চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৮৮ ভাগই ‘ডেন-’২ ভেরিয়েন্টের
চট্টগ্রামে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮৮ ভাগ রোগীর মধ্যেই পাওয়া গেছে 'ডেন-২' ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস। ১১ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে 'ডেন-৩' ধরন। এ বছরই প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে বিপদজনক 'কসমোপলিটন' ধরন পাওয়া গেছে, যা দেশের অন্য কোথাও এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান গবেষকরা।
এ ছাড়াও গত বছরের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৫০ ভাগ রোগীর মাঝেই রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়িয়ে দেওয়া বিপজ্জনক 'কসমোপলিটন' ধরন। এ বছরও ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে 'কসমোপলিটন' ধরন পাওয়া যাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে চলমান গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চলমান এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আইসিডিডিআরবি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ।
কসমোপলিটান ভেরিয়েন্টের কারণে হাসপাতালে ভর্তির হার বেড়ে যাওয়া ও মৃত্যুর হারের ঊর্ধগতির কারণ মনে করা হচ্ছে।
গবেষক এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডা. মো. আবদুর রব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে কসমোপলিটান ধরনটি চট্টগ্রামেই প্রথম পাওয়া গেছে। দেশের অন্য কোথাও কসমোপলিটান ধরনটি পাওয়া যায়নি।'
গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৯ ভাগ রোগীই 'ডেন-২' সেরোটাইপে আক্রান্ত। চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ পুরুষ, ডেঙ্গু রোগীদের প্রতি পাঁচজনে একজন শিশু।
এ ছাড়াও গবেষণায় চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল পাঁচটি এলাকায়, যেগুলোকে গবেষকরা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এলাকাগুলো হলো বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং এবং বায়েজিদ বোস্তামী। এ ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া এবং কর্ণফুলী এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালে ১৫০০ রোগীর ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ও পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বিআইটিআইডি, আইসিডিডিআরবি এবং নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন ল্যাব। পুরো গবেষণার সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানে ছিল স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন।
চট্টগ্রামে পাওয়া কসমোপলিটান লিনিয়েজ বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পাওয়া ইতোপূর্বের প্রকরণগুলো থেকে চট্টগ্রামে পাওয়া প্রকরণটি উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। ফাইলোজেনেটিক বিন্যাস তথা তুলনামুলক বিশ্লেষণে পাওয়া যায় এই প্রকরণগুলো মিয়ানমার এবং ভারতে প্রবাহিত হচ্ছে।
গবেষকরা ধারণা করছেন, পর্যটক ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে এই বিপজ্জনক প্রকরণটি দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এই প্রকরণ ডেঙ্গুর তীব্রতা ও মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয়।
গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার ৫টি এবং উপজেলা পর্যায়ে ৫টি এলাকাকে ডেঙ্গু রোগের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজকে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভালো থাকত।'
এই জিনোম সিকুয়েন্সগুলো জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) এ গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়াও এই গবেষণার দুটি গবেষণাপত্র ইতিমধ্যে ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে গৃহীত হয়েছে।
২০২৪ সালে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই গবেষণা দলে রয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার ও ডা. নুরুদ্দিন মুহাম্মাদ ফয়সাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডা. মো. আবদুর রব।
Comments