনবি

বাংলাদেশের স্থাপত্য নিদর্শন ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে দেশের ঐতিহাসিক মন্দিরগুলো। অনন্য নকশা, কিংবদন্তি শাসক ও সম্প্রদায় এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিকতার সন্নিবেশে মহাকালের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছে এই স্থাপনাগুলো।

যুগ যুগ ধরে শত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া তেমনি এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দির। কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের মন্দিরের ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করছে তিনশ বছরেরও বেশি সময়ের পুরাতন এই নান্দনিক তীর্থস্থানটি। চলুন দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ নিয়ে যাবতীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

কান্তজীউ মন্দিরের ভৌগলিক অবস্থান

উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম জেলা দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার অন্তর্গত সুন্দরপুর ইউনিয়নের কান্তনগর গ্রামে এই মন্দিরের অবস্থান। জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমের নদীটির নাম ঢেঁপা। এই নদীর তীরবর্তী শ্যামগড় এলাকার কান্তনগর গ্রামটি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে প্রাচীন কান্তজীউ মন্দিরের জন্য।

কান্তজীউ মন্দির বা কান্তজীর মন্দিরের নামকরণ

হিন্দু পুরাণ মতে এই অঞ্চলে শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ-বিগ্রহ অধিষ্ঠান হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান দেবতা শ্রীকৃষ্ণের ১০৮ নামের একটি হচ্ছে শ্রীকান্ত বা রুক্সিনীকান্ত। শ্রীকৃষ্ণের নামের এই কান্ত শব্দটি দিয়েই দিনাজপুরের তৎকালীন জমিদার প্রাণনাথ মন্দিরটির নাম রাখেন কান্তজীউ মন্দির। জীউ বা জী শব্দটি ব্যবহৃত হয় সম্মানার্থে। মন্দিরের গোড়াপত্তনের আগে স্থানীয় গ্রামটির নাম ছিলে শ্যামনগর। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামের নাম বদলে রাখা হয় কান্তনগর।

মন্দিরটিতে ছিল ৯টি রত্ন বা চূড়া, যার কারণে একে নবরত্ন মন্দির নামেও অভিহিত করা হতো।

কান্তজীউ মন্দিরের ইতিহাস

শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ-বিগ্রহ অধিষ্ঠানকে চির স্মরণীয় করে রাখতে জমিদার প্রাণনাথ রায় ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এ মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয় শ্রীকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী রুক্মিণীর প্রতি।

মন্দিরের কাজ অসমাপ্ত রেখেই মারা যান প্রাণনাথ। পরে তার পালক পুত্র রামনাথ রায় ১৭৫২ সালে সফলভাবে মন্দির নির্মাণের বাকি কাজ সম্পন্ন করেন। সব মিলিয়ে পুরো নির্মাণ কাজে সময় লেগেছিলো প্রায় ৪৮ বছর।

১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মন্দিরটির ৯ চূড়ার সবগুলোই ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে রাজা গিরিজনাথ মন্দিরের সংস্কার করলেও নবরত্নের চূড়াগুলো আর পুনঃনির্মাণ করা হয়নি। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সরকার কান্তনগর মন্দিরকে সংরক্ষিত প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

ঢাকা থেকে দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দির যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন, এবং বিমান তিনভাবে যাওয়া যায় দিনাজপুর। ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, আসাদগেট, কলেজগেট, শ্যামলী, টেকনিক্যাল মোড়, এবং উত্তরা থেকে পাওয়া যাবে দিনাজপুরের বাস। প্রায় সারাদিনই ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা পরপর গাড়িগুলো দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যায়। নন-এসি এবং এসি কোচগুলোর ভাড়া পড়তে পারে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

ট্রেনে যেতে হলে ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাওয়া যাবে দিনাজপুরের ট্রেন। অধিকাংশ ট্রেনগুলো সন্ধ্যা ৭টা ৪০ এবং সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে। শ্রেণিভেদে এই ট্রেনগুলোর টিকেট মূল্য নিতে পারে ৫৭৫ থেকে ১ হাজার ৯৭৮ টাকা পর্যন্ত।

আকাশপথে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি সৈয়দপুরের বিমান রয়েছে। আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোতে খরচ পড়তে পারে সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৭৯৯ থেকে ৫ হাজার ৩২৫ টাকা পর্যন্ত। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে অথবা পাবলিক বাসে সরাসরি কান্তজীও মন্দির যাওয়া যায়।

বাস ও ট্রেন যাত্রার ক্ষেত্রে দিনাজপুর সদর থেকে সরাসরি মন্দির যাওয়ার অটোরিকশা বা ইজিবাইক পাওয়া যায়। শহর থেকে অটোরিকশায় মন্দির পর্যন্ত যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে।

কান্তজীউ মন্দিরের যে বিষয়গুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করে

 স্থাপত্য সৌন্দর্য

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ২৬৬টি পোড়ামাটির অলঙ্কৃত মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে এই মন্দির। এর পুরো অবয়বে স্পষ্ট ফুটে আছে ইন্দো-পারস্য ভাস্কর শৈলীর নকশা।

মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে রয়েছে পোড়ামাটির উৎকৃষ্ট ফলকচিত্রের অলংকরণ। ফলকগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে মহাভারত ও রামায়ণসহ নানা পৌরাণিক কাহিনী। পুরো মন্দিরে টেরাকোটা টালির সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। পাথরের ভিত্তির ওপরে দাঁড়ানো মন্দিরের আসল উচ্চতা ৫০ ফুট। মন্দিরের নিচতলায় খিলান সংখ্যা ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি এবং তৃতীয় তলায় ৩টি। নিচের প্রতিটি প্রবেশপথের বহু খাঁজযুক্ত খিলানগুলোর যে কোনওটিতে চোখ রাখলে দেখা যায় ভেতরের দেবমূর্তি। খিলানগুলোকে আলাদা করা অলঙ্করণযুক্ত ইটের স্তম্ভগুলোও বেশ সুন্দর।

মন্দিরের টেরাকোটা ও ইটগুলো স্থানীয় নদী ও পুকুরের এটেঁল মাটি দিয়ে তৈরি। তবে ভিত্তির পাথরগুলো আনা হয়েছে হিমালয়ের তড়াই, আসামের পার্বত্য এলাকা, বিহারের রাজমহল ও বিন্ধ্যাঞ্চল পার্বত্য এলাকা থেকে। টেরাকোটা ও ইটগুলোর প্রত্যেকটি আগুনে পোড়ানো এবং রক্তের মতো লালবর্ণের। এ সমস্ত ইটের কাজ ও টেরাকোটাগুলোর করেছেন স্থানীয় গ্রাম্য মিস্ত্রি ও কারিগররাই।

ধর্মীয় উৎসব

মন্দির ভ্রমণে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হলো রাস মেলা। প্রতি বছর শীতের শুরুতে মন্দির প্রাঙ্গণে এক মাস ধরে উদযাপিত হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই উৎসব। রাস মেলা রাজা রামনাথ রায়ের শাসনামল থেকেই পালিত হয়ে আসছে। এ সময় বাংলাদেশসহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক তীর্থ যাত্রী এই মন্দিরে আসেন।

মেলা উপলক্ষে পুরো মাস ধরে বসে নানা ধরণের বিপণী। এগুলোতে বিক্রি করা হয় বিশেষ করে গুড়ের জিলাপী, শাখা-সিদুর, মুনহারী, জুতা, কাপড়, খেলনা এবং ফার্নিচার। এ ছাড়াও মেলায় আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু থাকে নাগরদোলা, সার্কাস, মোটরসাইকেল খেলা এবং যাত্রাপালা।

জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথী অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ বা আষাঢ়ের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় শ্রীকৃষ্ণ স্নান উৎসব। এ সময়টাতে গোটা কান্তনগরে থাকে হাজার হাজার শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের উপচে পড়া ভিড়।

স্থানীয় গ্রামবাসীদের আরও একটি প্রথা হচ্ছে ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমা। গৌড় পূর্ণিমার এই দিনে একে অপরকে হলি ছিটিয়ে বা লাল রঙে রাঙিয়ে উৎসব পালন করা হয়।

নয়াবাদ মসজিদ

মন্দির থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দক্ষিণে নয়াবাদ গ্রামে এই মসজিদের অবস্থান। কান্তজীউ মন্দিরের নির্মাণ কাজ যখন শেষ হয় তখন মুসলমান মিস্ত্রিরা নয়াবাদ গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এ কারণে এলাকাটির আরও একটি নাম মিস্ত্রিপাড়া মহল্লা। রাজা রামনাথের তত্ত্বাবধানে এবং আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হয় মসজিদটি। মুসলমান ধর্মীয় স্থাপনাশৈলীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখানেও ব্যবহার করা হয়েছে পোড়ামাটির অলংকরণ।

কান্তজীউ মন্দির ভ্রমণের সেরা সময়

মন্দিরের ভেতর-বাহির সাবলীলভাবে ঘুরে দেখা এবং রাস মেলাতে অংশগ্রহণের জন্য কান্তনগরে যেতে হবে শীতের মৌসুমে। এছাড়া বাহারি রকমের পিঠাপুলির কারণে উত্তরের এই জনপদ শীতকালেই বেশি জমজমাট থাকে। তবে দিনাজপুরের বিখ্যাত লিচু খেতে হলে ভ্রমণের জন্য বেছে নিতে হবে গ্রীষ্মকালকে।

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

৩০ থেকে ৪০ মিনিট দূরত্ব হওয়ায় এই মন্দির পরিদর্শনের জন্য দিনাজপুর শহরে থাকাটাই ভালো। সদরের পর্যটন মোটেলগুলো রাত্রিযাপনের জন্য সবচেয়ে ভালা উপায়। এগুলোতে ঢাকা থেকেই অগ্রিম বুকিং দেওয়া যায়। রুমের ধরনভেদে এই মোটেলগুলোর ভাড়া ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়াও সাধারণ মানের কিছু হোটেল রয়েছে যেগুলোতে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় রাত্রি যাপন করা যায়।

উদরপূর্তির জন্য দিনাজপুরের গরুর ভুনা মাংস এবং কাঠি কাবাব সেরা। পুলাহাট বিসিক এলাকায় ভাতের সঙ্গে মুরগি বা গরুর মাংস, ডাল, ও সবজির বেশ সুনাম রয়েছে। পিঠাপুলির মধ্যে পাটিসাপ্টার জনপ্রিয়তা একটু বেশি।

কান্তজীউ মন্দির ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা

শীতকালীন ভ্রমণের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রয়োজনীয় গরম কাপড়সহ পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া জরুরি। কারণ উত্তরের হাড় কাঁপানো শীতের পুরো চাপটাই এই অঞ্চলে পাওয়া যায়।

ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণের সময় তাদের স্বতন্ত্র আচার-প্রথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত।

আনন্দের আতিশয্যে এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে স্থানীয়দের কোনো প্রকার ক্ষতি হয়।

বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড খাওয়ার সময় খাবারের উচ্ছিষ্ট যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না।

কেনাকাটা বা স্থানীয় পরিবহন ভাড়া করার ক্ষেত্রে মার্জিত আচরণ বজায় রেখে দর কষাকষি করতে হবে।

দিনাজপুরের ঐতিহাসিক কান্তজীউ মন্দির বা কান্তজির মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং শত বর্ষের ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক মূর্ত প্রতীক। এর সূক্ষ্ম পোড়ামাটির বিশদ কাজ এবং স্থাপত্য নকশা পরিব্রাজকদের কাছে চির বিস্ময়। এখানকার রাস মেলা ও দোলসহ বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসবগুলোর সঙ্গে মিশে আছে এই স্থানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবনচরিত এবং বিশ্বাস। এ ছাড়াও মন্দিরটি শুধুএকটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়কেই তুলে ধরে না, দেশের প্রত্নতত্ত্ব ও পর্যটন শিল্পেও রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

 

Comments