পেশাদার ‘পুলিশে’র খোঁজে...
মিরপুর-৬ নম্বর বাজারেই তার সঙ্গে পরিচয়। মাঝেমধ্যে বাজার-সদাই করতে যেয়েই ঘনিষ্ঠতা। 'পটুয়াখালী স্টোর' নামের স্টেশনারি দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা দ্রব্যাদি মিলত অন্য আর দশটা দোকানের মতোই। কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি ছিলেন অনন্য। সেটা হচ্ছে তার ব্যবহার। নম্রতা আর মিষ্টি হাসির মধ্য দিয়ে তিনি আমার মন কেড়েছিলেন। অনেক দিন এমন হয়েছে তাকে দোকানে পাইনি বলে বাজার-সদাই ছাড়াই ফিরে গিয়েছি। আমাদের এখানে সেলস সার্ভিসের মান মোটেই সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে, কাঁচাবাজার আর স্টেশনারি দোকানে এই কাস্টমার সার্ভিস পাওয়া বেশ দুরূহ। সেই অভাবই পূরণ করেছিলেন তিনি। লম্বাটে গড়নের এই মাঝবয়সী ভদ্রলোককে আর খুঁজে পাইনি করোনার পর। করোনায় তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত জীবনে সেটা এক দুঃখের কারণও বটে। যাহোক, সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তার মঙ্গল করবেন। তার প্রসঙ্গেই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল।
অনেকদিন পর তার দোকানে গেছি কিছু সদাই করতে। দেখি তিনি বেশ ব্যস্ত, কজন কাস্টমার নিয়ে। আমাকে দেখেই কথা বলা শুরু করলেন। হঠাৎ এক কাস্টমার আসতেই তিনি দ্রুত বদলে গেলেন। আমাদের সবার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ওই ভদ্রলোকেরই দিকে মনোযোগ দিলেন। শুধু মনোযোগই নয়, বিশেষ ধরনের খাতির যত্ন করতে শুরু করলেন। আমিসহ অন্য কাস্টমাররা একটু ভড়কেই গেলাম। আমাদের তখন ভীষণ কৌতূহল, এই ভিআইপি কাস্টমার কে? সেই কথিত ভিআইপি কাস্টমার বিদায় নিতেই দোকানদারই প্রবল উৎসাহেই বললেন, আরে এনাকে চেনেন না। ইনি তো বেনজীর স্যারের মামাত ভাই। আমি হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলাম, কোন বেনজীর? দোকানদার আমার মূর্খতা দেখে হেসেই ফেললেন। বললেন, পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ।
কর্তৃত্ববাদী 'বেনজীর মডেল'
ফেসবুকে তখন একজন পুলিশ অফিসার খুব বিখ্যাত। পড়াশোনা আর নানারকম দার্শনিক অলোচনায় তখন তার ফ্যান ফলোয়ার বহুত। অক্সফোর্ডে পড়ে এসেছেন। খ্যাতিমান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানও। ফেসবুকেই বিসিএসসহ নানা বিষয়ে তথ্যভিত্তিক নানারকম ক্লাস নেন। মোদ্দা কথায় বলা যাবে তিনি একজন ইনফ্লুয়েন্সার ও মোটিভেশনাল স্পিকার। মনোযোগ সহকারে তার নানারকম নতুন বইপত্র নিয়ে আলোচনাগুলো শুনতাম। বলা ভালো তার দ্বারা উপকৃত হয়েছি, নতুন নতুন সব বইয়ের খোঁজ পেয়ে। তার ফেসবুকেই একদিন একটা পোস্ট দেখলাম বেনজীর আহমদ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। সেখানে বলা হয়েছে, পুলিশে তার আইডল হচ্ছেন, বেনজীর আহমেদ। একজন অক্সফোর্ড-পড়ুয়া পুলিশ অফিসারের চোখেও তিনি হিরো। ভেতর থেকে তার জানার কথা, বেনজীর আহমেদের কাজ-কারবার সম্পর্কে, তবুও তিনিই তাকে প্রকাশ্যে আইডল মানছেন। বলা ভালো, অনেক মেধাবী, চৌকস, বিদেশি ডিগ্রিধারী তরুণ পুলিশ অফিসারের চোখেই তখন বেনজীর আহমেদ আইডল পুলিশ অফিসার। কেননা ক্ষমতায়, পারদর্শিতায়, সরকারপ্রধানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় এবং বাহিনী হিসাবে পুলিশের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়িয়ে বেনজীর তখন পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক হিরো।
বহুবছর পর বেনজীর আহমেদই প্রথম পুলিশপ্রধান, যিনি পুলিশকে সরকারের কাছে আদরণীয়, গ্রহণীয় ও সরকারের সব পাপকাজের হাতিয়ার হিসেবে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। প্রজাতন্ত্রের বাহিনীর বদলে পুলিশ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। সরকারও তার প্রতিদান দিয়েছিল দুহাত ভরে। বেনজীর আহমেদ এবং তার অনুগত পুলিশ কর্তারা সরকারের কাছে যখন যা চেয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুহাত উজাড় করেই দিয়েছেন। অফিসারদের সংখ্যা বাড়ানো, সহায়ক হিসেবে সশস্ত্র আনসার নিয়োগ, অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করে পদমর্যাদা বাড়ানো, বেসামরিক প্রশাসনের ওপর ক্ষমতায়িত করা, বাণিজ্যিকভাবে ব্যাংকসহ নানাবিধ ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি ও বিকাশের সুযোগ দিয়েছিলেন পুলিশকে। করোনায় পুলিশের চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট হাসপাতাল ভাড়া করাসহ রাজারবাগে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। দেশের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তুলনায় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পুলিশের সব আর্থিক, বৈষয়িক ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন বেনজীর আহমেদ বাস্তবায়ন করেছিলেন তৎকালীন সরকারপ্রধানের হাত দিয়ে।
বেনজীর আহমেদ দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে নিজের কর্তৃত্বে দুই হাতে পুলিশের অবস্থারও উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। বিনিময়ে শেখ হাসিনা পুলিশকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের বদলে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতিষ্ঠান বানিয়েছিলেন। বিরোধী দল ও মতকে অভাবনীয় নিত্যনতুন উপায়ে নিপীড়ন করে নিষ্ক্রিয় করাসহ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সব দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়াকে প্রহরা দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে 'বেনজীর গং' শেখ হাসিনার অন্যতম নির্ভরতার জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিরোধী রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করাসহ অবৈধ ভোটচুরি ও ভোটডাকাতির নির্বাচনে পুলিশই ছিল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের প্রধানতম হাতিয়ার। পুলিশও তেমনি মনে করত তারাই ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে বারংবার।
পুলিশের আইজি হওয়ার আগে র্যাবের মহাপরিচালক আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবেই তখন তার দেশজোড়া খ্যাতি ও ক্ষমতা। অভাবনীয় তার শক্তিমত্তা। মিডিয়ায় তার কথা শুনলে মনে হতো সৃষ্টিকর্তা আর তখনকার প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কাউকে পরোয়া করেন না তিনি। তার চলা, বলা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল কেয়ারলেস, সবকিছুকে তোয়াক্কা না করার দম্ভে পূর্ণ। পরে তো মিডিয়ায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের খবর বেরিয়েছে। সেখানেও তিনি অনন্য। গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের বাইরে তিনিই ছিলেন সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
ফলে বেনজীরের এই নজিরবিহীন অপেশাদার ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পুলিশের অনেককে এমনকি স্টয়িক ফিলসফি নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনায় মগ্ন অক্সফোর্ড-পড়ুয়া তরুণ অফিসারকেও বিভ্রান্ত করেছে। বেনজীর আহমেদই তার চোখে আদর্শ মডেল অফিসার হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই আদর্শ-বিভ্রম তৈরি করে বেনজীর আহমেদ তার মতোই একঝাঁক দুর্বৃত্তকে পুলিশের পোশাকে জনগণের সামনে হাজির করেছেন।
হতাশ-হতোদ্যম: আত্মবিশ্বাসহারা
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বিকেলের দিকে একটি জেলা শহরের সদর থানার সামনে হাজির হয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি মানুষের প্রতিক্রিয়া। সারা শহরে তখন জনতার ঢল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস পুড়িয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। জেলার সব অফিস, প্রতিষ্ঠানে থাকা ম্যুরাল, কর্নার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি, ব্যানার, বিলবোর্ড কিছু নেই। সেরকম অবস্থায় থানার সামনে যেয়ে দেখি কোনো পুলিশ নেই, কোথাও। বহুতল ভবনের সদর থানার বিরাট গেটও তখন ভেতর থেকে বন্ধ। হঠাৎ দেখি একদল তরুণ যাদের বয়স ১৫-২০ বছর হবে, হইচই করতে করতে করতে এসেই সদর থানার গেটে হম্বিতম্বি শুরু করেছে। দুয়েকজন ঢিলও ছুড়ছে। তারা যে খুব সংগঠিত, সংঘবদ্ধ দেখে তা মনে হলো না। তাদের মধ্যে কয়েকজন তখন থানার গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকতে উদ্যত।
হইচই শুনে থানার বহুতল ভবনের দোতলায় কজন পুলিশ সদস্য এলেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। তরুণরা তাদের দেখে আরও উত্তেজিত। তারা গেট ভেঙে থানার ভেতরে ঢুকবেই। ঘটনা আরও বিপদজনক দিকে মোড় নেওয়ার মুহূর্তেই ওই পথ দিয়ে চলা একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন। দুহাত চিতিয়ে থানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তরুণদের ভর্ৎসনা করে ফিরে যেতে বললেন। বয়স্ক মানুষটির অবয়ব, গড়ন আর ব্যক্তিত্বের চাপে পড়ে এই অসংগঠিত তরুণরা দুয়েকটা ঢিল ছুড়ে আর গেটে কয়েকটা লাথি দিয়ে ফিরে গেল। খুব দ্রুতই ঘটে গেল এসব ঘটনা। মুরুব্বির এই হস্তক্ষেপেই থানা আক্রমণের হাত থেকে বাঁচল। এই ঘটনায় দোতলায় দাড়িয়ে থাকা হতচকিত-বিহ্বল-হতোদ্যম পুলিশদের অসহায়ত্ব আর চোখেমুখে নিদারুণ ভীতি ও হতাশা লক্ষ্য করলাম। ভাবলাম, মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেই এই পুলিশেরা কী দোর্দণ্ড ক্ষমতাবান, বেপরোয়া, শক্তিমত্তই না ছিলেন!
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। নগর পরিবহনে করে নীলক্ষেত থেকে চলেছি মিরপুরের দিকে। ঢাকা কলেজের সামনে আসতেই দেখি সড়কের ওপরে মালভর্তি দুজন ভ্যানওয়ালা চিৎকার করছেন ভীষণভাবে। তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন একজন বয়স্ক ট্রাফিক পুলিশ। দায়িত্বরত অন্য ট্রাফিক পুলিশ এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিতে গলদঘর্ম হয়ে উঠেছেন। যানজটে বাস থেমে আছে। বাসের যাত্রীরা খেয়াল করলেন, ভ্যানওয়ালারাই উল্টোপথে রাস্তা অতিক্রম করতে চাইছেন। দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ বাধা দিয়েছেন ন্যায়সঙ্গতভাবেই। ভ্যানওয়ালা তা না মানায় পুলিশ সদস্যের একজন হয়তো একটু কড়া কিছু বলেছেন। ভ্যানওয়ালা সেটাকেই ইস্যু করেই হইচই বাধিয়ে ফেলেছেন। এই ঘটনা দেখে বাসের একজন যাত্রী বলেই ফেললেন, দেশে কী দিন আসলো, ভ্যানওয়ালা অন্যায় করেও পুলিশকে ঝাড়ি দিচ্ছে!
কেন এমন হলো
বাংলাদেশ পুলিশ আওয়ামী লীগের পুলিশ হয়ে বছরের পর বছর জনগণকে বেআইনি ক্ষমতা দেখিয়েছে। বহুরকম অন্যায় ও অনাচারের সঙ্গে জড়িয়েছে। বীভৎস পৈশাচিকতায় হত্যা-খুন-গুমের কাজে নেমে মানুষের আস্থা হারিয়েছে। সেই পুলিশকে এখন লড়তে হচ্ছে তার ভাবমূর্তি ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারের এক কঠিন কাজে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই হত্যা-খুনের আসামি হয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশে বহুরকম পরিবর্তন, পদায়ন, পদোন্নতি ঘটেছে। কিন্তু পুলিশকে কিছুতেই সচল, সক্রিয় করা যাচ্ছে না। কিছুতেই তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। কিন্তু এ পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
১। পুলিশ বাহিনী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ন্যারেটিভের অংশীজন হয়ে উঠেছিল তাদের বড় কর্তাদের নেতৃত্বে। পুলিশের নিজস্ব যে কর্মপদ্ধতি, আইনি সীমা, দার্শনিক উদ্দেশ্য—সবকিছুকেই তারা গুলিয়ে ফেলেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ন্যারেটিভের সঙ্গে। পুলিশ যে রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশীজন নন, বরং তারা যে প্রজাতন্ত্রের অংশীজন সেই তাত্ত্বিক ভাবনাটাই গুলিয়ে ফেলেছিল কতিপয় কর্মকর্তা। পরে সেটারই বিস্তার ঘটে পুরো বাহিনীতে। পোশাকে, আচরণে, কাজের ধরনে সমগ্র পুলিশ বাহিনী আওয়ামী রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। পেশাদারিত্ব সম্পূর্ণরূপে ভূলুণ্ঠিত হয়।
২। পুলিশ বাহিনীর গঠন, কর্মপদ্ধতি, প্রশিক্ষণ সবটাই করা হয়ে থাকে জনসেবার আঙ্গিক থেকে। দিনে দিনে পুলিশে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতিবিহীন পুলিশের ইমেজ বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। তারপরও জনগণ সেটা মেনেই পুলিশের সার্ভিস নিতে অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হতে যেয়ে পুলিশ বাহিনী জনগণের প্রতি 'দায় ও দরদের' জায়গা থেকে সরে এসে 'নিপীড়ক ও হন্তারকের' জায়গা বেছে নিয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে নিপীড়ক ও হন্তারকের 'ট্রিগার হ্যাপি সংস্কৃতি' পুলিশকে তার পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে সম্পূর্ণরূপে হটিয়ে দিয়েছে। জনমানুষের সঙ্গে তা কেবল তার দূরত্বই বাড়িয়েছে।
৩। গত কয়েক দশকে বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে অনেক মেধাবী, দীপ্তিময়, কর্মকুশল, চৌকস কর্মকর্তা যুক্ত হয়েছেন। এদের অনেকেই পরে আবার ইউরোপ-আমেরিকা থেকে বৈচিত্র্যময় বিষয়ে উচ্চতর লেখাপড়া করে এসেছেন। বহুজন বহুরকম দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বহুজনের বিদেশি মিশনে কাজ করার মূল্যবান অভিজ্ঞতাও যুক্ত হয়েছে। ক্রমশ পুলিশ বাহিনী শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত, আধুনিক মননের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে জনবান্ধব পেশাদার বাহিনীতে পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশে 'বেনজীর মডেল', 'হারুন মডেল', 'মনিরুল মডেল', 'প্রলয় মডেল'র মতো নানারকম উপদ্রব সেই পেশাদার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বিপদাপন্ন করেছে।
৪। আওয়ামী রাজনীতির পার্ট হয়ে পুলিশ বাহিনী তার কাজের মাধ্যমে নিজেদের 'ইসলামোফোবিক' দৃষ্টিভঙ্গির বাহিনীতে পরিণত করেছে। জঙ্গি নিধনের নামে সমাজের বৃহত্তর অংশে ভীতি-সন্ত্রাস ছড়িয়ে জনগণের সঙ্গে এক মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি করেছে। ফলে জনভাষা ও জনইশারা কী বলছে, সমাজে মানুষ কী ভাবছে, দেয়ালের লিখন কী রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে—তা পড়তে সম্পূর্ণরূপে অপারগ হয়েছে তারা। পুলিশের পেশাদারিত্বের এই অভাব জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও জননিরাপত্তাকেও বিপদাপন্ন করেছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
পুলিশের এখনকার সংকট মূলত তার অসৎ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাজনিত অসুখেরই বহিঃপ্রকাশ। এই অসুখ দিনে দিনে পুলিশ বাহিনীর অপেশাদারিত্বকেই বাড়িয়েছে ভীষণভাবে। মনে রাখতে হবে, পুলিশের যে কাজ, সেই কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করানো সম্ভব নয়। সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন, আদালত—পুলিশের কাজ করতে পারবে না। বরং পুলিশ তার পেশাদারিত্ব ফিরে পেলে সুষ্ঠুভাবে সিভিল প্রশাসন, আদালত চালানো সহজ হবে।
রাজনীতিমুখী নয়, রাজনৈতিক দলের অংশীজন নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে জনগণের সেবার মনোভাবকে একমাত্র ফোকাস করেই পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। গত দেড় দশকে অপেশাদারি দলদাস কাজের মধ্য দিয়ে পুলিশের মনস্তত্বে যে ট্রমা তেরি হয়েছে, জনগণের সঙ্গে যে দূরত্ব বেড়েছে—সেই জায়গাটা ফোকাস করেই তা নিরসনে কাজ করতে হবে।
পুলিশ বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা-সদস্য হত্যা-গুম-খুনসহ গণহত্যার অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।
জনসেবার মনোভাব নিয়ে জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা উদ্ধারে সবরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই যোগ্য, সৎ, কর্মকুশল সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় পদায়ন করতে হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি দিতে হবে। মোদ্দাকথা একমাত্র সঠিক পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে এনেই পুলিশবাহিনীকে সুরক্ষা দিতে হবে।
শুভ কিবরিয়া: সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Comments